যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়ন অফিসের ওয়েবসাইটের মাত্রচিত্রে পশ্চিম তীর এবং গাজাকে এতদিন ‘অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চল’ লেখা হতো। তা এখন বদলে গেছে। সেখানে এখন লেখা ফিলিস্তিন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার রবিবার ফিলিস্তিনকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেওয়ার পর ওয়েবসাইটে এই পরিবর্তন আনা হয়।
একই দিন কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপের আরেক দেশ পর্তুগালও জানিয়েছে, তারাও এই পথে এগোচ্ছে। একই প্রস্তুতি নিচ্ছে ফ্রান্সও।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির পালে এই হাওয়া দেখা যাচ্ছে।
এতে স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইসরায়েল। তারা বলেছে, এখন ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার মানে হচ্ছ ‘ইসরায়েলকে নির্মূল করার একটি মঞ্চ’ তৈরি করা। এটা হামাসকে পুরস্কৃত করার শামিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে এটা ভালো চোখে দেখছেন না, সেই খবর এসেছে দেশটির সংবাদমাধ্যমে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথ থেকে জাপানকে সরিয়ে আনতে পারলেও যুক্তরাজ্যসহ এই দেশগুলোতে সরিয়ে আনতে পারেনি ওয়াশিংটন।
স্টারমার নিজের এক্স হ্যান্ডেলে এক ভিডিও বার্তায় ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়ে বলেন, “ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের শান্তির আশা এবং দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে পরিকল্পনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে আজ যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।”
মধ্যপ্রাচ্যকে ক্রমবর্ধমান সংঘাত থেকে বের করে আনতে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখতে যুক্তরাজ্য কাজ করছে জানিয়ে স্টারমার বলেন, “এর অর্থ একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, যার কোনোটিই এখন আমাদের কাছে নেই।”
গাজার পুরোটা দখল করতে ইসরায়েল যখন অভিযান তীব্র করছে, তাতে যখন মৃতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, বাস্তুহারা মানুষ বাড়ছে, তখন ফিলিস্তিনের এই স্বীকৃতি এল।
গত জুলাই মাসেই স্টারমার বলেছিলেন, ইসরায়েল যদি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত না হয়, জাতিসংঘকে ত্রাণ সরবরাহ পুনরায় শুরু করার অনুমতি না দেয়, তাহলে তার সরকার ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে।
ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য ১৯৬৭ সালের সীমানা ধরে ভবিষ্যতের আলোচনার পক্ষে অবস্থান জানিয়েছে।
হামাসের কর্মকাণ্ড, ইসরায়েলি অভিযান এবং পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আশা ম্লান করে দিচ্ছে বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী।
“কিন্তু আমরা সেই আলো নিভতে দিতে পারি না। এই কারণেই আমরা একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐকমত্য তৈরি করছি, যা গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি থেকে শুরু করে তা দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আলোচনায় নিয়ে যাবে।”
স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি স্টারমার গাজায় দুই বছর ধরে জিম্মি অবস্থায় থাকা ইসরায়েলিদের মুক্তি দিতে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমি জিম্মিদের পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করেছি। আমি দেখেছি যে তারা প্রতিদিন কী ধরনের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই যন্ত্রণা ইসরায়েল ও যুক্তরাজ্যের মানুষের মর্মে আঘাত হানছে।”
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া ‘হামাসের জন্য কোনও পুরস্কার নয়’ মন্তব্য করে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতের এই রাষ্ট্রে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না।
ইসরায়েলের অভিযান বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “এই মৃত্যু এবং ধ্বংস আমাদের সবাইকে আতঙ্কিত করে। অবশ্যই এর অবসান হতে হবে।”
স্টারমার বলেন, “ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা শান্তিতে বসবাস করতে চায়। তারা সহিংসতা ও দুর্ভোগ থেকে মুক্ত হয়ে জীবন যাপন করছে, ব্রিটিশরা তাই দেখতে চায়।”
কানাডার স্বীকৃতি
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এক্স হ্যান্ডেলে এক পোস্টে বলেন, “কানাডা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে।”
কার্নি গত জুলাই মাসে বলেছিলেন যে তার দেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে চায়। তখন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা তার নিন্দা জানিয়েছিল।
তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার সমালোচনা করে বলেছিলেন, কানাডার এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেকোনো বাণিজ্য আলোচনায় বাধা হবে।
রবিবারের ঘোষণার কিছুক্ষণ আগে একজন কানাডীয় সরকারি কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, “ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সহিংসতা ত্যাগ করেছে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
“আমরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছি তাদের ক্ষমতায়ন করার জন্য, যারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চায় এবং হামাসকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিতে চায়।”
তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়ার জন্য করা হচ্ছে না।
অস্ট্রেলিয়ার স্বীকৃতি
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি দীর্ঘদিনের সমর্থন েথকে এই পদক্ষেপ।
বিবৃতিতে বলা হয়ে, “আজকের স্বীকৃতি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘদিনের সমর্থনের প্রতিফলন, যা ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার পথ।”
বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু চাওয়াও তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে রয়েছে- নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা; অর্থ, শাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার আনা; সরকারি কাজে হামাসকে না রাখা।
পর্তুগালের ঘোষণা
পর্তুগাল সরকারও জানিয়েছে, রবিবারই তারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেবে।
পর্তুগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো রাঙ্গেল এই সপ্তাহে যুক্তরাজ্য সফরের সময় বলেছিলেন যে তার দেশও একই পদক্ষেপ নেবে। তবে কোনও নির্দিষ্ট তারিখ বলেননি তিনি।
পর্তুগালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রবিবারই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতির আনুষ্ঠানকি ঘোষণা দেওয়া হবে।
পর্তুগালের প্রতিবেশী দেশ স্পেন এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে দেড় শতাধিক রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিেয়ছে। তবে ফিলিস্তিন এখনও জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হতে পারেনি।
২০১১ সালে আবেদন করলেও মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর হুমকিতে ফিলিস্তিনের জাতিসংঘ সদস্য হয়ে ওঠা এখনও হয়নি। তারা পর্যবেক্ষক সদস্য হয়ে রয়েছে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন, স্কাই নিউজ