রোহিঙ্গা সঙ্কটের আট বছর পূর্তিতে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ১১টি দেশ বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে এই সঙ্কট সমাধানে ঢাকার সঙ্গে একযোগে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বাকি দেশগুলো হলো- নেদারল্যান্ডস, ইতালি, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনের পথ খুঁজতে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক সংলাপ শুরুর পরদিন সোমবার এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের পাশে থাকার এই প্রতিশ্রুতি দিল পশ্চিমা ১১ দেশ। তিন দিনব্যাপী এই সংলাপ শুরুর দিন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্র।
দশককাল ধরে জিইয়ে থাকা রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তৎপরতায় আগামী সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যে সম্মেলন হবে, তার প্রস্তুতি হিসাবে হচ্ছে এই সংলাপ।
সংলাপের দ্বিতীয় দিন সোমবার সকালে ঢাকায় ফরাসি দূতাবাসের ফেইসবুক পেইজে ১১ দেশের ওই যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আট বছর পেরিয়ে আমরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সেই কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ করছি, যার ফলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটেছিল। আজও ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে। নতুন আগতরাও শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় খুঁজছে।
“কঠিন পরিস্থিতি আর বাস্তুচ্যুত জীবনের মাঝেও রোহিঙ্গাদের ধৈর্য ও স্থিতিশীলতাকে আমরা স্বীকার করছি, বিশেষ করে রাখাইন অঙ্গরাজ্যের বর্তমান অবনতিশীল নিরাপত্তা ও মানবিক পরিস্থিতির মধ্যে। আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং জনগণকে, যারা নতুন আগতসহ সব রোহিঙ্গার আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিচ্ছেন এবং জীবনরক্ষাকারী মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করছেন।”
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা নিজেদের বাড়িতে ফিরতে চায় উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাদের প্রত্যাবাসনের পথ খুঁজতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু সীমান্ত পার হয়ে বাস্তুচ্যুতি এখনও চলছে। অনেক রোহিঙ্গা এখনও রাখাইন রাজ্যের ভেতরে বাস্তুচ্যুত। আর মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনও তাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে এবং টেকসইভাবে ফেরার মতো নয়।
“এই শর্তগুলো পূরণ হবে কেবল তখনই, যখন তাদের বাস্তুচ্যুতির মূল কারণগুলো সমাধান করা হবে, যার জন্য প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল মিয়ানমার। তাই আমরা স্বীকার করছি যে, রোহিঙ্গাদের ফেরার কোনও সময়সীমা এখনও ঠিক করা সম্ভব নয়। তাই সব পক্ষকে জোর দিয়ে বলছি অনুকূল পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টাকে জরুরিভিত্তিতে সমর্থন করতে।”
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা সামরিক জান্তা ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর বাড়তে থাকা সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানাই এবং আবারও জোর দিয়ে বলছি, সব ধরনের সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং মানবিক সহায়তা যেন নিরাপদে ও বাধাহীনভাবে পৌঁছাতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
“আমরা আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, সামরিক জান্তা যেন অন্যায়ভাবে আটককৃতদের মুক্তি দেয়। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ভঙ্গ ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থনে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

১১ দেশ বিবৃতিতে আরও বলেছে, “আমরা বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাব, যাতে মিয়ানমারের পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশে সম্পর্কিত মানবিক সঙ্কটের বিষয়ে মনোযোগ রাখা যায়। যার মধ্যে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনও অন্তর্ভুক্ত।
“আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আরও টেকসই সমাধানের পক্ষে কথা বলি, যেমন : তাদের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ানো, বিশেষ করে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে। একইসঙ্গে, তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত ও সক্ষম করে তোলার কাজও চলবে। আমরা কক্সবাজারের স্থানীয় বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীকেও সমর্থন দিয়ে যাব, যারা উদারভাবে শরণার্থীদের আতিথেয়তা জানাচ্ছেন।”
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা জোর দিয়ে বলছি রোহিঙ্গাদের অর্থবহ অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে তারা নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং বাংলাদেশে থাকাকালীন নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও উদ্দেশ্যমূলক জীবন যাপন করতে পারে। আট বছর পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের পাশে অটলভাবে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার এবং এই সঙ্কটরে মূল কারণগুলো সমাধান করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।”
কক্সবাজারে ‘স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ : টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শীর্ষক তিন দিনব্যাপী এই সংলাপ চলছে হোটেল বে ওয়াচে। তাতে অংশ নিচ্ছেন কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন দেশের শিক্ষাবিদ, বৈশ্বিক সংস্থা ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা।
সোমবার কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক এই সংলাপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে সাতটি প্রস্তাব তুলে ধরেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নিপীড়ন ও বাস্তুচ্যুতি থামাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
এই শরণার্থী সঙ্কটের টেকসই সমাধানে যে সাতটি প্রস্তাব তিনি তুলে ধরেন; তার মধ্যে রয়েছে—রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন; দাতাদের অব্যাহত সমর্থন; মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত; রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা; আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা; গণহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান; আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহি ত্বরান্বিত করা।
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে রাখাইনের মুসলমান জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছিল। তবে ২০১৭ সালের আগস্টে এই সঙ্কট বড় আকার নেয়।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী রাখাইনে সামরিক অভিযানের নামে গণহত্যা শুরু করলে ওই বছর কয়েক মাসেই ৭ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানের কারলেন তখন বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিয়েছিল।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাদের অধিকাংশ রয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে, কিছু আছে নোয়াখালীর ভাসানচরে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো নানা উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। এরমধ্যে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তা আরও জটিল হয়ে পড়ে।
গত বছর অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসানে উদ্যোগী হন। তার প্রচেষ্টায় গত মার্চ মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গাদের কষ্টগাথা শুনতে বাংলাদেশে আসেন।
সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসানে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা তখনই জানিয়েছিলেন ড. ইউনূস।
সেই আয়োজনের প্রস্তুতি হিসাবে কক্সবাজারে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সংলাপ হচ্ছে, যাতে ৭ প্রস্তাব তুলে ধরলেন তিনি।
কক্সবাজারে এই সংলাপ শুরুর দিনই ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে একটি বিবৃতি আসে মিয়ানমার নিয়ে, যেখানে বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়।
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখ্য উপ-মুখপাত্র টমি পিগোট সেই বিবৃতিতে বলেন, “বার্মায় (মিয়ানমার) রোহিঙ্গাসহ যেসব আদিবাসী গোষ্ঠী সহিংসতার এবং উচ্ছেদের শিকার, তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
“বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করছি আমরা, সেই সঙ্গে অন্য দেশগুলোরও, যারা বার্মার শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে।”



