যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পা ও হাতের কিছু অংশ সম্প্রতি ফুলে গেলে চিকিৎসকরা তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তাতে দেখা যায়, ট্রাম্প ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সি (সিভিআই) নামক এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদি রক্তনালীর সমস্যায় ভুগছেন।
ট্রাম্পর স্বাস্থ্যগত সমস্যার এই তথ্য বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে হোয়াইট হাউস।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট জানান, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার পায়ে হালকা অস্বস্তি অনুভব করছিলেন। এ কারণেই তার একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা এই নির্ণয়ে পৌঁছেছেন।
প্রেসিডেন্টের চিকিৎসক ড. শন বারবাবেলা একটি চিঠির মাধ্যমে জানান, ট্রাম্পের শরীরে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (গভীর শিরায় রক্ত জমাট) বা ধমনীসংক্রান্ত রোগের কোনও লক্ষণ পাওয়া যায়নি। তার সমস্ত ল্যাব পরীক্ষার ফলাফলও স্বাভাবিক সীমার মধ্যেই রয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ট্রাম্পের হৃদযন্ত্র পরীক্ষার জন্য একটি ইকোকার্ডিওগ্রাম করা হয়েছিল, যা থেকে দেখা গেছে তার হৃদপিণ্ডের গঠন ও কার্যক্ষমতা স্বাভাবিক রয়েছে।
ট্রাম্পের হাতে ফুলে থাকা নিয়ে কয়েকদিন ধরে সোশাল মিডিয়ায় জল্পনা চলছিল। এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, প্রেসিডেন্ট ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সিতে আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রেস সেক্রেটারি লেভিট জানান, প্রেসিডেন্টের হাতে দেখা যাওয়া আঘাতের দাগটি হ্যান্ডশেক বা করমর্দনের সময় ঘন ঘন চাপ পড়া ও অ্যাসপিরিন সেবনের কারণে হতে পারে। প্রেসিডেন্ট হৃদরোগ প্রতিরোধের প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির অংশ হিসেবে অ্যাসপিরিন নিচ্ছিলেন।
৭৯ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবারই নিজেকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান প্রেসিডেন্ট’ হিসাবে দেখিয়ে আসছেন। অবশ্য এখন তার শরীরে এক ধরনের শিরার রোগ ধরা পড়েছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে ব্যক্তিদের মধ্যে সাধারণভাবে দেখা যায়। ড. বারবাবেলার চিঠিতে এই রোগকে ‘নিরাপদ ও সাধারণ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
ক্যারোলিন লেভিট ও চিকিৎসক বারবাবেলা উভয়েই নিশ্চিত করেন, প্রেসিডেন্টের দেহে রক্ত জমাট বাঁধা বা ধমনী সমস্যার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, তার শরীরে হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা, কিডনির অকার্যকারিতা কিংবা সিস্টেমেটিক অসুস্থতাও নেই।
চিকিৎসক বারবাবেলা তার নোটে লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সামগ্রিক স্বাস্থ্য “চমৎকার” এবং তিনি এখনও কগনিটিভ ও শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন।
গত ১৩ জুলাই নিউ জার্সিতে অনুষ্ঠিত ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে তোলা ছবিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পা ফোলা বলে দেখা যায়। পরে হোয়াইট হাউসে বাহরাইনের প্রধানমন্ত্রী সালমান বিন হামাদ বিন ইসা আল খলিফার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তার হাতে আঘাতের চিহ্নও স্পষ্ট ছিল। এর আগেও ফেব্রুয়ারি মাসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে বৈঠকের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতে আঘাতের ছবি ভাইরাল হয়েছিল।
ওই ছবি দেখে অনেকেই সোশাল মিডিয়ায় ধারণা করেন, হয়তো প্রেসিডেন্ট কোনও গুরুতর অসুস্থতায় ভুগছেন যা প্রকাশ করা হয়নি। তবে হোয়াইট হাউস ও তার চিকিৎসক নিশ্চিত করেছেন, বিষয়টি গুরুতর নয়। প্রেসিডেন্ট এখনও সুস্থ ও কর্মক্ষম।
ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সি কী
ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সি (সিভিআই) তখনই হয় যখন পায়ের শিরাগুলো রক্তকে যথাযথভাবে হৃদপিণ্ডের দিকে ফেরত পাঠাতে পারে না। ফলে নিচের পায়ের অংশে, বিশেষ করে গোড়ালি ও পায়ের পাতায় রক্ত জমে যায়।
এই অবস্থায় পা ফুলে যাওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন: ভারী ভাব, ব্যথা, ঝিঝি ধরা কিংবা অস্বস্তিকর অনুভূতি। অনেকের ক্ষেত্রে উঁচু শিরা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর সমস্যা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছালে পায়ে ঘা বা আলসারও হতে পারে।
টেক্সাস ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. মেরিল লোগান বলেন, “পায়ের শিরা ও ভাল্ব রক্তকে উপরের দিকে ঠেলে হৃদপিণ্ডে পাঠানোর কাজ করে। কিন্তু এই ভাল্ব কাজ না করলে রক্ত উল্টো দিকেই নামতে শুরু করে। একে বলা হয় ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সি।”
তিনি আরও বলেন, “পা থেকে রক্তকে ওপরের দিকে তুলতে হলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। এ কারণে এই প্রক্রিয়াটি শারীরিকভাবে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।”
কী কারণে এই সমস্যা হয়
পায়ের রক্ত উপরের দিকে অর্থাৎ হৃদপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অতিক্রম করতে হয়। এটা শরীরের জন্য কঠিন কাজ। বিশেষ করে যখন কেউ দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে। পায়ের শিরাগুলোর ভেতরে একমুখী ভাল্ব থাকে। সেগুলো রক্তকে নিচে নেমে যেতে বাধা দেয়।
এই ভাল্বগুলোর ক্ষতি বা কার্যক্ষমতা নষ্ট হলে রক্ত ঠিকমতো ওপরে উঠতে পারে না। ফলে তখনই ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সি তৈরি হয়।
এই অবস্থার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন: অতীতে রক্ত জমাট বাঁধা, শিরায় প্রদাহ বা অতিরিক্ত ওজন। এসব কারণ শিরার ভাল্বগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
কীভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হয়
প্রথমেই চিকিৎসকরা চেষ্টা করেন আরও গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যাগুলো বাদ দিতে। যেমন হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা অথবা পায়ে রক্ত জমাট বাধার মতো কারণ। এরপর আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করে পায়ের শিরাগুলোর অবস্থা যাচাই করা হয়। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় রোগীর ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সি আছে কিনা।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক-এর মতে, এই রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে: কমপ্রেশন স্টকিংস পরা, যা পায়ের শিরায় চাপ দিয়ে রক্ত চলাচলে সহায়তা করে। পা উপরের দিকে তুলে রাখা, যাতে রক্ত নিচে জমে না থাকে। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, বিশেষ করে হাঁটা খুবই উপকারী। কারণ হাঁটার সময় পায়ের পেশিগুলো সংকুচিত হয় এবং তা শিরাগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ফলে রক্ত সহজে উপরের দিকে ওঠে। যেসব ক্ষেত্রে রোগ অনেকটা এগিয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসা ও ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা