প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমতের পথে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সেটি হবে ‘জাতির নবজন্মের মহোৎসব।’
বাসস জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকার ফরেইন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান সংলাপে তিনি এ বক্তব্য দেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ২০২৬ সালের এপ্রিলে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত মে মাসে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর ড. ইউনূস নির্বাচনের সময় ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত জানান।
বিএনপিসহ অধিকাংশ দল ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে সম্মত হলেও অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ভোটের চেয়ে সংবিধানসহ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়া নিয়ে অনেকের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে আশ্বস্ত করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “শুরুতে যখন কমিশনের ধারণা এল, আমি নিশ্চিত ছিলাম না—এটা টিকবে কি না। কিন্তু আজ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পরে আপনাদের আলোচনা ও সিদ্ধান্তে আমি অভিভূত হয়েছি।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কমিশনের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে অন্য দেশগুলোও অনুসরণ করবে।
“এটা শুধু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে না, সারা দুনিয়া লক্ষ্য করবে আমরা কীভাবে সমস্যার সমাধান করলাম।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, জাতির সামনে আর কোনও বিকল্প পথ নেই।
“যে পথে আমরা শুরু করেছি, সেই পথ থেকে বের হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এই সমতায় আমাদের আসতেই হবে। এটাই ছাত্র-জনতার দেওয়া সুযোগ, যেখান থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।”
আগামী নির্বাচনের বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা বারবার বলেছি— ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে। সেটি হবে মহোৎসবের নির্বাচন, যদি আমরা ঐক্যমতের মাধ্যমে ফয়সালা করতে পারি। এই নির্বাচন শুধু নির্বাচন নয়, এটি হবে জাতির নবজন্ম।”
তিনি আরও বলেন, “জাতির সত্যিকার নবজন্ম হবে- এটা শুধু নির্বাচন না, এটা নবজন্ম। এই যে এত ত্যাগ, এত রক্ত- এগুলো সার্থক হবে যদি আমরা এই নবজন্মটা লাভ করতে পারি।”
প্রধান উপদেষ্টা সতর্ক করে বলেন, বিভাজন বা দ্বিমতের কোনও স্থান নেই।
“আমরা অনেক কথা বলতে পারি, কিন্তু দ্বিমত রেখে সমাপ্ত করতে পারব না। যখন ঐকমত্যে পৌঁছাব, তখনই নির্বাচন সার্থক হবে।”
অধ্যাপক ইউনূস উদাহরণ টেনে বলেন, “আমাদের হাতে এখন আলাদিনের প্রদীপের মতো সুযোগ এসেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সেই শক্তি এনে দিয়েছে। আমরা চাইলে ছোটখাটো বিষয় চাইতে পারি, আবার চাইলে পুরো জাতিকে নতুনভাবে গড়তে পারি। এই সুযোগ একবারই এসেছে, আর আসবে না।”
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
“এত বড় কাজ আর কোনোদিন পাওয়া যাবে না। তাই ধৈর্য ধরে আমাদের এগোতে হবে। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আমাদের কাজ হলো— কোনও দ্বন্দ্ব ছাড়াই মহোৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করা।”
তিনি বলেন, “আমরা হাইওয়ে বানিয়ে ফেলেছি, এখন শুধু সাইনবোর্ড বসানো বাকি। পথ ঠিক আছে, গন্তব্য পরিষ্কার। এই নির্বাচন হবে উৎসবের নির্বাচন, দেশের শান্তি ও নতুন যাত্রার সূচনা।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের সংস্কারের মূল লক্ষ্য হলো সব পথঘাট বন্ধ করা, যাতে কোনও স্বৈরাচার আর ফিরে আসতে না পারে। এজন্য সবাইকে একমত হতে হবে।”
অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজকে অভূতপূর্ব অর্জন বলে অভিহিত করেন প্রধান উপদেষ্টা।
কমিশনের সদস্য ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরিশ্রমের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আপনারা ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছেন। এখন শুধু এটিকে নিখুঁতভাবে সমাপ্ত করা দরকার। এর মধ্য দিয়েই নতুন জাতির জন্ম ঘটবে।”
এসময় তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ করে বলেন, “এবার আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ঐকমত্যের এই পথেই আমরা এগোব, নির্বাচন সফল করব এবং জাতি হিসেবে মহাউৎসবের যাত্রা শুরু করব।”
অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার।