সমালোচনার মুখে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল এবং শুল্ক–করে কিছু পরিবর্তন এনে ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেট অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
রবিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাজেট কার্যকর করা হবে।
বাড়তি কর দিয়ে কালো টাকা বৈধ করার যে সুযোগ প্রস্তাবিত বাজেটে দেওয়া হয়েছিল তা বাতিল করে নতুন অর্থ বছরের বাজেটে অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ।
ফলে কালো টাকা সাদা করার পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান।
বাজেট অনুমোদনের পর সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আগের চেয়ে বাড়তি করে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট কেনা এবং ভবন নির্মাণে অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব বাজেটে করা হয়েছিল। তবে অনুমোদন করার সময় সেটি পরিপূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়তি কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে বিভিন্ন পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেই বিধান বাতিল করা হয়েছে। ফলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আর থাকছে না।”
এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করাই বড় পরিবর্তন। ২ জুন প্রস্তাবিত বাজেটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট এবং ভবন কেনায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়। তবে আগের চেয়ে করের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। বলা হয়, এলাকাভেদে আয়তন অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, পৌর এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে ১০০ থেকে ২ হাজার টাকা করহারের প্রস্তাব ছিল। এছাড়া একই সুবিধা পেতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে ৫০ থেকে ৯০০ টাকা কর নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখন এসব সুযোগ বাতিল হলো।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে, অর্থাৎ সাদা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের ১৫ বছরে ৯৫ কোটি টাকা সাদা হয়। শেখ হাসিনার সরকারের শেষ তিন মেয়াদে (২০০৯-২৩) প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বৈধ হয়েছে।
২০০৭-০৮ সময়ের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। ওই সময়ে সর্বোচ্চ ৩২ হাজার করদাতা কালো টাকা সাদা করেছিলেন।
২০২০-২১ অর্থ বছরে এযাবৎকালের মধ্যে এক বছরে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা হয়। সেবার জমি-ফ্ল্যাট কিনে ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে কিংবা কর দিয়ে নগদ টাকা সাদা করেছিলেন ১১ হাজার ৮৫৯ জন।
কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোভিড মহামারীর কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সীমিত হওয়ায় ওই বছর মানুষ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নেয় বেশি। জাতীয় সংসদ না থাকায় গত ২ জুন ২০০৭ ও ২০০৮ সালের মতো ভিন্নভাবে উপস্থাপন হয় বাজেট প্রস্তাব। বেতার ও টিভি ভাষণে তা উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা।
২ জুন বাজেট প্রস্তাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার পর থেকেই বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বৈষম্যমূলক। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার এমন নীতি বিবর্জিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনের পর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছিল, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ রাখা হয়েছে তা জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনের পরের দিন ৩ জুন সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছিলেন, বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট কেনায় কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এই উদ্যোগ সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে। এই বিষয়টি জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
প্রথা অনুযায়ী, প্রতি বছর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এবার দেশের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাজেট দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সে কারণে আগের প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে; গত ২ জুন সোমবার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তাতে তিনি জিডিপি প্রবৃদ্ধির (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) লক্ষ্য ধরেছেন ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখতে চেয়েছেন।
এই বাজেট সংসদে পাসের কোনও বিষয়ও নেই। উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদিত এই বাজেট রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে কার্যকর হবে। ১ জুলাই শুরু হবে নতুন অর্থ বছর।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় শুল্ক-করের পরিবর্তন নিয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। তাতে শুল্ক-করে কী কী বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
আয়কর
১. পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানি যাদের পরিশোধিত মূলধনের অন্যূন ১০ শতাংশ শেয়ার আইপিও বা সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে আয়ের সাড়ে ২২ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। তবে বিবেচ্য আয়বর্ষে সব ধরনের আয় ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পন্ন করলে করহার ২০ শতাংশ হবে।
২. অন্য সব পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির ক্ষেত্রে সাড়ে ২৭ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। তবে বিবেচ্য আয়বর্ষে সব আয় ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পন্ন করলে করহার ২৫ শতাংশ।
৩. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের করহার ১৫ শতাংশের স্থলে ১০ শতাংশ হবে।
৪. সম্পত্তি হস্তান্তর হতে কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর কর্তনের হার ৮ শতাংশ, ৬ শতাংশ ও ৪ শতাংশের স্থলে যথাক্রমে ৫ শতাংশ, ৩ শতাংশ ও ২ শতাংশ করা হয়েছে।
মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট
১. রিফাইন্ড পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর সাড়ে ৭ শতাংশের পরিবর্তে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
২. ঝুট থেকে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তুলার উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
৩. নারী উদ্যোক্তা কর্তৃক পরিচালিত বিউটি পারলারের স্থান ও স্থাপনাভাড়ার ওপর মূসক অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
৪. বলপয়েন্ট কলমের আমদানি পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি প্রদান করা।
৫. হার্টের রিং ও চোখের লেন্স আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
শুল্ক
১. সব ধরনের পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে ইনভয়েস মূল্যের ভিত্তিতে শুল্কায়ন–ব্যবস্থা চালু করতে চায় সরকার। এ জন্য ক্রুড পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ককে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং অন্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ককে কমিয়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
২. সৌরশক্তি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিকে আরও সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে সোলার ইনভার্টারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে।
৩. দেশে মানসম্পন্ন টায়ার উৎপাদনের জন্য টায়ার তৈরির অন্যতম কাঁচামাল টেকনিক্যাল স্পেসিফায়েড ন্যাচারাল রাবারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।



