দেখে বোঝার উপায় নেই আঁখি মনি শারীরিক প্রতিবন্ধী টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। প্রথম দেখায় মনে হবে একদম সুস্থ স্বাভাবিক তরুণী। পল্টন শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ ইনডোরে বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে জাতীয় প্যারা টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ। সেখানে অংশ নিচ্ছেন আঁখি মনি।
প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ শেষ হতেই হুইল চেয়ার থেকে নেমে সাধারণ চেয়ারে বসে সতীর্থদের খেলা দেখছিলেন আঁখি। ওই অবস্থায় তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে।
অথচ ২০২২ সালে বাস দুর্ঘটনায় মেরুদন্ড ভেঙে যায় আঁখির। এরপর ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। চিকিৎসকেরা বলেছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে। কিন্তু টাকার অভাবে থেরাপিও নিতে পারেননি।
এর কিছুদিন পর আঁখির স্থায়ী ঠিকানা হয় সাভার পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি)। সেখান থেকেই এবার অংশ নিচ্ছেন জাতীয় প্যারা টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে।
দুই দিনের এই প্রতিযোগিতায় প্রথম রাউন্ডে জিতেছেন আঁখি। শুধু টেবিল টেনিস নয় নিয়মিত প্যারা আর্চারি ও প্যারা বাস্কেটবলে অংশ নেন আঁখি।
দুঃখে ভরা আঁখির জীবনে সত্যিকারের আনন্দ এনে দেয় খেলাধুলা। যখন খেলায় জেতেন তখন যেন সব কষ্ট ভুলে যান ভোলার চরফ্যাশনের তরুণী।
সাধারণত পরিবারের কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে পরিবারের সদস্যরা তার পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু আঁখির বেলায় হয়েছে উল্টো। বাবা মা কেউই তার খোঁজ রাখেন না। এমন দাবি করে কান্নায় ভেঙে পড়েন আঁখি। ইনডোরের এক পাশে বসে তিনি বলেন, “দুর্ঘটনার পর থেকে আমার পাশে কেউ নেই। আমার সঙ্গে পরিবারের কেউ যোগাযোগ করে না। আমি কি বেঁচে আছি না মরে গেছি কেউ খোঁজ নেয় না। বাবাকে ফোন দিলে ফোন ধরেন না। তবে মায়ের সঙ্গে কথা হয় মাঝে মধ্যে। আমি বাড়িতে গেলে মা-বাবা অপেক্ষায় থাকেন কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো। দুর্ঘটনার পর বাড়ির সঙ্গে বেশি দূরত্ব হয়ে গেছে।”
এরপর যোগ করেন, “আমাকে পরিবার বোঝা মনে করে। আমি একজন পক্ষাঘাতগ্রস্থ। কিন্তু আমি কারও বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। খেলাধুলা করে দেশের সম্পদ হতে চাই।”
সিআরপিতে থেকে আঁখিকে দেওয়া হয়েছে একটা সেলাই মেশিন। সেই সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করে অর্থ উপার্জন করেন তিনি। এটা দিয়ে নিজের হাত খরচ চালান।
খেলার ভেতরে জীবনের সব আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেন আঁখি, “অনেক সময় খুব কষ্ট লাগে । তখন খেলাধুলায় মনোযোগি হই।”
প্যারা অলিম্পিক গেমসে খেলার স্বপ্ন আঁখির, “ স্যারদের উৎসাহ পেলে এবং সঠিক ট্রেনিং পেলে আমরাও প্যারা অলিম্পিকে খেলতে পারব।” আর্চারি থেকে সরাসরি প্যারা অলিম্পিকে সুযোগ পান ঝুমা আক্তার। আঁখিও স্বপ্ন দেখেন টেবিল টেনিসে প্যারা অলিম্পিকে খেলার, “ঝুমা ও আমি এক সঙ্গে আর্চারি খেলেছি। সে পারলে আমিও পারব।”
একক, দ্বৈত ও দলগত এই তিনটি ইভেন্টে এবারের জাতীয় প্যারা টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিচ্ছেন শতাধিক শারীরিক প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়।
শহীদ তাজ উদ্দিন আহমেদ ইনডোর স্টেডিয়ামে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে দুদিন ব্যাপী প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ার সাবেক তাকরা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও ফেডারেশনের সাবেক সাধারন সম্পাদক এবং ক্রীড়াঙ্গণ সংস্কারে গঠিত বিদায়ী সার্চ কমিটির আহ্বায়ক জোবায়েদুর রহমান রানা। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক তারকা হকি খেলোয়াড় ও সার্চ কমিটির অন্যতম সদস্য মেজর (অব.) ইমরোজ আহমেদ। উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল প্যারালিম্পিক কমিটি অব বাংলাদেশের সাধারন সম্পাদক ড. মারুফ হাসান মৃদুল ও যুগ্ম সম্পাদক সানোয়ার হোসেন।
প্রধান অতিথির বক্তৃায় জোবায়েদুর রহমান রানা বলেন, “আমি খেলা ছেড়েছি ১৯৯০ সালে। সেই হিসাবে ক্রীড়াঙ্গণের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪০ বছর ধরে। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের এমন খেলাতে আসতে পেরে আমি আনন্দিত। আমি আশাকরি সরকারী সুযোগ সুবিধা পেলে এই ক্রীড়াবিদরা আন্তর্জাতিক অঙ্গণ থেকে দেশের জন্য পদক নিয়ে আসতে পারবে। তবে এ জন্য তাদের সকল রকম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।”
মেজর (অব.) ইমরোজ বলেন, “ক্রীড়াঙ্গণ সংস্কারের জন্য এই সরকার অনেক কাজ করছে। সার্চ কমিটির একজন সদস্য হিসাবে বলতে পারি, আমরা ৮০ ভাগ কাজ শেষ করেছিলাম। কিন্তু বাকি ২০ ভাগ কাজ শেষ করতে পারিনি। আমি আশাকরবো, আমাদের অসমাপ্ত কাজ এই সরকার শেষ করবে।”