জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের তিনতলা। এখানে অস্ত্রোপচার কক্ষ। পুড়ে যাওয়া রোগীদের নানা ধরনের অস্ত্রোপচার হয়, ড্রেসিং হয় এখানে। এই তিনতলার একেবারে শেষ প্রান্তে অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনে বেশ খানিকটা খালি জায়গা। এখানেই অপেক্ষা করেন রোগীর স্বজনরা।
সেখানে যেতেই দেখা মেলে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে আহত রোগীর স্বজনদের। তাদের মধ্যে আছেন মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমানের ছেলে নাভিদ নেওয়াজ দীপ্ত। ১৩ বছরের এই কিশোর রয়েছে বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। ছেলেকে কিছুক্ষণ পর ড্রেসিং করাতে নিয়ে যাবে অস্ত্রোপচার কক্ষে, সেজন্যই এখানে অপেক্ষা করছিলেন মিজানুর রহমানসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। তবে এখানে নেই দীপ্তের মা আর ছোটবোন।
ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে অসুস্থ হয়ে গেছেন মা নিজেই আর ভাইয়ের সঙ্গে একই স্কুলে পড়ুয়া ছোটবোনও ট্রমাটাইজড; বিমান বিধ্বস্তের সময়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নায়রা আফরিন দিয়া স্কুলেই ছিল। দিয়াই স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের কথা জানায় বাসায় মাকে, যদিও তার আগে সে নিজে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পর আরেকজনের কাছ থেকে ফোন নিয়ে মাকে ফোন করে বলে, আমাদের স্কুলে প্লেন ক্র্যাশ করেছে। তোমরা তাড়াতাড়ি আসো; খবর পেয়ে ততোক্ষণেতো দিয়ার মা স্কুলেই চলে গিয়েছিল বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন নাভিদের মামা।

সেখানে গিয়ে দ্বীপ্তের বাবার সঙ্গে কথা বলার মতো সাহস হচ্ছিল না প্রথমে। কথা হচ্ছিল তার মামার সঙ্গে। তবে একসময় বাবা মিজানুর রহমানের সঙ্গেও কথা হয়।
ছেলে ৫২ শতাংশ পোড়া নিয়ে আইসিইউর বিছানায়, স্ত্রী এবং মেয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ; ইস্পাত কঠিন হয়েই যেন ছিলেন মিজানুর। কিন্তু একসময় খোলস খুলে যায়; ভেঙে যায় অর্গল; কাঁদতে থাকেন শিশুর মতোই। সে কান্না সংক্রমিত হয় উপস্থিত সবার ভেতরে।
দীপ্তের মামা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, এতবছরের পুরান প্লেন চলছিল, প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নাকি এই প্লেন দিয়ে। কিন্তু এগুলোতো তুরাগ বাসের মতো। ভেতরের সব নষ্ট, বাইরে থেকে কেবল রঙ করে নতুন বলে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়। এটা একটা গরীব দেশ, দেশের মানুষগুলোও গরীব। তাই তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে; এই দেশের মানুষের কোনও দামই নেই কারও কাছে।
তিনি জানালেন, ছুটির সময় ছিল। অনেক বাচ্চারা ছিল, অভিভাবকরাই ছিল সেসময়। দীপ্তের ক্লাস ছিল দোতলায়। তবে দীপ্তরা টিচার্স রুমে ছিল কোনও একটা কাজে। ঠিক সে সময়েই বিমানটা বিধ্বস্ত হয়।
সেখান থেকে কয়েকজনকে বাঁচাতে গিয়েই দীপ্ত আর ওর আরেক বন্ধু বেশি আহত হয়। খবর পেয়ে প্রথমে উত্তরার লুবানা হাসপাতাল, দুই ঘণ্টা পর সিএমএইচে নেওয়া হয় দীপ্তকে। এরপর মঙ্গলবার বিকাল পাঁচটার দিকে সিএমএইচ থেকে তাকে বার্ন ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়।
দীপ্ত কথা বলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ওরা শেষ সময়ে কয়েকজনকে বাঁচিয়েছে। তাদের কথাও জিজ্ঞেস করছে। আইসিইউর শয্যায় শুয়ে মামার কাছে আবদার করেছে বন্ধুদের দেখার জন্য।
রাগে কষ্টে বিক্ষুদ্ধ মনে মিজানুর রহমান বলেন, এই বিমান কেন কেনা হবে? স্কুল কেন ফ্লায়িং জোনের ভেতরে থাকবে? এই স্কুলের শিক্ষার্থী শিক্ষক এদের ট্রমা কিভাবে কাটবে সে প্রশ্নও করেন তিনি।
মিজানুর রহমান কথা বলতে থাকেন, “সব রোগই কঠিন, সব বাবার জন্য সন্তানের যে কোনও অসুখই কঠিন, কিন্তু অন্য সব ধরনের রোগ বাবা হিসেবে মেনে নিতে পারবেন…কিন্তু এটা এমন একটা সিচুয়েশন…আমি বারবার সবটুকু শক্তি নিয়ে ওর সামনে যাই…কিন্তু যাবার পর ওকে দেখলে..যা নিয়ে গেছি সব শেষ। অন্য কিছু হলেতো ওকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম, ছেলেকে আমি বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে রাখতাম…কিন্তু এ যে এমনই…
“আমার ছেলে আমাকে বলে, আমি আমার ফ্রেন্ডদের বাঁচিয়েছি, যদি না বাঁচাতাম তাহলে আমার গিল্টি ফিল হতো…সিএমএইচ থেকে আসতে আসতে বলছিল ছেলেটা আমার…আমি ছেলেটাকে ধরে বললাম, তুমি আমার শ্রেষ্ঠ বাবা…” মিজানুর রহমান আর পারলেন না, শব্দ করে কেঁদে উঠলেন।

কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ওর পাখির কথা বলল, ছোটবোনের সঙ্গে ঝগড়ার কথা বলল।
ছোটবোনের সঙ্গে ঝগড়া হতো জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, “দীপ্ত বলেছে দিয়াকে বলো যে ওর সঙ্গে আমি আর ঝগড়া করব না…”
পরে পাশে দাঁড়ানো দীপ্তের মামা বলেন, “ছোটবেলা থেকেই রাস্তার পশুপাখি থেকে শুরু করে সব জীবজন্তুর প্রতি ওর ভালোবাসা। প্রথমে বিড়াল পালতো বাসায়, কিন্তু ওর মায়ের অ্যালার্জির সমস্যার কারণে মা তাতে বাধা দেয়। এরপর বিড়াল বাদ দিয়ে ঘরে পাখি পুষছে।”
আইসিইউর বেডে শুয়ে নাভিদ পাখির খোঁজ নিচ্ছে, বোনকে বলেছে ঠিকসময়মতো পাখিদের খাবার দিতে।
ছেলের কথা বলতে বলতে মিজানুর রহমান জানালেন ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষিকা মেহরীন চৌধুরী ছিলেন তার স্কুলের বন্ধু। একসঙ্গে তারা লেখাপড়া করেছেন ছোট থেকে।
কখনও ছেলের কথা বলছেন, কখনও বলছেন বন্ধু মেহরীনের কথা। ‘কত কফি খেয়েছি একসাথে’ স্মৃতির ভান্ডার যেন খুলতে শুরু করে তার।
এতগুলো বাচ্চাকে বাঁচিয়ে সে অবশেষে চলেই গেল। মুখে হাত রেখে চাপা কণ্ঠেই মিজানুর বলেন, “আই অ্যাম প্রাউড অব মাই ফ্রেন্ড, আই অ্যাম প্রাউড অব হার।”
ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়িতে বিমান বিধ্বস্তের পর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রোগীদের মধ্যে আটজন এখনও সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দীন।
তিনি জানান, ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীনদের এখন তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ক্রিটিকাল বা সংকটাপন্ন, সিভিয়ার বা গুরুতর এবং ইন্টারমিডিয়েট বা মাঝামাঝি অবস্থানরত।
অধ্যাপক নাসির উদ্দীন বলেন, “ভর্তি থাকা রোগীর মধ্যে আটজন ক্রিটিকাল, ১৩ জন সিভিয়ার আর বাকি ২৩ জন ইন্টারমিডিয়েট অবস্থায় রয়েছে।



