যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার মধ্যেই পশ্চিমা দুনিয়ায় ফিলিস্তিনের পালে লেগেছে হাওয়া। ফ্রান্স, কানাডার পর যুক্তরাজ্যও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগে রবিবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এই ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে দিতে যাচ্ছেন বলে খবর প্রকাশ হয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যমে।
জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪৭টি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও ফিলিস্তিন এখনও বিশ্ব সংস্থাটির পূর্ণ সদস্য নয়।
২০১২ সাল থেকে পর্যবেক্ষক সদস্যের মর্যাদা নিয়ে আছে দেশটি। আর তার কারণ নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি।
১৯৩৩ সালের মন্টিভিডিও কনভেনশন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কয়েকটি মানদণ্ড রয়েছে।
একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন- একটি স্থায়ী জনসংখ্যা; একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড; একটি কার্যকর সরকার; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত এবং চুক্তিসহ আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালানোর সক্ষমতা।
নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতাধর রাশিয়া ও চীন, ইউরোপের এক ডজনেরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও স্বীকৃতি দিয়েছে ফিলিস্তিনকে।
জাতিসংঘ সদস্য কীভাবে হয়?
সাধারণত যেকোনো দেশ জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে সদস্য হওয়ার আবেদন করে। তিনি সেই আবেদন নিরাপত্তা পরিষদে প্রাথমিক মূল্যায়ন এবং ভোটের জন্য পাঠান।
১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে অনুমোদনের জন্য কমপক্ষে ৯টি ভোটের প্রয়োজন হয়। তবে শর্ত থাকে যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া বা চীনের ভেটো দেওয়া চলবে না।
যদি নিরাপত্তা পরিষদ আবেদনটি অনুমোদন করে, তবে তা সাধারণ পরিষদে অনুমোদনের জন্য যায়। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন পেলে আবেদনকারী জাতিসংঘের সদস্য হতে পারে।
নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদ উভয়ের সমর্থন ছাড়া কোনো রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য হতে পারে না।
ফিলিস্তিনের আবেদনে কী হয়েছিল?
ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা-পিএলওর প্রধান ইয়াসির আরাফাত ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে জেরুজালেমকে রাজধানী ধরে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। ওই বছরের মধ্যেই ৭৮টি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।
২০১১ সালে জাতিসংঘের সদস্য হতে আবেদন করে ফিলিস্তিন।
নিরাপত্তা পরিষদ কয়েক সপ্তাহ ধরে আবেদনটি পরীক্ষা করে দেখে যে এটি সদস্যপদের শর্ত পূরণ করে কি না?
তবে, তারা একটি সর্বসম্মত অবস্থানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় কোনো ভোট হয়নি।
তবে যদি এই ধাপটি পার করে যেতও, তাতেও লাভ হতো না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র আবেদনটিতে ভেটো দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
ফলে ফিলিস্তিন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা নিয়েই আছে এখনও।
যুক্তরাজ্য এখন কেন স্বীকৃতি দিচ্ছে?
নানা ধাপ পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-বামপন্থী লেবার সরকার ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলছেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার এটাই সঠিক সময়, কারণ এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
দ্বি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে ফিলিস্তিন সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান আশা করছে যুক্তরাজ্য। সেখানে একটি স্টারমার বলেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের আগে থেকেই ছিল। একটি ৮ দফা পরিকল্পনার অংশ এটি এবং তা নিয়ে ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গেও তার আলোচনা হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের অভিযানকে ‘ভয়াবহ’ আখ্যায়িত করে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এর আগে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ওপর জোর দিয়ে জাতিসংঘের একটি শীর্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “জিম্মিদের (হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলিরা) মুক্তি এবং ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের সময় এসেছে।”
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে জোর দেন।
দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান কী?
মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট নিরসনে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান একটি জনপ্রিয় ধারণা। এর মানে হচ্ছে ওই ভূখণ্ডে ইসরায়েলের পাশে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র থাকবে। ইহুদি বসতি নিয়ে থাকবে ইসরায়েল রাষ্ট্র; পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা মিলে হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র।
ফিলিস্তিনিরা যে ভূখণ্ড নিয়ে রাষ্ট্র চায়, তার বেশিরভাগ দখল করে রেখেছে ইসরায়েল। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে সেখানে ইসরায়েলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসরায়েল সরকার এবং দেশটির বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্বে বিরোধিতা করে।
১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে মতৈক্য হয় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে। ওই চুক্তির আওতায় ইসরায়েল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে স্বীকৃতি দেয় এবং পিএলও স্বীকৃতি দেয় ইসলায়েলকে।
কিন্তু এই দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে ঠেকে সম্ভাব্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমানা। এক পক্ষ মনে করে, এই সীমানা হবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগের পর্যায়ের মতো। কিন্তু তারপর থেকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বেড়েছে এবং বর্তমানে ৬ লাখের মতো ইসরায়েলি সেখানে এবং অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে বসবাস করছে।
ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন পরে কট্টর ইহুদিদের গুলিতে নিহত হন।
ইসরায়েলের পরের সরকারগুলো আর এই চুক্তি নিয়ে এগোয়নি। অন্যদিকে পরে ফিলিস্তিনে ক্ষমতায় আসা হামাসও ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসাবে মানতে নারাজ।
এখন ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া কী?
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার নিন্দা জানাচ্ছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
তিনি বলছেন, এখন ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মানে ‘ইসরায়েলকে নির্মূল করার একটি মঞ্চ’ তৈরি করা। এটা হামাসকে পুরস্কৃত করার শামিল, এতে জিম্মিদের মুক্তির পথ ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস স্বীকৃতির জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কী প্রতিক্রিয়া?
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে যুক্তরাজ্য- স্টারমার এই ঘোষণা দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, এটা হামাসকে ‘পুরস্কৃত’ করবে।
তিনি বলেন, “যদি আপনারা এটা করেন, তাহলে আপনারা হামাসকে পুরস্কৃত করছেন। আমি মনে করি না, তাদের পুরস্কৃত করা উচিৎ।”
ফ্রান্স এমন ঘোষণা দেওয়ার পর ট্রাম্প বলেছিলেন, ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যা বলেন, তা কোনও কাজের কথাই নয়।
কানাডা এই েঘাষণা দেওয়ার পর ট্রাম্প এক প্রকার হুমকিই দিয়েছিলেন।
তিনি ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে লিখেছিলেন, “আমাদের পক্ষে তাদের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করা খুব কঠিন হয়ে উঠল। ওহ কানাডা!!!”
যুক্তরাষ্ট্রের কথা অনুসরণ করে জাপান আপাতত ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জার্মানি বলেছে, তারা দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে হলেও এখনই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
তথ্যসূত্র : স্কাই নিউজ, আল জাজিরা