Beta
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫

আজ যদি যুক্তরাষ্ট্র সরে যায় পেছন থেকে, কাল কী হবে ইসরায়েলের

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি সমর্থন বজায় রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি সমর্থন বজায় রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
[publishpress_authors_box]

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনই আদায় করে নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন মাঝেমধ্যে গাজা সঙ্কট নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি প্রকাশ করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এখনও দ্বিধাহীন চিত্তেই ইসরায়েলের পাশে রয়েছে। এমনকি ট্রাম্প গাজার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে উৎখাতের পরিকল্পনাও নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ইসরায়েলের যুদ্ধান্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ইসরায়েলকে গাজায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করতে সহায়তা করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বারবারই আটকে দেয়। এই কূটনৈতিক সমর্থনের ফাঁকে গাজায় মৃতের মিছিল ক্রমাগত বাড়ছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে, যেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। একই সঙ্গে তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সেই সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন।

গাজায় ইসরায়েলের অভিযানকে অনেক রাষ্ট্র এবং সংস্থা গণহত্যা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার সমালোচনা করছে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোও।

ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করতে ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান আসছে। কিন্তু যদি তা-ই হয়? যদি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি সমস্ত সমর্থন বন্ধ করে দেয়, তাহলে কী ঘটবে?

এর উত্তর খুঁজতে আল জাজিরা কথা বলেছে চারজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজে আত্তার; ইসরায়েলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওরি গোল্ডবার্গ; রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট এবং সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস’র সিনিয়র ফেলো এইচ এ হেলিয়ার এবং ইসরায়েল সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড্যানিয়েল লেভি দিয়েছেন সেই উত্তর।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কী ঘটবে?

“আমার মনে হয়, অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্র, যারা প্রথমদিকে ইসরায়েলকে সমর্থন করেছিল, তারা এখন নিজেদের হতাশ মনে করছে এবং ইসরায়েলের পতন দেখতে চাইছে। অনেকের জন্য, এমনকি জার্মানির জন্যও, যুদ্ধ-পরবর্তী যে গাঁটছাড়া তাদের ইসরায়েলের সঙ্গে ছিল, তা এখন এতটাই শিথিল হয়ে গেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া সম্ভবত তা আর টিকবে না।”

এমন মত ওরি গোল্ডবার্গের। তিনি আরও বলেন, “[যদি আগামীকাল ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র বন্ধ করে দেয়], তাহলে আমার ধারণা তারা [বিভিন্ন দেশ] সবাই অবিলম্বে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে, যদিও কেউ প্রথমে পদক্ষেপ নিতে চাইবে না।”

তিনি বলেন, “আমি জানি না সেই পদক্ষেপ কেমন হবে, তা নিষেধাজ্ঞা হতে পারে, অথবা এমনকি জাতিসংঘের সনদের অধ্যায় ৭-এর প্রয়োগ [যা জরুরি হস্তক্ষেপের অনুমোদন দেয়] হতে পারে, তবে তা দ্রুতই ঘটবে।”

আঞ্চলিকভাবে কী ঘটবে? ইসরায়েল কি আক্রান্ত হবে?

“আমি মনে করি, যদি আপনি হঠাৎ করে সমীকরণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দেন, তাহলে আপনি সেখানে কোনও ধরনের মীমাংসার পথে সবচেয়ে বড় একক বাধাটিকে সরিয়ে দেবেন।”

এমন মন্তব্য করেছেন হেলিয়ার। তিনি বলেন, “ইসরায়েলের পক্ষে এই অঞ্চলে সত্যিকারের সংহতি স্থাপন করা সবসময় দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের অগ্রাধিকার হবে, কারণ মার্কিন সমর্থন তাদের দায়মুক্ত থেকে কাজ করার ক্ষমতা দেয়।”

ইসরায়েল বরাবরই দাবি করে আসছে, সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যই তাদের সব পদক্ষেপ।

হেলিয়ার বলেন, “তা সত্যি নয় এবং অনেকেই বলবেন যে দশকের পর দশক ধরে বলা হলেও তা সত্যি ছিল না। সিরীয় সেনাবাহিনী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে ইসরায়েলের উপর পাল্টা আক্রমণ থেকে বিরত থাকছে না। তারা আক্রমণ থেকে বিরত থাকছে কারণ তারা আরও যুদ্ধ চায় না, তারা জানে যে তারা বিশাল প্রতিরোধের মুখে পড়বে; অন্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।”

আর্থিকভাবে কী ঘটবে?

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া ইসরায়েল আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও একেবারে ভেঙে পড়বে না বলে মনে করেন ওরি গোল্ডবার্গ।

তিনি বলেন, “ইসরায়েল আর্থিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের উপর খুব নির্ভরশীল, তবে এটি পুরোপুরি ভেঙে পড়বে না। ইসরায়েল হাই-টেক অস্ত্র খাতের উপর নির্ভরশীল, যার বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা এবং প্রায় সীমাহীন প্রযুক্তি সহায়তায়।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোচের ভূমিকায়, অর্থাৎ যিনি তোয়ালে নিয়ে মাঠের কোনায় থাকেন, খেলোয়াড়ের ভূমিকায় নয়।

“আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রাতারাতি চলে গেলে পরিস্থিতি কঠিন হবে, কিন্তু এটি অবিলম্বে হবে না, যতক্ষণ না আমরা বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোতে ব্যাপক ছাঁটাই এবং সামরিক বাহিনীর পতন দেখতে পাই।”

ইসরায়েলের রাজনীতিতে কী ঘটবে?

এই প্রশ্নে গোল্ডবার্গের উত্তর আসে, “আপনি যতটা ভাবছেন, ততটা হবে না। ইসরায়েলের বসতি স্থাপনকারীরা ইতোমধ্যেই নিজেদের অবস্থানে খুব দৃঢ়। যাই ঘটুক না কেন, তারা তাদের ‘ঈশ্বরের দেওয়া মিশন’ হিসাবে যা দেখে, তা চালিয়ে যাবে।

“নেতানিয়াহু সম্ভবত টিকে যাবেন। তিনি কোনও জাদুকর নন। তার বলা এবং করা বেশিরভাগ কাজই ইসরায়েলি সমাজের একটি অংশের চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন।”

ড্যানিয়েল লেভি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ইসরায়েলের ডানপন্থি দলগুলোর প্রতি স্পষ্ট। তা ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় থাকলেও, আবার রিপাবলিকানরা থাকলেও।

“এর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দেয়। তার বলে তারা গাজায় একটি গণহত্যা চালাতে পারে বা বসতি স্থাপনকারীদের উৎসাহিত করতে পারে কোনও সুস্পষ্ট জবাবদিহি ছাড়াই।”

“অন্য যেকোনো সমাজে এই বিষয়টি অন্যান্য রাষ্ট্র বা তাদের নিজস্ব সমাজের নৈতিক নীতিবোধ থেকে আসত। আমাদের এখানে এর কোনোটিই আছে বলে মনে হয় না,” বলেন লেভি।

এর সামরিক বাহিনীর কী হবে?

হামজে আত্তার এর উত্তর দিয়েছেন এভাবে- “যদি আগামীকাল যুক্তরাষ্ট্র উধাও হয়ে যায়, তাহলে ইসরায়েল সম্ভবত প্রায় এক বছর ধরে গাজায় তার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু এর অগ্রাধিকারগুলো পরিবর্তিত হবে, কারণ তারা বেশ দুর্বল হয়ে পড়বে।

“যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েল যে বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটগুলোর ওপর নির্ভর করে তার ভূখণ্ডকে গোপন রাখার জন্য, তা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে এর শত্রুরা তাৎক্ষণিকভাবে এর ভূখণ্ডের ভেতর দেখতে পাবে। এছাড়া তারা আয়রন ডোম এবং অ্যারো সিস্টেমের মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হারাবে, যা আংশিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা অর্থায়ন করা হয়, ফলে এটি আক্রমণের জন্য আরও উন্মুক্ত হয়ে যাবে।”

তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি মানে ইসরায়েলকে অন্যান্য সামরিক সরবরাহকারী খুঁজতে হবে, সম্ভবত ইউরোপের ন্যাটো দেশগুলো থেকে। তবে, ইউরোপের কাছে এখন অস্ত্রের ঘাটতি রয়েছে, তাই এটি দ্রুত ঘটবে না।

“ইউরোপ যে কোনো অস্ত্রের জন্য ইসরায়েলের কাছ থেকে দাম নেবে, যা বর্তমান সামরিক সহায়তা কর্মসূচির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র নেয় না। সুতরাং, অন্য কোনও দেশ এগিয়ে এলেও ইসরায়েল বড় আকারে অস্ত্র কেনার সামর্থ্য রাখবে না।”

গাজা ও পশ্চিম তীরে কী ঘটবে?

“আমার মনে হয় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন বুঝতে পারবে কী ঘটছে, তখন তারা অবিলম্বে যুদ্ধ শেষ করার আহ্বান জানাবে,” বলছেন ওরি গোল্ডবার্গ।

তিনি বলেন, “আমি মনে করি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সেনাবাহিনী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারবে যে তাদের কাছে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো অস্ত্র বা টাকা নেই।”

ড্যানিয়েল লেভি বলেন, “এর পরে অন্যান্য রাষ্ট্র, আঞ্চলিক এবং পশ্চিমা উভয় ক্ষেত্রেই কী করে তার উপর নির্ভর করে, যুদ্ধ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।

“আমার ধারণা, তারা গাজা এবং পশ্চিম তীরে নিজেদের সময় কেনার জন্য একটি প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেবে। আন্তর্জাতিক জনমতে ইসরায়েলের সুনাম এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, কিন্তু মার্কিন সমর্থন এটিকে প্রকৃত আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা করেছে।”

“মূলত, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হবে, যেমনটি বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে হয়েছিল। বর্ণবাদী নেতৃত্বও অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তাদের পরিবর্তন করতে হবে, কারণ তারা বিশেষভাবে ভালো মানুষ ছিল বলে নয়, বরং তারা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছিল যেখানে তাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না এবং তারা যা কিছু বাঁচাতে পারে তা রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,” অনেকটা উপসংহার টানেন হেলিয়ার।

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত