বাংলাদেশে ঢল নেমেছে রোহিঙ্গাদের। গত কয়েক বছরে নানা অপরাধে জড়িয়ে রোহিঙ্গারা হুমকি হয়ে উঠেছে স্থানীয় জনগণের জন্য। তবে খেলাধুলার মাধ্যমে সম্প্রীতি বাড়ছে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের। এ নিয়ে দুই পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব আজ। কক্সবাজার ঘুরে এসে লিখেছেন রাহেনুর ইসলাম
ব্যাডমিন্টন আকৃতির ছোট্ট মাঠ। সিনথেটিকের বল নিয়ে ৪ নম্বর ক্যাম্পের সেই মাঠে জনা পঞ্চাশেক রোহিঙ্গার জটলা। তারা মেতে আছে নেট ভলিবল বা কিক ভলিবলের মতো একটি খেলায়। মিয়ানমারজুড়ে জনপ্রিয় খেলাটার নাম ‘চিনলোন’। আধুনিক হয়ে সেটাই এখন সেপাক টাকরো। এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমসের মতো আসরেও জায়গা পেয়েছে এটা।
রোহিঙ্গাদের তো আর এসব গেমসে যাওয়ার উপায় নেই। দিনভর ছোট্ট ঘরে বদ্ধ না থেকে তারা বিনোদন খুঁজে নেয় এই খেলার নিজস্ব রূপ ‘চেলুং’-এ। ক্লান্ত হয়ে কোর্ট থেকে ফেরা মাসুক মিয়া খেলাটা নিয়ে উচ্ছ্বাস নিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন, ‘‘ওপারে থাকতে এই খেলাটা খেলতাম। জীবন হাতে নিয়ে বাংলাদেশে এসে এভাবে খেলতে পারব কখনো কল্পনাও করিনি। এই দেশের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।’’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন (আরআরআরসি) পর্যন্ত আগ্রহী খেলাটা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। কারণ ৩৪টি ক্যাম্পের ছোট জায়গায় একসঙ্গে অনেকের বসবাস। তাদের মধ্যে কিশোর আর যুবকই বেশি। এ জন্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত হওয়া স্বাভাবিক। ক্যাম্পে বাড়তে থাকা অপরাধপ্রবণতা আর স্থানীয়দের মধ্যে নিরাপত্তা আতঙ্ক দূর করতে চিনলোন, সেপাক টাকরো বা চেলুংকে কাজে লাগানোর কথা জানালেন ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (উপসচিব) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা, ‘‘নিজেদের প্রিয় খেলাটা খেললে অন্তত অপরাধ থেকে দূরে থাকবে উঠতি বয়সীরা। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার, কিন্তু একজনকেও পাঠানো যায়নি। যত দিন ওরা এখানে থাকে তত দিন আমরা চাইব ওরা যেন অপরাধী না হয়ে ওঠে।’’
আয়োজন হচ্ছে চিনলোন টুর্নামেন্ট
হত্যা, অপহরণ, মাদকের মতো ভয়াল অপরাধ জগতকে পাস কাটিয়ে শিক্ষা, খেলাধুলা ও বিনোদনে নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গাদের বড় একটা দল। তাদের সাহায্য করছেন স্থানীয় ক্যাম্প প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থা।
এরই অংশ হিসেবে এখন ‘চিনলোন’ খেলার উৎসবে মেতেছেন রোহিঙ্গারা। চিনলোন-এর জন্য বড় মাঠের প্রয়োজন নেই। নির্দিষ্ট উচ্চতার নেটের দুই প্রান্তে তিনজন করে খেলোয়াড় থাকেন। বাঁশ বেতের তৈরি গোলাকার হালকা বল নিয়ে পায়ে ও হেডে (মাথা দিয়ে) খেলাটি চলে। কোনো খেলোয়াড় হাত দিয়ে বল ছুঁতে পারেন না। জয়ী হয় আগে ১৫ পয়েন্ট পাওয়া দল।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে শরণার্থী জীবন শুরুর পর বিভিন্ন ক্যাম্পে চিনলোন খেলতেন রোহিঙ্গারা। তবে টুর্নামেন্ট আয়োজনের উপায় ছিল না। ২০২৪ সালে দূর হয়েছে সেই আক্ষেপও। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ‘চিনলোন’ টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। প্রথম আসর সফল হওয়ায় এ বছর আরও বড় পরিসরে আয়োজন করা হয়েছিল আন্ত ক্যাম্প চিনলোন টুর্নামেন্ট।
এ বছর উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বলিবাজার মাঠে ‘চিনলোন’ টুর্নামেন্টের আয়োজন করে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধীনস্থ পানবাজার এপিবিএন ক্যাম্প। এতে অংশ নিয়েছে ৮, ৯ ও ১০ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১২টি দল।
টুর্নামেন্ট উপভোগ করতে প্রতিদিনই হাজার হাজার রোহিঙ্গা ভিড় করেছেন খেলার মাঠে। অন্যরকম উচ্ছ্বাস তাদের মধ্যে।
তাদের এমন উৎসবের আমেজ দেখে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন (আরআরআরসি) পর্যন্ত খেলাটা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী। কারণ ৩৪টি ক্যাম্পের ছোট জায়গায় একসঙ্গে অনেকের বসবাস হওয়ায় দ্বন্দ্ব-সংঘাত স্বাভাবিক। ক্যাম্পে বাড়তে থাকা অপরাধপ্রবণতা আর স্থানীয়দের মধ্যে নিরাপত্তা আতঙ্ক দূর করতে চিনলোন হতে পারে অন্যতম মাধ্যম।
উখিয়ার ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধিনায়ক মো. আমির জাফর সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন, ‘‘আমরা চিনলোন টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছি মাদককে না বলতে। রোহিঙ্গা যুবকরা খেলায় সম্পৃক্ত থাকলে তারা অপরাধ থেকে দূরে থাকবে। তাদের শরীর মন ভালো থাকবে, ক্যাম্পের শৃঙ্খলা স্বাভাবিক থাকবে। এ ধরনের আয়োজনে সবসময় তাদের পাশে থাকবে এপিবিএন।’’
আছে আধুনিক জিম
উখিয়ায় গত বছর একটি জিম গড়ে তুলেছিলেন আলাউদ্দিন আজাদ। পুলিশের সাবেক এই কনস্টেবলের ‘আল রুহি জিম সেন্টার’-এ স্থানীয়দের পাশাপাশি ভর্তি হতে থাকে রোহিঙ্গারাও। খবর পেয়ে গোয়েন্দা বিভাগের কর্তারা বন্ধ করে দেন এটা। তবে বদ্ধ স্থানে থাকা রোহিঙ্গাদের বিনোদনের জন্য হলেও জিমের অনুমতির জন্য দৌড়ঝাঁপ থামাননি আলাউদ্দিন আজাদ। শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেছেন অনুমতিও।
জিমের ম্যানেজার মো. জুবায়ের খুশি এ জন্য, ‘‘আমরা কর্মকর্তাদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছি, জিম ক্ষতিকর কিছু না।’’
রাতে পাহারা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অভিযান চালিয়ে প্রায়ই বিদেশি ভারী অস্ত্র উদ্ধার করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) দলগুলো। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহসহ আরো কয়েকজন খুন হওয়ার পর ক্যাম্পে বিদেশি অস্ত্র পাওয়াটা অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ৮ এপিবিএনের কমান্ডিং অফিসার (পুলিশ সুপার) মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান জানালেন অন্য কথা।
সকাল সন্ধ্যাকে সিহাব কায়সার বললেন, ‘‘এখন রাতে প্রায় চার হাজার স্বেচ্ছাসেবক ক্যাম্পের বিভিন্ন পয়েন্টে পাহারা দেয়। তাই আগে যখন একটি অভিযানেই তিন লাখ ইয়াবা পাওয়া যেত, এখন সেখানে পাওয়া যায় মাত্র ৩০০-৫০০ ইয়াবা।’’
হালিম, জিকরুল, কামরুলদের মতো পাহারা দেওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকে দিনে খেলেন ফুটবল, সেপাক টাকরো, ভলিবলের মতো খেলাগুলো। তাঁদের জন্য অপরাধের মাত্রা কমাটা সহায়ক হয়েছে বলে ধারণা কায়সার খানের, ‘‘সব সময় অপরাধ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে খেলাধুলা। এর প্রতিফলন ক্যাম্পে দেখছি আমরা।’’
টেকনাফ বিশেষ জোন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানও সে কথা বলছে। ২০২১ সালে রোহিঙ্গাদের মাদক মামলা ছিল ১২টি, আসামি ১৪ জন আর ইয়াবা জব্দ হয়েছিল ১২২০০০টি। ২০২২ সালে মামলা কমে হয় ৫টি, আসামি ৭ জন আর ইয়াবা জব্দ ৩৬০০০টি। ২০২৫ সালে মামলা হয়েছে ৩টি, আসামি ৪ জন আর ইয়া জব্দ হয়েছে ১২০০০টি।
এজন্য কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো.আ. মান্নান জানালেন শুভ কামনা, ‘‘আমি পুরোটা জানি না। জেনেই মন্তব্য করতে হবে। তার পরও বলব, খেলাধুলার মাধ্যমে অনেক কিছু সম্ভব। রোহিঙ্গা শিবিরে যদি খেলার প্রসার হয়ে থাকে, তাহলে তাদের শুভ কামনা রইল।’’
শেষ চাওয়া
২০১৭ সাল থেকে ঢল নামলেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে নব্বইয়ের দশক থেকে। ১৯৯২ সাল থেকে কুতুপালং শিবিরে থাকা হেলাল উদ্দিন তাঁদেরই একজন। এএফসি ও বাফুফে যে ৭৫ জন কোচকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, হেলাল তাঁদের টিম লিডার। ক্যাম্পে দেখা হওয়ার পর তাঁর আকুতি, ‘‘খেলাধুলার মাধ্যমে বিনোদনের ব্যবস্থা করায় আমরা কৃতজ্ঞ। তবে অনেক হলো, এবার দেশে ফিরতে চাই।’’
রোহিঙ্গাদের এই চাওয়া পূরণ হবে তো?



