“প্রতিটি বিষয়ের যেমন শুরু আছে ঠিক তেমনি একটা শেষ থাকাও প্রয়োজন। একটা সুন্দর সমাপ্তি যেকোনো বিষয়কেই করে তোলে আরও সুন্দর। তাই কথায় আছে শেষ ভালো যার সব ভালো তার। কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া একটা আন্দোলন আজকে এই দেশের সামগ্রিক পট পরিবর্তন করে দিয়েছে। এমন কিছু এর আগে তো হয় নি!! রাজপথে অনেককেই বলতে শুনলাম- আজ আমরা স্বাধীন! কিন্তু প্রশ্নটা এখনও রয়েই যায়, আমরা এই স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারব তো?”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী সরকার পতনের পরপরই গত ৫ আগস্ট বিকালে ফেইসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে এই প্রশ্ন তুলেছিলেন তাজবির হোসেন শিহান। কিন্তু দুর্বৃত্তের ছুরিতে এখন সব প্রশ্নের উর্ধ্বে চলে গেছেন এই তরুণ। গত ১২ ডিসেম্বর ভোরে তিনি প্রাণ হারান।
শিহান গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক জামতলা এলাকার তানভির হোসেন নান্নু মিয়ার ছেলে। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি।
জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় শিহানকে পরিকল্পিতভাবে চোরাগোপ্তা হামলায় খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। গত ১৫ ডিসেম্বর ক্যাম্পাসের সামনে তারা বিক্ষোভ করে। তাদের সন্দেহ, ক্ষমতাচ্যুতদের দোসররাই এই খুন করেছে। এনিয়ে সোশাল মিডিয়ায়ও আলোচনার ঝড় বইছে।
কিন্তু পুলিশ বলছে, শিহান হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল ছিনতাইকারী। ছয়জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
শিহানের মতো আরও কয়েকজন সম্প্রতি ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে। সেগুলো নিয়েও সন্দেহ ডালপালা মেলছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভিযোগের কারণে; যদিও পুলিশ সেই অভিযোগের ভিত্তি পাচ্ছে না।
শিহান খুনে গ্রেপ্তার ৬ ছিনতাইকারী
শিহানের স্কুলজীবনের বন্ধু হোসাইন কবীর; তারা বাসাও মৌচাকের জামতলা এলাকায়। স্কুলের পর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ভিন্ন হলেও প্রতিদিনই যোগাযোগ হতো তাদের।
গত ১২ ডিসেম্বর গাজীপুরের মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির কাছেই শিহান নিহত হন। মৃত্যুর খবর পেয়ে সেদিন সকাল ৯টায় সেই খবর পান কবীর।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছবি দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু পরে রক্তপাত দেখে মানুষজন সেটা ছুরিকাঘাত বলে জানায়। শিহান খুব প্রতিবাদী ছিল। ছিনতাইকারীরা জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার সময় শিহান বাধা দিয়েছিল বলে আমার ধারণা।”
শিহান উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। প্রথমে সিএসই বিভাগে ভর্তি হলেও পড়ে বিভাগ বদলে ইংলিশে পড়াশোনা করেন তিনি। এরপর উত্তরায় একটি কল সেন্টারে চাকরি নেন তিনি।
শিহানের কিংবা তার পরিবারের সঙ্গে কারও কোনও বিরোধের খবর শোনেননি কবীর। তাই ব্যক্তিগত কোনও আক্রোশের কারণে এই খুন বলে তার মনে হচ্ছে না।
তিনি বলেন, “শিহান নিহত হওয়ার পর ফেইসবুকে দেখলাম ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে নানা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। ঘটনাগুলো এরকম না। আমরাও ঘটনা পুরোপুরি জানি না। তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে ছিনতাইয়ের ঘটনাই ঘটেছে।”
শিহানের মৃত্যুর পরদিনই কালিয়াকৈর থানায় মামলা করেন তারা বাবা। সেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাইদুর রহমান তদন্তে ছিনতাইয়ের ঘটনার কথাই বলছেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, শিহান অফিস যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিদিনই ভোর ৫টার দিকে জামতলার বাসা থেকে বের হতেন। সেদিনও তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে মৌচাক বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছনোর আগে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন।
“এটা ১০০% ছিনতাইয়ের ঘটনা বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি,” দাবি করে ছয়জনকে গ্রেপ্তারের তথ্যও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
আনোয়ার হোসেন, সাইফুল ইসলাম, নাজিমউদ্দিন নয়ন, মিলন হোসেন, জুয়েল হোসেন ও সরওয়ার হোসেন সারু নামে ৬ জনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে শিহানের ব্যবহৃত ব্যাংকের ৩টি এটিএম কার্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড পাওয়ার কথাও জানান এসআই সাইদুর।
কালিয়াকৈর থানার ওসি রিয়াদ মাহমুদও সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছিনতাইকারীতের হাতে শিহানের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি আমরা। এ ঘটনায় যারা অন্য দাবি করছে, তাদের কাছে কোনও প্রমাণ থাকলে সরবরাহের অনুরোধ রইল।”
শিহানের ছোট ভাই তানজির হোসেন সৃজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পুলিশ আমাদেরও বলেছে যে ঘটনাটি হাইজ্যাকিং হতে পারে। তবে তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আসল ঘটনা জানতে পারব।”
শিহানের মৃত্যু নিয়ে অন্য কোনও সন্দেহ করছেন কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমার ভাইয়ের এক পায়ের হাঁটুর ওপরের অংশে সামনে থেকে একটি স্ট্যাব করা হয়েছে, একই পায়ে পেছন থেকেও একটি স্ট্যাব করা হয়েছে। দুটি আঘাতেই তার পায়ের রক্তনালী কেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
“ভাইয়ের শোকে বাবা-মা এখন কথাও বলতে পারছেন না। তাদের সামলে অন্য বিষয়ে খোঁজ নিতে পারছি না আমরা।”
এখন পুলিশ সহযোগিতা করলেও নিহত হওয়ার পরপর এই বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সৃজন।
তিনি বলেন, “আমার ভাই ভোরে মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির ১০০ গজের মধ্যে মারা গেছে। কিন্তু এরপরও সেখানে পুলিশ এসেছে সকাল সাড়ে ৮টা-৯টার মধ্যে। আসার পর কারা লাশ উদ্ধার করবে, সেই নিয়ে ফাঁড়ি পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের ঠেলাঠেলির মতো অরাজকতাও দেখতে হয়েছে।”
এআইইউবি শিক্ষার্থী সীমান্ত হত্যা
যেদিন শিহান নিহত হয়েছিলেন, সেই ১২ ডিসেম্বর ভোরেই নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কা রোড এলাকায় ছুরিকাহত হন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) শিক্ষার্থী মো. ওয়াজেদ সীমান্ত (২০)। পরদিন হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
সীমান্তসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে গুপ্তহত্যার অভিযোগ তুলে বিচারের দাবিতে ‘সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ বৃহস্পতিবার কিছু সময়ের জন্য ঢাকার রামপুরা সেতু অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায়।
কিন্তু পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, সীমান্তও ছিনতাইকারীদের হামলায় প্রাণ হারান।
সীমান্ত হত্যা মামলার তদন্ত করছেন নারায়ণগঞ্জ মডেল থানার এসআই রফিকুল ইসলাম।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সীমান্ত হত্যার ঘটনায় এরই মধ্যে অনিক ও আকাশ নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনিক ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে কীভাবে সীমান্তকে ছুরিকাঘাত করেছিল, তার বর্ণনাও গ্রেপ্তারের পর আমাদের কাছে দিয়েছে।”
অনিকের বিরুদ্ধে ছিনতাই, ডাকাতি চেষ্টা ও মাদকসহ আটটি মামলা ররেছে। তার সঙ্গী আকাশের বিরুদ্ধেও এমন সব অভিযোগে ১১টি মামলা রয়েছে। তারা দুজনই গত বৃহস্পতিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় সীমান্তকে খুন করা হয়, আসামিদের স্বীকারোক্তিতে এমনটাই জানতে পেরেছেন এসআই রফিকুল।
“আমরা এখন পর্যন্ত যেটুকু পেয়েছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে তার কিংবা পরিবারের সঙ্গে আসামিদের পূর্ব বিরোধ ছিল না। শুধু ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে।”
সীমান্ত চোরাগোপ্তা হামলার শিকার- এমন কথা ঠিক নয় বলে মনে করেন তার বাবা আলম পারভেজ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যারা এসব কথা বলছে, তারা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। ঘটনার পর আমার ছেলে নিজে আমাকে বলে গেছে যে ছিনতাইকারীরা তার ওপর হামলা করেছে। আমার ছেলে কখনোই রাজনীতি করেনি। আন্দোলনেও জড়িত ছিল না। আন্দোলনের সময় এক মাস বাসাতেই ছিল।”
আলম পারভেজ বলেন, মৃত মায়ের স্মৃতিবিজড়িত মোবাইল ফোনটি রক্ষা করতে গিয়েই সীমান্তকে জীবন দিতে হয়েছে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৩ বছর আগে সীমান্তের মা মারা যান। সীমান্তের মোবাইলে তার মায়ের অনেকগুলো ছবি ছিল।
আলম পাভেজ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমি সীমান্তকে জিজ্ঞেস করছিলাম- বাবা ক্যান তুমি ছিনতাইকারীদের বাধা দিতে গেলা। ছেলে আমারে কইলো- ‘বাবা মোবাইলের ভিতরে মায়ের ছবি আছে, আমি মোবাইলটা হারাইতে চাই নাই’।”
সীমান্ত যেখানে হামলার শিকার হন, সেখান থেকে ৫০ গজ দূরে মরগান স্কুলের সামনে চায়ের দোকান চালান জামাল হোসেন। তার দোকান থেকে সীমান্তদের বাসার দূরত্ব ১৫০-২০০ গজ।
জামাল প্রতিদিনই ভোর ৫টার দিকে দোকান খুলি। দোকানের সামনে দিয়ে সীমান্তকে প্রতিদিন যাতায়াত করতেও দেখেন তিনি।
জামাল বলেন, “সেদিনও সকাল সাড়ে ৫টার দিকে তারে আমার দোকানের সামনে দিয়ে যাইতে দেখলাম। এর ১০-১২ মিনিটের মধ্যেই সীমান্ত আবার আমার দোকানের সামনে ফেরত আসল। এসে বলে- চাচা আমারে ধরেন’। তাকায়া দেখি শরীর দিয়ে রক্ত পড়তেছে। কী হইছে জিজ্ঞাস করতেই আমারে কইলো- ‘চাচা আপনার মোবাইলটা দেন, আমারে ছিনতাইকারী ধরছে’।
“মোবাইল হাতে নিয়ে তার বাপের নাম্বার নিজেই তুলল। এরপরই জ্ঞান হারায়য়া পইড়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমি তার বাপেরে খবর দিলে তারা আইসা সীমান্তরে হাসপাতালে নিয়া যায়।”
পূর্বাচলের লেকে সুজানা-কাব্যর লাশ
ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচলের ২ নম্বর সেক্টরের লেক থেকে গত ১৭ ডিসেম্বর উদ্ধার করা হয় সুজানা আক্তার (১৭) নামে এক কিশোরীর লাশ। বাবাহারা সুজানা তার মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাজধানীর কাফরুল থানার কচুক্ষেত এলাকায় থাকতেন। পড়তেন ভাষানটেক সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে।
পরদিন একই স্থান থেকে উদ্ধার করা হয় সাইনুর রশিদ ওরফে কাব্য (১৬) নামে আরেক কিশোরের লাশ। সাইনুর কাফরুল থানার কচুক্ষেত বউবাজার এলাকার হারুনুর রশিদের ছেলে। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
সুজানা ও সাইনুর বন্ধু ছিলেন। স্বজনরা জানায়, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের রাতে বাসা থেকে ঘুরতে বের হওয়ার পর নিখোঁজ ছিলেন সুজানা ও কাব্য।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফেইসবুক গ্রুপ ‘Private University Students Alliance of Bangladesh – PUSAB’ এ এক পোস্টে অভিযোগ করা হয়েছে, সুজানা ও কাব্যও চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হয়েছেন।
কিন্তু পুলিশ বলছে, তাদের মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লেকের পানিতে পড়ে মারা গেছেন দুজন।
সুজানা ও কাব্যের মৃত্যুতে রূপগঞ্জ থানায় আলাদা দুটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। মামলা দুটি তদন্ত করছেন রূপগঞ্জ থানার এসআই মো. জাহাঙ্গীর।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ঘটনাটি টোটালি অ্যাকসিডেন্ট। ১৬ ডিসেম্বরে রাতে ঘন কুয়াশা ছিল। সে কারণে মোটর সাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তারা লেকে পড়ে গেছে বলে আমাদের ধারণা।”
দুজনের লাশের সঙ্গে তাদের হেলমেট, মোবাইল ফোন, ঘড়ি সবই উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের সুরতহাল প্রতিবেদনে আঘাতের অন্য কোনও চিহ্নের কথা বলা হয়নি।
এসআই জাহাঙ্গীর বলেন, “দুজনের কেউই সাঁতার জানতো না। এছাড়া ক্যাব্যের লাশ উদ্ধারের সময় তার একটি পা মোটরসাইকেলের সঙ্গে আটকে ছিল। সবকিছু মিলিয়ে আমরা নিশ্চিত এটা সড়ক দুর্ঘটনা।”
নায়ারণগঞ্জ জেলার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল-গ) মেহেদী ইসলামও ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলে মনে করছেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “নিহত দুজনের কারও কাছ থেকেই কিছু খোয়া যায়নি। দেখে দুর্ঘটনাই মনে হচ্ছে।”
তারপরও পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেজন্য আশপাশের এলাকার সিসি ক্যামেরার ভিডিও সংগ্রহের কাজও চলছে।
চট্টগ্রামের জসিম হত্যা
গত ১৭ ডিসেম্বর রাতে বন্দর থানার আনন্দবাজার সিটি কর্পোরেশন ময়লার ডিপো টিসি কলোনি এলাকায় জসিম উদ্দিন নামে এক যুবক ছুরিকাঘাতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তা অংশগ্রহণে ছবি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
‘Private University Students Alliance of Bangladesh – PUSAB’ ফেইসবুক গ্রুপে জসিমের একটি ভিডিও পোস্ট করে লেখা হয়েছে, “ওরা আমাদের মেরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ নাম দিয়েছে, ঘোষণা দিয়ে, মারতেসেও দালাল, রাজাকার ট্যাগ দিয়ে!!’
জসিম চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হয়েছেন দাবি করে চট্টগ্রামে প্রতিবাদ সমাবেশও হয়েছে।
কিন্তু পুলিশ বলছে, ময়লার ডিপোতে ফেলে দেওয়া খাবারের উচ্ছিষ্ট দখলের দ্বন্দ্বে জসিম খুন হন। তাকে ছুরিকাঘাত করেন একই কলোনির বাসিন্দা নেজাম উদ্দিন দীপু (২৫)। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
নিহত জসিমের চাচা বশির উদ্দীনও জানিয়েছেন একই কথা। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, খাবারের উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে বিক্রি নিয়ে তার ভাতিজার সঙ্গে কয়েকজনের বিরোধ ছিল। এই বিরোধের জেরে হত্যাকাণ্ডটি ঘটে।
চট্টগ্রাম বন্দর থানার ওসি কাজী মুহাম্মদ সুলতান আহসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জসিমের বাবা সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চালান। জসিম ময়লার ডিপোতে ফেলে দেওয়া বিভিন্ন হোটেল কিংবা অনুষ্ঠানের উচ্ছিষ্ট খাবার কুড়িয়ে মাছের খামারে বিক্রি করতেন।
“এই ব্যবসা নিয়ে তার সঙ্গে ওই কলোনিরই কয়েকজনের দ্বন্দ্ব হয়। সেই দ্বন্দ্বেই তাকে খুন করা হয়েছে। এখানে অন্য কোনও বিষয় নেই। যারা জসিমকে হত্যা করেছে তারাও একই কলোনির বাসিন্দা।”
ইউল্যাব শিক্ষার্থী সাদমানের ওপর হামলা
‘অলরেডি একটা হামলার শিকার, নেক্সট হামলার অপেক্ষায় আছি, মরার পর বিচার করতে আসবেন না।’- গত বৃহস্পতিবার ফেইসবুকে নিজের আইডিতে এই স্ট্যাটাস দেন ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থী সৈয়দ সাদমান।
গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের এপিসির সামনে তার রঙ লাগিয়ে দেওয়ার ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই থেকে তিনি অনেকের কাছেই পরিচিত।
সাদমানের ওই স্ট্যাটাস শেয়ার দেওয়া হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্রুপেও।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ সাদমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, গত ১ ডিসেম্বর দুপুরে ধানমণ্ডিতে তার ক্যাম্পাসের সামনেই হামলা হয়েছে।
হামলায় আহত হয়ে ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয় সাদমানকে। দুই দিন পর মোহাম্মদপুর থানায় অভিযোগ করা হলেও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে তার অভিযোগ।
হামলাকারী সবাই সাদমানের অচেনা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজনের সঙ্গে বহিরাগত কয়েকজন ছিল বলে এই তরুণ জানান।
কী কারণে হামলা- জানতে চাইলে সাদমান বলেন, “ক্যাম্পাসে মাদক সেবনসহ বিভিন্ন খারাপ কাজ করতো কয়েকজন। আমি ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষায় তাদের এসব কাজে বাধা দিয়েছিলাম। এছাড়া আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। সেটাও সবাই জানে।
“এসব কারণে অনেকে আমার উপর ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়েকজন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারা আমার ওপর হামলা চালিয়েছে।”
তিনি জানান, হামলায় জড়িত কয়েকজনকে ইতোমধ্যেই সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া তারা তার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। সেই কারণে এখন আর হামলাকারীদের পরিচয় তিনি দিতে চাইছেন না।
তবে এটাকে ‘চোরাগোপ্তা হামলা বললে মিথ্যা বলা হবে’ বলে মন্তব্য করেন সাদমান।
ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার বিষয়ে জানতে তিনি বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন হামলার শিকার হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে, তখন আমরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এখন যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রক্তাক্ত হচ্ছে, তখন তাদের আমরা পাশে পাচ্ছি না। সেই ক্ষোভ থেকেই এই স্ট্যাটাস দেওয়া, আর কিছু নয়।”
সাদমানের ওপর হামলার অভিযোগের তদন্ত করছেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই মো. পারভেজ। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা অভিযোগ পাওয়ার পর অভিযোগকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তাকে ফোন করে দেখা করতে বললে তিনি ব্যস্ততার কারণে পরে দেখা করবেন বলে জানান। এরপর অভিযোগকারী পুলিশের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ করেননি।”
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে দেড় দশকের শেখ হাসিনার সরকারের। তার দল আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে দেওয়ার বিরোধী আন্দোলনের নেতারা। তাদের চাপে অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধও করেছে।
তার পাঁচ মাস পর এখন ছুরিকাঘাতে কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনাগুলোকে চোরাগুপ্তা হামলা হিসাবেই দেখছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন নাজিফা জান্নাত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৯ জন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের মধ্যে দুজন ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাদের একজন নাজিফা জান্নাত। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি শাখার সমন্বয়ক হিসাবে তিনি জুলাই মাসের শুরুতে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।
নাজিফা জান্নাত সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এক সপ্তাহের মধ্যে ৭ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে এসব ঘটনা ঘটেছে। তারা প্রত্যেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
“যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলোকে আমরা বলছি নিরাপত্তার ঘাটতি। আমরা যে সব কর্মসূচি করছি, সেগুলোতে আমাদের প্রথম কথাই হচ্ছে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তার যে জায়গা সেটা এনশিওর করা হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “গতকাল (বৃহস্পতিবার) ছাত্রলীগের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কারণ সে এক শিক্ষার্থীকে ফোন করে তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এমন ঘটনা ঢাবিতেও ঘটছে, অন্য জায়গায়ও ঘটছে। এ্ সবগুলো ইন্টার কানেক্টেড। এসব ঘটনায় বোঝা যায় দেশের যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেখানে এক ধরনের ঘাটতি আছে। এগুলো খুবই অ্যালার্মিং ঘটনা।”
পুলিশ যে ছিনতাইয়ের কথা বলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে নাজিফা বলেন, “সেখানে আমরা দাবি তুলেছিলাম, সেসব ছিনতাইকারীর রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করতে। সেটাও কিন্তু করা হচ্ছে না।”
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা চোরাগোপ্তা হামলার অভিযোগ করছেন না, বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, “পরিবারের একটা কনসার্নের জায়গা থাকে, একটা ভয়ের জায়গা থাকে। এজন্য তারা এসব কথা বলে না।”
চোরাগোপ্তা হামলার সন্দেহ কেন করছেন- প্রশ্নে নাজিফা বলেন, “আমরা বলেছি এসব ঘটনা চোরাগোপ্তা হামলা কি না, সে বিষয়ে তদন্ত করতে। যাদের ছিনতাইকারী বলা হচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশের দাবি করেছি। পুলিশকে আমরা বলেছি আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে।
“কিন্তু আমাদের প্রাণ যাওয়ার পর তারা যদি এসে বলে এগুলো ছিনতাইকারী করছে কিংবা চোরাগোপ্তা হামলা ছিল না, তাহলে সেগুলো নিয়ে তো আমাদের প্রশ্ন আছে।”
পুলিশ কী বলছে
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের চোরাগোপ্তা হামলার অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সদর সপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রতিটি হত্যাকাণ্ডকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করছে।”
গাজীপুরের মৌচাক এলাকায় শিহান হত্যার ঘটনায় ছিনতাইকারী ছয়জনকে গ্রেপ্তারের কথা বলেন তিনি। নারায়ণগঞ্জে এআইইউবির ছাত্র হত্যার ঘটনায়ও দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তারের কথা তিনি বলেন। চট্টগ্রামের খুনের ঘটনাটিতেও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বের কথা বলেন তিনি।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাজধানীতে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন।
তিনি বলেছিলেন, ছিনতাই বেড়ে গেছে। শেষ রাতের দিকে পুলিশ যখন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে, তখন ছিনতাইগুলো হয়। এজন্য শেষরাতে পুলিশের টহল বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সাগর বলেন, “সার্বিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে, অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে এবং অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পুলিশ বদ্ধপরিকর।”