Beta
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫

বিলিয়নেয়াররা কেন লন্ডন ছাড়ছেন

Ultra
[publishpress_authors_box]

লেবার পার্টি গত গ্রীষ্মে ক্ষমতায় যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ উদ্যোক্তা চার্লি মালিনস দেশ ছেড়ে চলে যান। প্লাম্বিং ব্যবসায় সফল হয়ে তিনি বিপুল অর্থ উপার্জন করেছিলেন। 

চার্লি মালিনস এখন স্পেন ও দুবাইয়ে ভাগ করে সময় কাটাচ্ছেন। তার দৃষ্টিতে, “ব্রিটেন এখন আর ব্যবসা করার জন্য ভালো জায়গা নয়।”

৭২ বছর বয়সী মালিনস দেখতে কিছুটা গায়ক রড স্টুয়ার্টের মতো। তিনি ধনী ও পরিচিত কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিকের একজন, যারা ব্রিটেন ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন বা ইতোমধ্যেই চলে গেছেন।

তাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে সাম্প্রতিক কর সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে ধনীদের গমনাগমন পর্যবেক্ষণকারীরা জানিয়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে লন্ডন ছিল বিশ্বের ধনীদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য। এখানে একদিকে রুশ অলিগার্ক ও নির্বাসিত নেতারা, অন্যদিকে হেজ ফান্ড পরিচালনাকারী এবং ব্রিটিশ ধনীরা পাশাপাশি বসবাস করে আসছেন। এই শহরে পুরোনো অর্থ সম্পদের সঙ্গে নতুন অর্থ সম্পদের সংমিশ্রণও ঘটে।

লন্ডনের আইনি ও পেশাগত সেবা, সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি, উচ্চমানের রিয়েল এস্টেট এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসার ভাষা হিসেবে ইংরেজির অবস্থানের কারণে বিশ্বের উচ্চবিত্তরা এই শহরে ভিড় জমান।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যা থেকে বোঝা যাচ্ছে—অনেক ধনী ব্যক্তি ব্রিটেন ছেড়ে স্পেন, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে চলে যাচ্ছেন।

এসব দেশে করের হার কম অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে ধনীরা তাদের বৈশ্বিক আয়ের ওপর করমুক্ত থাকতে পারেন। এই প্রবণতা নিয়ে কেউ কেউ উদ্বিগ্ন হলেও, অন্য কেউ কেউ এটিকে স্বস্তির বিষয় হিসাবেও দেখছেন।

ব্রিটেন ছাড়ার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে রয়েছেন মিশরীয় ধনকুবের ও অ্যাস্টন ভিলা ফুটবল ক্লাবের অন্যতম মালিক নাসেফ সাওয়ারিস। তিনি ফিনান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, “আমার পরিচিত কারও কথা জানি না, যিনি এই এপ্রিল কিংবা আগামী এপ্রিল (যদি তাদের সন্তানের স্কুলের বিষয় থাকে) ব্রিটেন ছেড়ে যাচ্ছে না।”

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আবাসিক ও হলিডে পার্ক পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আলফি বেস্ট। তিনি ব্রিটেনের কর ও নিয়ন্ত্রক জটিলতাকে ‘অত্যাচার’ বলে উল্লেখ করে মোনাকো চলে গেছেন।

সানডে টাইমস পত্রিকার রিচ লিস্ট তৈরি করেন রবার্ট ওয়াটস। তার মতে, লন্ডনের ‘বিলিয়নেয়ারের যুগ শেষ’। রবার্টের তৈরি করা তালিকায় যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে ধনী ৩৫০ জন ব্যক্তির সম্পদের তথ্য থাকে। ওয়াটস গত এক দশক ধরে ধনীদের ওপর পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছেন। 

তিনি বলেন, ধনীরা খুব একটা ক্ষুব্ধ না হলেও ক্লান্ত বোধ করছেন। তারা ভাবছেন, এখানে সফল ব্যবসা শুরু করা, গড়ে তোলা ও বড় করার পরিবেশ অনুকূল নয়।

সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্রিটেনের বর্তমান লেবার সরকার সম্প্রতি শতাব্দীপ্রাচীন এক কর নীতি বাতিল করেছে। এই নীতির আওতায় বিদেশি বাসিন্দারা—যাদের ‘নন-ডম’ বলা হয়—তাদের বৈদেশিক আয় ব্রিটেনে করমুক্ত রাখতে পারতেন। 

তবে এই পরিবর্তনের ঘোষণা প্রথমে কনজারভেটিভ সরকার দিয়েছিল। ক্ষমতায় এসে লেবার সরকার সেটি কার্যকর করেছে এবং এপ্রিল মাসে এই কর ফাঁকি বন্ধ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন সরকার আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বৈশ্বিক সম্পদের ওপর উত্তরাধিকার কর ছাড়ও বাতিল করেছে। ব্রিটেনে উত্তরাধিকার করের সর্বোচ্চ হার ৪০ শতাংশ। এটি বিশ্বের অন্যতম উচ্চ হার। তবে নানা রকম ছাড়ের কারণে বেশিরভাগ সম্পত্তির ক্ষেত্রেই এই হার কম পড়ে।

এই কর সংস্কার থেকে আগামী পাঁচ বছরে সরকারের ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন পাউন্ড রাজস্ব আয়ের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। সরকার বলছে, এই অর্থ দিয়ে দেশের সবসময় আর্থিক সংকটে থাকা স্কুল, হাসপাতাল ও ডেন্টাল ক্লিনিকগুলোর ব্যয় নির্বাহ করা হবে।

তবে সমালোচকরা বলছেন, এই পরিবর্তন ‘নিজের গোলে বল’ করার মতো হতে পারে, যেমনটা ফুটবলে হয়।

ইনস্টিটিউট ফর ফিস্কাল স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের শীর্ষ ১ শতাংশ আয়করদাতা মোট কর আয়ের ২৯ শতাংশ দিয়ে থাকেন। যদি এই শ্রেণির করদাতাদের বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সরকারের রাজস্ব কমে যেতে পারে।

সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ নামক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসাব করেছে, যদি মাত্র এক-চতুর্থাংশ ‘নন-ডম’ দেশ ছেড়ে যায়, তাহলে এই সংস্কার থেকে আসা লাভ শূন্য হয়ে যাবে। আর যদি অর্ধেক চলে যায়, তাহলে রাজকোষের ক্ষতি হবে ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ড।

উদ্যোক্তা চার্লি মালিনস বলেন, তিনি ব্রিটিশ ট্যাক্স দপ্তরের জন্য যথেষ্ট অবদান রেখেছেন এবং এখন দুবাইয়ে নতুন একটি প্লাম্বিং ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবছেন। 

তিনি বলেন, “আমি ৫৫ বছরের কর্মজীবনে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি পাউন্ড কর দিয়েছি। আমি কর দিতে আপত্তি করছি না। তবে এখন ক্যাপিটাল গেইন, উত্তরাধিকার করসহ সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, সরকার ভুল মানুষদের শাস্তি দিচ্ছে, উৎসাহ দেওয়ার বদলে।”

“নন-ডম”দের মধ্যে কতজন ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য যুক্তরাজ্যের রাজস্ব দপ্তর আগামী বছর প্রকাশ করবে। তবে ইতোমধ্যেই নানা ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে।

বৈশ্বিক রিয়েল এস্টেট কনসালটেন্সি অ্যান্ট এস্টেট এজেন্সি নাইট ফ্র্যাঙ্কের ‘সুপার প্রাইম’ সম্পত্তি বিক্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টুয়ার্ট বেইলি জানান, ‘নন-ডম’ কর পরিবর্তনের প্রস্তাব আসার পর ধনী বিক্রেতাদের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। এটি ব্যাপক না হলেও স্পষ্ট একটি প্রবণতা বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি পাউন্ড মূল্যের বাড়ির বাজার সম্পূর্ণরূপে ক্রেতাদের অনুকূলে রয়েছে।

তিনি যোগ করেন, “নাইটসব্রিজ বা বেলগ্রেভিয়ার মতো অভিজাত এলাকায় সাধারণ ধাঁচের একটি বাড়ি পেতে এখন অনেক বিকল্প রয়েছে।”

একই সময়ে নতুন ক্রেতারাও বাজারে আগমন করছেন। তাদের মধ্যে আমেরিকানদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত এক বছরে ৬ হাজার ৬১৮ জন আমেরিকান ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বা বসবাসের অনুমতির জন্য আবেদন করেছেন, যা একটি রেকর্ড সংখ্যা। শুধু জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২৫-এর মধ্যেই আবেদন করেছেন ১ হাজার ৯০০ জনের বেশি আমেরিকান—যা কোনও একক ত্রৈমাসিকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

স্টুয়ার্ট বেইলি বলেন, ধনী আমেরিকানদের ব্রিটেনে আসার এই ধারা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলের আগেই শুরু হয়েছিল, যখন মুদ্রা বিনিময়ের হার তাদের পক্ষে ছিল।

লন্ডনভিত্তিক আইনজীবী ক্লেয়ার মরিস বিশ্বজুড়ে ক্লায়েন্টদের কর ও ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন—কর পরিবর্তন, বিশেষ করে উত্তরাধিকার কর নিয়ে উদ্বেগের কারণে ‘একটি বড় সংখ্যক মানুষ’ দেশ ছেড়ে গেছেন। 

তিনি আরও বলেন, “যারা ব্রিটেনে আসার কথা ভাবছিলেন, তাদের কতজন এই পরিস্থিতিতে মত পরিবর্তন করেছেন, তা আমরা কখনোই জানতে পারব না।”

তবে সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। অনেকে এই ধনীদের বিদায়কে দুঃখজনক বলে মনে করছেন না। 

লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় ক্যাটলিন মোরান একটি প্রবন্ধ লিখেছেন: “সুপার ধনীরা বলছে তারা ব্রিটেন ছেড়ে যাচ্ছে। আমি দুঃখিত নই।” সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, লন্ডনের অভ্যন্তরীণ কিছু এলাকায় এক ধরনের অদ্ভুত নির্জনতা বিরাজ করছে। তিনি লেখেন, “সব ধনী লোক খারাপ না হলেও, অধিকাংশ সময় তারা খারাপ প্রতিবেশী হয়।”

ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকের অর্থনীতিবিদ অরুণ আদভানি মনে করিয়ে দেন ২০১৭ সালের একটি ঘটনার কথা। সেবার অতি ধনীদের লক্ষ্য করে করা নতুন কর নীতির ফলে ৫ শতাংশ ‘নন-ডম’ দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি ৯৫ শতাংশ থেকে গিয়েছিলেন এবং আগের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি কর দিয়েছিলেন।

তবে এবার তিনি মনে করছেন, আরও বেশি মানুষ দেশ ছাড়বেন। কারণ এবার কর পরিবর্তন আরও বড় আকারে হয়েছে। যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশ ছেড়েছেন, তারা নতুন উত্তরাধিকার কর সংস্কার থেকে বাঁচতে পেরেছেন।

আদভানির মতে, যদি কেউ দেশ ছাড়ার চিন্তা করেই থাকেন, তাহলে এখনই চলে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।

তবুও তিনি বলেন, কারও দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তে জীবনযাত্রার বিষয়টিও বড় ভূমিকা রাখে। যাদের সন্তানরা প্রাইভেট স্কুলে পড়ে, তারা সাধারণত দেশ বদল করতে চায় না। বরং যারা ইতোমধ্যে স্পেনে একটি ভিলায় অবসর জীবনযাপন করছেন, তাদের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ।

আদভানি আশা করছেন, সব মিলিয়ে এই কর সংস্কারের ফলে সরকারের রাজস্বের ওপর ইতিবাচক প্রভাবই পড়বে।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের রাজনীতি বিশ্লেষক টনি ট্র্যাভার্স বলেন, এই তথাকথিত ‘ধনীদের দেশত্যাগ’ একটি বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ। এটি আসলে এক ধরনের প্রক্রিয়া, যেখানে কিছু অতি ধনী ব্যক্তি উচ্চ করের দেশ থেকে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু অনেকে আবার থেকে যাচ্ছেন, কারণ তারা মনে করছেন ব্রিটেনে থাকা সুবিধাগুলো অন্য দেশের কম করের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, “যদি সত্যিই তারা চাইতেন, তাহলে ম্যানহাটনের এলিগ্যান্ট টাউনহাউস বা নাইটসব্রিজের বাড়ির মালিকরা বহু বছর আগেই বাহামায় চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তারা থেকে গেছেন।”

অন্যদিকে সানডে টাইমস রিচ লিস্ট গত তিন বছর ধরে ব্রিটেনের ধনীদের নিট সম্পদ কমে যাওয়ার তথ্য দিচ্ছে। ২০২৫ সালের তালিকায় ১৫৬ জন বিলিয়নিয়ার রয়েছে, যেখানে গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১৬৫। এটি রিচ লিস্টের ৩৭ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পতন।

রিচ লিস্ট প্রস্তুতকারী রবার্ট ওয়াটস মনে করেন, এই পতনের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ধারাবাহিক সরকারের নীতিগত পরিবর্তন, সুদের হারের ওঠানামা এবং অন্য করবান্ধব দেশের প্রতি আকর্ষণ। 

তিনি বলেন, বিশেষ করে বয়স্ক ধনীরা উদ্বিগ্ন যে, মৃত্যুর পর তাদের বিদেশি কোম্পানিগুলো হঠাৎ করে ব্রিটিশ উত্তরাধিকার করের আওতায় পড়ে যাবে। তাদের অনেকে মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়ে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও বিকল্প নেই।

তিনি ভবিষ্যতের প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমাদের অনেকেরই ধনকুবেরদের নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে, তবে আমি মনে করি—যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন, তাদের দেশত্যাগ নিয়ে যদি আমরা অবহেলা করি, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত