সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি ছিল জাতীয়তাবাদীদের সবচেয়ে বড় সমাবেশ, হয়তো এ যাবৎকালেরও সবচেয়ে বড়।
সেন্ট্রাল লন্ডনে শনিবারের এই বিক্ষোভের বিশালতা সম্পর্কে ধারণা মেলে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজের প্রতিবেদনের এই বাক্যে।
কট্টর ডানপন্থি টমি রবিনসনের ডাকে এই বিক্ষোভে দেড় লাখ মানুষ জড়ে হয়েছিল বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলো ধারণা দিয়েছে।
উগ্রপন্থিদের এই বিক্ষোভটি শান্তিপূর্ণ থাকেনি। পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে, সংঘর্ষও বাঁধিয়েছে। তা সামাল দেওয়া দেড় হাজার পুলিশ সদস্যের জন্য বেশ কঠিন ছিল।
তা জেনেই পুলিশ সদস্যরা ভয় ও পক্ষপাতমুক্ত থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন বলে লন্ডন মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার ম্যাট টুইস্ট বিবিসিকে জানিয়েছেন। তা করতে গিয়ে ২৬ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে, তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর।
মার্চ শুরু হওয়ার অনেক আগেই হাজার হাজার মানুষ ব্ল্যাকফ্রিয়ার্স সেতু পার হয়ে কিংবা ওয়াটারলু স্টেশন থেকে পতাকা হাতে বেরিয়ে আসে। তাদের পতাকায় ছিল ইয়র্কশায়ারের গোলাপ থেকে শুরু করে আইল অব ওয়াইটের ডায়মন্ড চিহ্ন।
‘ইউনাইটেড দ্য কিংডম’ স্লোগান ছিল তাদের মুখে, কিন্তু যুক্তরাজ্যকে কিসের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে এই ডাক দেওয়া হচ্ছে, তা অনেকের কাছেই ছিল অস্পষ্ট।
আয়োজকরা দাবি করেছিল, এই সমাবেশকে বাক স্বাধীনতার দাবিতে। কিন্তু সমাবেশ থেকে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত স্লোগানগুলো ছিল- ‘কিয়ার স্টারমার ইজ এ ওয়্যাঙ্কার (স্বমেহনকারী)’, ‘ও টমি টমি’ কিংবা ‘আমরা আমাদের দেশ ফেরত চাই’।
অনেকের চোখে অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট এই স্লোগানগুলো সমাবেশে যোগ দেওয়া বিভিন্নজনের কাছেও ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করছিল।
সাউদাম্পটন থেকে আসা ডন বলেন, তিনি এখানে এসেছেন কারণ তাদের দেশ ‘দখল’ হয়ে যাচ্ছে। কারা দখল করছে, সেই প্রশ্নে তিনি অবৈধ অভিবাসীদের দিকে ইঙ্গিত করেন।
দক্ষিণ বার্মিংহাম থেকে আসা ড্যানি একটি প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিলেন যেখানে লেখা ছিল- ‘তাদের ফেরত পাঠাও’।
অভিবাসীদের নিয়ে বিরক্ত ড্যানি বিক্ষোভে যোগ দেন তার দেশের ধর্ম ও পরিচয়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
স্কাই নিউজের প্রতিবেদক টম চেশ্যায়ার লিখেছেন, “আমি এর আগে যতগুলো সমাবেশ কভার করেছি, সেগুলোর তুলনায় এই সমাবেশের একটি পার্থক্য ছিল, তা হলো প্রকাশ্য খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদের প্রচার।”
সমাবেশে যোগ দেওয়া অনেকে কাঠের ক্রস বহন করছিল। একজন ব্যক্তির কাছে একটি আলোকিত ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতীকও ছিল।
জনতা যখন হোয়াইট হলে পৌঁছাল, তখন মঞ্চ থেকে স্লোগান দেওয়া হচ্ছিল ‘ক্রাইস্ট ইজ কিং’। এর কিছুক্ষণ পরেই লর্ডস প্রেয়ার পাঠ করা হয়। এ যেন এক ধর্মপাশে রাজ্য বেঁধে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
এই সবকিছুর কেন্দ্রে ছিলেন কট্টর ইসলামবিরোধী টমি রবিনসন।
তিনি যখন মঞ্চে ওঠেন, তখন এটাকে একটি রাজনৈতিক সমাবেশের চেয়ে একটি ফুটবল ম্যাচ বা উৎসবের মতোই মনে হচ্ছিল।
কর্কশ স্বরে তিনি উচ্চ কণ্ঠে বলেন, “আমরা ঝড়কে মোকাবেলা করেছি, আমরা ঝড়কে সহ্য করেছি, এবং আজ আমরাই সেই ঝড়।”
তার কথায় খুব বেশি অতিরঞ্জন ছিল না। কারণ বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক লন্ডনে রবিনসনের সমর্থনে এই সমাবেশে ভার্চুয়ালি নিজের মুখ দেখিয়েছিলেন।
অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে এমনও অনেকে ছিলেন যাদেরকে চরম ডানপন্থী হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
এটা স্পষ্ট যে বিক্ষোভকারীদের কেবল চরম ডানপন্থী হিসাবে আখ্যায়িত করা হলে আসলে কী ঘটছে, তা বোঝা সম্ভব নয়। শুধু এই তকমা তাদের সবার গায়ে এঁটে দেওয়াও যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ তাদের সংখ্যা ছিল অনেক এবং মুখে উচ্চারণ ছিল একেক জনের একেক রকম।
সমাবেশের আগে প্রতিবাদের বারুদভরা গ্রীষ্মের প্রতিশ্রুতি এসেছিল, তা হয়ত জ্বলে ওঠেনি। এর বদলে সেখানে জাতীয়তাবাদের একটি অবিচলিত উন্মাদনা দেখা গেছে।
এই সমাবেশ তাদের শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ বলে কেউ ধরে নিতে পারে; কিন্তু যারা সেখানে উপস্থিত হয়েছেন, তারা মনে করছেন যে এটা আরও বড় কিছুর শুরু মাত্র।
তথ্যসূত্র : স্কাই নিউজ, বিবিসি