চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি খানিকটা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক।
সংস্থাটি বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস গত ২০২৪-২৫ বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি।
তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা হ্রাস এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে আগামী ২০২৬-২৭ অর্থ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হতে পারে বলে আশার কথা শুনিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।
মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এক সপ্তাহ আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকাশিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকের (এডিও) প্রতিবেদনে চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশে ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত জুনে শেষ হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থ বছর। ইতোমধ্যে তিন মাস পার হয়ে গেছে; কিন্তু এখনও ওই অর্থ বছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
গত ২৭ মে যে সাময়িক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে গত অর্থ বছরের ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলা হয়েছিল।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ২২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকটি ইতিবাচক, তবুও গতিশীলতা বজায় রাখতে এবং বিশেষ করে তরুণ ও নারীদের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে জরুরি ও সময়োপযোগী সংস্কারের প্রয়োজন।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির পর শেষার্ধে এসে (জানুয়ারি-জুন) জিডিপি প্রবৃদ্ধি পুনরায় বাড়ে। এর পেছনে মূল কারণ ছিল শক্তিশালী রপ্তানি, রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স প্রবাহ এবং বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বৃদ্ধি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নীতির কারণে বৈদেশিক চাপ কমেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হয়েছে এবং চলতি হিসাবে লেনদেন ভারসাম্যে (বিওপি) ঘাটতি কমেছে। এছাড়া রপ্তানিও ধারাবাহিকভাবে ভালো ফল দেখিয়েছে।
“কঠোর মুদ্রানীতি, প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের কম আমদানি কর এবং ভালো ফলনের কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে দুর্বল কর সংগ্রহ, বেশি ভর্তুকি এবং ঋণ পরিশোধ বৃদ্ধির কারণে বাজেট ঘাটতি বেড়েছে।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বেড়েছে। মোট শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ কমে ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশে নেমেছে, যেখানে নারীরা বেশি প্রভাবিত হয়েছেন। শ্রমবাজারের বাইরে থাকা ৩০ লাখ অতিরিক্ত কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ২৪ লাখ নারী।
বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জ্য পেম বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি দৃঢ়তা দেখিয়েছে। কিন্তু এটিকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যায় না। শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পথ নিশ্চিত করতে এবং আরও বেশি ও উন্নতমানের চাকরি সৃষ্টি করতে, বাংলাদেশের জন্য সাহসী সংস্কার ও দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক রাজস্ব বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা দূর করা, জ্বালানি ভর্তুকি হ্রাস, নগরায়ণ পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই দশকে শিল্পখাতের চাকরি ঢাকায় ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যা আঞ্চলিকভাবে সমান উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার দিকটি তুলে ধরে। প্রতিবেদনে দেশব্যাপী সার্বজনীন চাকরি সৃষ্টি নিশ্চিত করতে স্থানীয় উন্নয়ন কৌশল পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেটও প্রকাশ করেছে। বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি এই বছর বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে; তবে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্য চালু রাখা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার দেশগুলোকে নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে এবং স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।
বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট জোহানেস জুট বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দেশগুলোকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য ঝুঁকি সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে।”
তিনি বলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা সর্বাধিকভাবে কাজে লাগানো এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য বাণিজ্য বাধা কমানোর মাধ্যমে দেশগুলো উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এবং অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তির জন্য নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে পারবে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি এখনও বিদেশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য খুব খোলা নয়। অনেক খাতে উচ্চ শুল্ক থাকায় সেগুলোতে চাকরি কমছে। অন্যদিকে, কম শুল্কযুক্ত খাত, যেমন সেবা খাত, গত দশকে নতুন চাকরির বড় অংশ তৈরি করেছে।
“কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কিছু খাতে মানুষের কাজের সঙ্গে মিলে উৎপাদন ও আয় বাড়াতে পারে। তবে, এখনও দক্ষিণ এশিয়ার বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী কম দক্ষ, কৃষি বা শারীরিক কাজে নিয়োজিত।”