সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার নামে তাকে হয়তো অনেকেই চেনেন না। কিন্তু মান্না বললেই দর্শকের মনের পর্দায় ভেসে উঠবে অ্যাকশন হিরো মান্না।
২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন অর্থাৎ বিএফডিসি প্রাঙ্গণে জমেছিল এক বুক হাহাকার।
নায়ক মান্নার গত হওয়ার ১৬ বছর গড়ালো।
সিনেমা ভক্তদের ফেইসবুক পেইজগুলোয় অনেকে বলছেন, “মৃত্যুর এতো বছর পরেও ভক্তদের অন্তরে এই মহানায়কের নাম মুছে যায়নি ।”
কেউ বলছেন, “প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সিনেমা হলমুখী করার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন ঢালিউড সুপারস্টার মান্না।”
দর্শকের কাছে ‘মান্না ভাই’ হয়ে ওঠা এই নায়ক ছায়াছবির জগতে আসেন ১৯৮৪ সালে বিএফডিসি আয়োজিত ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতা দিয়ে।
তখন তার বয়স বিশের কোঠায়।
বলা হয়, মান্নাকে পর্দায় প্রথম ‘ব্রেক’ দিয়েছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ১৯৮৬ সালে ‘তওবা’ সিনেমা দিয়ে অভিষেক ঘটে দীর্ঘদেহী মান্নার।
সেসময় রাজ্জাক তনয় বাপ্পারাজ নজর কেড়েছেন তার প্রথম সিনেমা ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’ দিয়ে।
মান্নার সিনেমা পাড়ায় আসার ‘স্ট্রাগল’ দেখেছেন বাপ্পারাজ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মান্না আমার ইমিডিয়েট পরে এসেছিলেন; খুব বেশি দেরি ছিল না। পুরো গ্রুপটাই ছিল নতুন মুখের সন্ধানে; মান্না, অমিত হাসান, দিতি। মান্না বেশ প্রমিজিং ছিল। ওর হাইট ভালো ছিল।
“আব্বার কাছে আসতো। তখন থেকেই চিন-পরিচয় ছিল। আব্বা তখনও ফর্মে ছিলেন। তখন আব্বার কথায় অনেকে কাজ করত। আব্বার বন্ধুর ছবি ছিল তওবা। মজনু মুভিজের ওই ছবির পরিচালক ছিলেন আজহারুল ইসলাম খান। ওতে আব্বা ছিলেন, মান্না ছিল।”
নাদিম মাহমুদ পরিচালিত ‘আন্দোলন’ সিনেমা মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। এতে প্রথমবারের মত এক সঙ্গে পর্দা ভাগ করে নেন মান্না ও বাপ্পারাজ। এই সিনেমা ব্যবসা সফল হয়।
এরপর ১৯৯৬ সালে সুপারহিট হয় বাপ্পারাজ ও মান্না অভিনীত ‘আজকের সন্ত্রাসী’।
১৯৯৭ আর ১৯৯৮ সালে পর্দায় এক সঙ্গে দেখা যায়নি দুজনকে। এই বিরতি কাটিয়ে ১৯৯৯ সালে আসে ‘পারলে ঠেকাও’। অ্যাকশন ধর্মী এই সিনেমা মোটামুটি ব্যবসা করে।
২০০০ সালের ঈদে মুক্তি পায় ‘তেজী সন্তান’। মান্না ও বাপ্পারাজের এই সিনেমা বক্স অফিসে মোটামুটি হিট হয়।
এরপর টানা বিরতি দিয়ে ২০০৭ সালে আবারও এক সঙ্গে কাজ করেন মান্না ও বাপ্পারাজ। বড় বাজেটের সিনেমা ‘মনের সাথে যুদ্ধ’ মুক্তির পর ব্যবসা করে সাত কোটি টাকার মতো।
অ্যাকশন নির্ভর এই সিনেমা মান্নার কৃতাঞ্জলী চলচ্চিত্রের ব্যানারে সপ্তম কাজ ছিল।
মান্না এতে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার পান। আর শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে পুরস্কার পান বাপ্পারাজ।
২০০৯ সালের মোটামুটি হিট ‘হৃদয় থেকে পাওয়া’ সিনেমাতেও ছিলেন এই দুই অভিনেতা।
মান্নার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনের মন্ত্র কী ছিল?
বাপ্পারাজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মান্না অনেক ভালো অবস্থানে চলে এলো। ও অনেক স্ট্রাগল করেছিল।”
“মান্না আসলে মার্শাল হিরো ছিল। ও সুপারস্টার হলো। নিচে থেকে উপরে- সবার একটা পছন্দের নায়ক ছিল মান্না।”
“সবচেয়ে বড় কথা, ফিল্মটাকেই সে তার ধ্যানজ্ঞান মনে করত। ফিল্ম তার সব ছিল। এটাই কাজে লেগেছিল; পরে সে ফিল্ম প্রডিউসার হলো। নিজের প্রডাকশনে ছবি করলো। তার প্রডাকশনের ছবিতে আমিও কাজ করেছি।”
১৯৯৭ সালে নিজের প্রযোজনা সংস্থা কৃতাঞ্জলি চলচ্চিত্র নিয়ে আসেন মান্না। জীবদ্দশায় কৃতাঞ্জলির ব্যানারে ৮টি সিনেমা প্রযোজনা করেন তিনি।
‘লুটতরাজ’, ‘লাল বাদশা’, ‘আব্বাজান’, ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’, ‘আমি জেল থেকে বলছি’, ‘মনের সাথে যুদ্ধ’, ‘পিতা মাতার আমানত’ – নিজের প্রতিষ্ঠানের এসব সুপারহিট সিনেমায় মান্না নিজেও অভিনয় করেন।
সবশেষ ২০০৮ সালের শেষের দিকে মান্নার ‘পিতা মাতার আমানত’ মুক্তি পায়। যদিও ভক্তদের স্তম্ভিত করে তার আগেই গত হয়েছিলেন মান্না।
নব্বই দশকের জনপ্রিয় নায়ক মান্নার শেষ সিনেমা ছিল ‘জীবন যন্ত্রণা’। মান্নার মৃত্যুতে বাকি থাকা শুটিং পরে ডামি দিয়ে শেষ করা হয়।
মান্না অভিনীত ও মুক্তিপ্রাপ্ত শেষ সিনেমা ‘জীবন যন্ত্রণা’ ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালে অর্থাৎ মান্নার মৃত্যুর ১৫ বছর পর মুক্তি পায় সিনেমাটি।
সতীর্থ অভিনেতা মান্নার সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল বাপ্পারাজের?
“এখন যেমন ইগো থাকে এ সিনিয়র ও সিনিয়র; তখনকার জামানায় ওই জিনিসগুলো আমাদের মধ্যে ছিল না। দিনশেষে আমরা সবাই বন্ধুর মতই চলতাম। স্ক্রিনে যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতাম তখন পারফরম্যান্সে চাইতাম কে কার চেয়ে ভালো করব; কিন্তু এসব আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে কখনও প্রভাব ফেলতো না।”
“আমাদের মধ্যে ভালো একটা বন্ডিং ছিল; কাজের মধ্যে। কোআর্টিস্টদের প্রতি যে সম্মান বোধ, শ্রদ্ধাবোধ এই জিনিসটা মান্নার মধ্যে ছিল। অহংকারবোধ ছিল না। আমরা আগে-পিছে এসেছিলাম কিন্তু ওই গ্যাপটা আমাদের মধ্যে কখনও ছিল না। সুন্দর একটা রিলেশন ছিল ওর সাথে আমার।”
যার হাত ধরে সিনে পাড়ায় এসেছিলেন সেই নায়করাজ রাজ্জাকের ভীষণ ভক্ত ছিলেন মান্না।
সেকথা জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে বাপ্পারাজ বলেন, “মান্না কিন্তু আব্বাকে ফলো করতো। পুরো অ্যাকটিংটাই। সে নিজেও বলেছে যে আমি রাজ্জাক সাহেবকে ফলো করি।
“সে প্র্যাকটিসও করতো। সে দেখাতো এগুলো করে। আব্বার ফ্যান ছিল। আব্বাকে খুবই শ্রদ্ধা করত। সে যখন অভিনয়ে ম্যাচিউরড হয়ে গেলো, তখনও কিন্তু আব্বাকে অনুসরণ করতো। মানে ওর অ্যাকটিংয়ে মধ্যে আব্বার ভয়েস, কথা বলার ঢঙ্গে, ড্রামার সিকোয়েন্সে আব্বার ধরনটা পাওয়া যেতো। ওই সবচেয়ে বেশি ঘেঁষা ছিল আব্বার।”
‘তওবা’ প্রথম ছবি হলেও মান্নার প্রথম মুক্তি পাওয়া সিনেমা ছিল ‘পাগলী’। ১৯৮৬ সালের এই সিনেমার পরিচালনা করে কাজী হায়াৎ।
এরপর পরিচালক কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ও ‘ত্রাস’ সিনেমাতে কাজ করে মান্না হয়ে উঠলেন সিনেপাড়ার নির্ভরযোগ্য নাম।
‘আম্মাজান আম্মাজান চোখের মনি আম্মাজান’ গানটি ১৯৯৯ সালে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের লেখা ও সুরে গানটিতে প্লেব্যাক করেন বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের কিংবদন্তী আইয়ুব বাচ্চু। ওই বছর মুক্তি পাওয়া কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’ সিনেমায় এই গানের চিত্রায়নে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন মান্না।
ইউটিউবে এই গানের ভিডিও পোস্টে একজন মন্তব্য করেছেন, “মান্না স্যার একজন লিজেন্ড। আম্মাজান গানটা সবসময় সেরা।”
কাজী হায়াতের পরিচালনা এবং মান্না অভিনীত সিনেমা দুর্দান্ত জুটি গড়েছিল।
মান্না কতটা অপরিহার্য ছিলেন এই পরিচালকের কাছে?
কাজী হায়াত সকাল সন্ধ্যাকে বললেন, “মান্নার জন্যই আমি চরিত্র তৈরি করতাম। মান্না আমার খুব কাছের মানুষ ছিল বলেই এটা আমি করতাম। মান্নার শুরু থেকেই আমি ছিলাম। মান্নারও প্রচেষ্টা ছিল অনেক।”
“মান্না প্রথমে ডাবিং করতে পারত না। ওর নাকে পলিপ ছিল। গোপনে সে পলিপ অপারেশন করে আসলো ইন্ডিয়া থেকে; আমাকে না জানিয়ে। তারপর তার ভয়েস ক্লিয়ার হলো। এটা পাগলী ছবির পরে।এরপরে সে নিজে ডাবিং করেছে। তার প্রচেষ্টা ছিল সিনেমার টিকে থাকার। এবং সিনেমায় ভালো করার।”
মান্না একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, তিনবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার এবং পাঁচবার বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন। প্রায় দুই যুগে মান্না কাজ করেছেন তিন শ-য়ের বেশি সিনেমায়।
অভিনয়ে মান্না কতটা ঢেলে দিতে পারতেন নিজেকে?
অর্ধশত সিনেমা পরিচালনা করা কাজী হায়াৎ বললেন, “মান্না আমার কাছে মোটামুটি ভালো অভিনেতা। কিন্তু তার প্রচেষ্টার কারণে সে দারুণভাবে দর্শক প্রিয় হয়ে উঠেছিল।
“আমি তাকে গল্পটা বলতাম। গল্পটা বললে সে সেই চরিত্রে অভিনয় করার চেষ্টা করতো। সেই চরিত্রটা হওয়ার চেষ্টা করতো। মান্না ভালো ছেলে ছিল। চলচ্চিত্রে নিবেদিত প্রাণ ছিল বলেই সে সাকসেস হয়েছিল।”
মান্নার চলে যাওয়া কাজী হায়াতের কাজে কতটা ছন্দপতন এনেছে?
কাজী হায়াৎ বলেন, “মান্না যেমন ছবি করতো সেসব অফ হয়ে গেলো। ইন্ডাস্ট্রির অনেক ক্ষতি হয়ে গেলো। এই ক্ষতিটা এখনও পূরণ হয়নি।
“ধাক্কা খেয়েছি। তাকে নিয়ে আর ছবি বানাতে পারিনি আমি। তারপর খুঁজে বেরিয়েছি আমি যে ধরনের ছবি করি সে ধরনের ছবি কাকে দিয়ে করানো যায়। চেষ্টা করেছি নিজের ছেলেকে দিয়ে। কখনও সাকসেস হয়েছি কখনও সাকসেস হতে পারিনি।”