শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে ঘুরছেন। হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হলো বাংলাদেশের ঢাকা কত দূরে? গুগল ম্যাপ বা ইন্টারনেটের সাহায্যও নিতে চাইছেন না। এমন অবস্থায় দূরত্ব জানা কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব।
আপনাকে চলে যেতে হবে কলম্বো শহরের – ১২, ফ্লাওয়ার রোডে। সেখানে কলোনিয়াল ধাঁচের আস্তরহীন তিন তলা দালান দেখা যাবে। যার পাশেই নাম ফলকে লেখা “দ্যা ক্রিকেট ক্লাব ক্যাফে”।
তিনটি সিঁড়ি বেয়ে চিকন প্রবেশ দ্বার গলে যখন ভেতরে ঢুকবেন সঙ্গে সঙ্গেই জেনে যাবেন কলম্বো থেকে ঢাকার দুরত্ব। ২৮৭৫ কিলোমিটার, আর সেটা লেখা আছে দিক নির্দেশন কাঠের গাছ সদৃশ রোড ফলকে। সেখানে বর্তমান জাতীয় স্টেডিয়ামের দুরত্ব দেওয়া আছে। সেটাকেই কলম্বো থেকে ঢাকার দুরত্ব ধরে নিতে হবে।

আসলে এটি মানচিত্র ঘর নয়। নামেই বুঝতে পেরেছেন একটি রেস্টুরেন্ট। যেখানে খাবারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব ক্রিকেটের। সেখানে শুধু বাংলাদেশের মাঠ-ই নয়, লর্ডস, এমসিজি, ইডেন গার্ডেনস বিশ্বের এমন সেরা ক্রিকেট গ্রাউন্ড গুলো কতদূরে তাও দেয়া আছে। খাবারের মেনুর নামও ক্রিকেটারদের নামে।
আগেই বলা হয়েছে এটি একটি রেস্টুরেন্ট কিন্তু এর আসল পরিচয়, এটি ক্রিকেটের রেস্টুরেন্ট। যার দেয়াল জুড়ে সেঁটে আছে ক্রিকেট স্মরণীকা। এই রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করা থেকে আপনি আর মাথা নিচে নামাতে পারবেন না। দেয়ালেই থাকবে চোখ।

কখনও দেখবেন শচিন টেন্টুলকারের স্বাক্ষর সম্বলিত ছবি বা ব্যাট, আবার পাশেই ফ্রেমবন্দী গর্ডন গ্রিনিজ তার প্রিয় পুল শট খেলছেন। সেই ছবিতেও আছে অটোগ্রাফ। প্রয়াত শেন ওয়ার্ন আছেন, ওয়াসিম আকরামের অটোগ্রাফড জার্সি আছে, গ্লেন ম্যাকগ্রা দিয়েছেন অটোগ্রাফ সম্বলিত বল, ড্যারেন গফ দিয়েছেন জার্সি, মাহেলা জয়াবর্ধনে তো জার্সি ও ব্যাট দুটোই দিয়েছেন।
স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের জন্য আছে পুরো একটি দেয়াল। সেখানে শুধু তার স্মরণীকা। অবশ্য ব্র্যাডম্যানের অট্রোগ্রাফ নেই, শুধুই ফটোগ্রাফ। ১৯৬৮ সালে যে ব্যাট দিয়ে স্যার গ্যারি সোবার্স ওভারে ছয় ছক্কা মরেছিলেন সেই ব্যাটটিও আছে এখানে। এবং অবশ্যই ১৯৯৬ সালে পাওয়া শ্রীলঙ্কার সেরা অর্জন বিশ্বকাপ জয়ের মুহুর্তের ছবি জায়গা করে নিয়েছে একটি দেয়ালের উপর নিচের পুরো অংশ।

আছে ২০টির মতো ব্যাট, বহুদিনের পুরোনো হওয়ায় সেসব ব্যাটের গ্রিপ গলে পড়ছে। সবগুলো ব্যাটেই আছে অট্রোগ্রাফ। এছাড়াও আরও কতকিছু। ক্রিকেটের এমন স্মরণীকা সংগ্রহের আয়োজন পৃথিবীর আর কোথাও হয়তো নেই।
এই সব কিছুর শুরু কিন্তু একটি সোয়েটার দিয়ে।
যার সোয়েটার, তাকে ক’জনই বা চিনবেন। ১৯৪৬ থেকে ’৬০ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা রে লিন্ডওয়াল। এই ক্রিকেটারের খুব কাছের ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান গ্যাবি হোয়াইট পরিবার। শ্রীলঙ্কায় ঘুরতে এসে তাদের ইচ্ছে হলো বৃটিশদের রেখে যাওয়া দেশটিতে পানশালা খুলবেন।

যেই ভাবা সেই কাজ, গ্যাবি হোয়াইট ও তার পার্টনার চলে আসেন শ্রীলঙ্কায়। পানশালা দিলেন এবং লিন্ডওয়ালের সোয়েটার ও ছবি টানিয়ে দিলেন দেয়ালে। কলম্বোয় তখন সন্ধ্যার পর ভালো পানশালা খুঁজে পাওয়া যেতো না। বিদেশি পর্যটকরা চলে আসতেন এই পাবে। সেই পথ ধরে শ্রীলঙ্কায় খেলতে আসা বিদেশি ক্রিকেটাররাও এসেছেন।
তারা এসেছেন, উপভোগ করেছেন নিজেদের সময় আর দি ক্রিকেট ক্যাফেকে দিয়েছেন অটোগ্রাফ, জার্সি বা ব্যাট। ২০০৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফর করতে আসা পুরো ইংল্যান্ড দল প্রতি সন্ধ্যায় সময় কাটাতেন এই পানশালায়, যা পরে রেস্টুরেন্টে পরিণত হয়। এমন অবস্থা হলো যে সেখানে আলাদা করে ইংল্যান্ড সমর্থকদের জন্য বার্মি আর্মি কর্নার বানাতে হয়েছে।

এই রেস্টুরেন্ট এখনও আগলে আছেন ৭০ ছোঁয়া গ্যাবি। তার স্বামী অবশ্য ওই সময় রেস্টুরেন্টে ছিলেন না। সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন এত স্মরণীকা পাওয়ার পেছনের গল্প, “আমরা কখনই কোন ক্রিকেটারকে রেস্টুরেন্টের জন্য কিছু দিতে বলিনি। যারা এসেছে তারা সবাই ভালোবেসে দিয়েছে। পরে যখন এতকিছু ভরে উঠছিল, তখন আমরা বড় পরিসরে চিন্তা করি এবং আরও স্মরণীকা সংগ্রহে সফল হই।”
কী ভাবছেন? এতকিছু আছে কিন্তু বাংলাদেশের খবর নেই কেন? হ্যা, সত্যিই নেই। কারণ শ্রীলঙ্কায় খেলতে গিয়ে এই রেস্টুরেন্টে কখনও খেতে বা ঘুরতে যাননি কোন বাংলাদেশি ক্রিকেটার। তাই কিছু দেওয়াও হয়নি ক্রিকেট ক্যাফেকে।

গ্যাবি অপেক্ষায় আছেন কোন বাংলাদেশি ক্রিকেটার কলম্বোর এই রেস্টুরেন্টে আসবেন। ক্রিকেট ক্যাফেটা দেখবেন এবং নিজের কোন একটি সামগ্রী বা একটি অটোগ্রাফ দিয়ে যাবেন।
তবে একে বারে নেই বলা যাবে না, রেস্টুরেন্টের প্রবেশ দ্বারের সামনে বাংলাদেশের স্টেডিয়ামের নাম তো আছে! আর দোতলায় বাংলাদেশের পতাকা টানানো আছে, পাশে কোন দেশের পতাকা শুনবেন? বাংলাদেশের বিপদের বন্ধু জিম্বাবুয়ের।



