টানা চতুর্থবার এমপি হলেন টিউলিপ সিদ্দিক; তার বন্ধু কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বে লেবার পার্টি যুক্তরাজ্যে ক্ষমতায় ফিরল। পুরনো বন্ধুকে নিজের নতুন মন্ত্রিসভায় সিটি মিনিস্টারের পদে বসালেন স্টারমার।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা রাজনীতিতে নেমে এমপি হলেও মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশিদের প্রথম ফুলটি টিউলিপের মাধ্যমেই ফুটেছিল।
গত বছর জুনে যুক্তরাজ্যে ভোটের পর টিউলিপ যেন উড়ছিলেন; কিন্তু দুই মাস না যেতেই তার জন্য দুঃসংবাদ আসে দেশ থেকে; যখন তিনি জানতে পারেন, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তার খালা শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটেছে।
সেই বছরে শুরুতে নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করেছিলেন শেখ হাসিনা; কিন্তু তার দেড় দশকের শাসনকালের অবসান ঘটে গত বছরের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে তার পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। গত বছরের ৫ আগস্ট তার ভারতে পালনোর যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন বোন এবং টিউলিপের মা শেখ রেহানাও।
৪২ বছর বয়সী টিউলিপ এক যুগ আগে যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টিতে সক্রিয় হওয়ার পর বিভিন্ন সময় বলেছিলেন, তার রাজনীতিতে আসার প্রেরণা খালা শেখ হাসিনা; যদিও শেখ হাসিনার নামে কর্তৃত্ববাদী শাসকের তকমা ততদিনে লেগে গিয়েছিল পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে।
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি বাংলাদেশের বিষয় বলে যুক্তরাজ্যে স্বস্তিতে থাকতে চেয়েছিলেন টিউলিপ; কিন্তু তা হয়নি। খালার সঙ্গে টিউলিপের ভাগ্যাকাশেও নেমে আসে কালো মেঘ।
বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনা আমলের বিভিন্ন অনিয়মের তদন্তে নামার পর তাতে টিউলিপেরও সম্পৃক্ততা পাওয়ার অভিযোগ তোলে দুর্নীতি দমন কমিশন। অন্যদিকে লন্ডনে খালার দল আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছ থেকে নানা সুবিধা পাওয়ার অভিযোগে শুরু হয় তোলপাড়।
সেই ঝড় সামাল দিতে পারেননি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমার; ফলে তদন্তের মুখোমুখি হয়ে গত জানুয়ারিতে পদত্যগ করতে হয় টিউলিপকে; যদিও তদন্তে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম না পাওয়ার কথাই বলা হয়েছিল।
বাংলাদেশেও পূর্বাচলের প্লট দুর্নীতির মামলার পর ফ্ল্যাট দুর্নীতির অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছে দুদক। প্লট দুর্নীতির মামলায় এরই মধ্যে অভিযোগ গঠনের পর ১১ আগস্ট (সোমবার) বিচার শুরুর দিন ঠিক হয়েছে।
তার ঠিক একদিন আগে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টিউলিপ বললেন, বাংলাদেশের ‘নোংরা’ রাজনীতির শিকার হয়েছেন তিনি, যা তার জীবনকেই উল্টে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা ও ড. ইউনূসের বিবাদের মধ্যে পড়ে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে মনে করেন তিনি।
“সত্যিটা হলো আমি মুহাম্মদ ইউনূস এবং আমার খালার মধ্যে বিবাদের মধ্যে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।”
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভুল কাজের খেসারত তাকে দিতে হচ্ছে বলেও মনে করেন বঙ্গবন্ধুর এই নাতনি।
“নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে মানুষ ভুল কাজ করেছে এবং তাদের এর জন্য শাস্তি পাওয়া উচিৎ। কিন্তু আমি তাদের মধ্যে নেই।”
দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনার শাসনে জনগণের মধ্যে জমে থাকা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ গেত বছর বিস্ফোরিত হয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এই আন্দোলন দমনে তার সরকারের কঠোর নীতিতে কয়েকশ মানুষের মৃত্যু ঘটলে তা অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
তার পরিবারের জন্য সময়টা ভীতিকর ছিল বলে বর্ণনা করেন টিউলিপ, যার মায়ের প্রায় গোটা পরিবারকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়েছিল। সেই সময় একদল সেনা সদস্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করলেও বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
শেখ হাসিনা পরে আওয়ামী লীগের হাল ধরে প্রধানমন্ত্রী হন। শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যে থেকে তার তিন সন্তানকে বড় করে তোলেন। তাদের মধ্যে টিউলিপ দেশটির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পেরেছেন। ২০১৩ সালে ব্রিটিশ নাগরিক ক্রিস পার্সিকে বিয়ের পর এরই মধ্যে এক মেয়ে ও এক ছেলের মা হন তিনি।
খালা শেখ হাসিনাকে রক্ষা করা তার দায়িত্ব নয় মন্তব্য করে টিউলিপ বলেন, “আমি জানি তার সরকারের বিদায় কীভাবে হয়েছে। তা নিয়ে একটি তদন্ত চলছে। আমি সত্যিকারেই আশা করি, বাংলাদেশের মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত সমাধান পাবে।”
মন্ত্রিত্ব ছাড়লেও হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেট আসনে লেবার পার্টির এমপি পদে এখনও রয়েছেন টিউলিপ; ফলে তার রাজনীতির অভিযাত্রায় একটি ধাক্কা এলেও তা থেমে যায়নি এখনও।
বাংলাদেশে বিচার শুরুর প্রক্রিয়ায় আসামি হিসাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও তা নিয়ে শঙ্কিত নন এই ব্রিটিশ এমপি। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও বন্দি কিংবা আসামি বিনিময় চুক্তি না থাকাটা স্বস্তি দিচ্ছে তাকে।
টিউলিপ বলেন, “কোনও প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই, আমি নিজে দেখেছি, এমন কিছু নেই।”
প্লট দুর্নীতির যে মামলায় সোমবার বিচার শুরু হতে যাচ্ছে, তা ‘অযৌক্তিক’ বলে উড়িয়ে দেন যুক্তরাজ্যের এই আইনপ্রণেতা।
তিনি বলেন, “আমি হুগো কিথের (ব্রিটিশ আইনি পরামর্শক) কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছি। আমি এখনও কোনও সমন পাইনি।
“আমি ভিনদেশে একটি সাজানোর বিচারের কয়েক দিন দূরত্বে আছি, কিন্তু এখনও জানি না যে আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছে? আমার মনে হচ্ছে, আমি এই কাফকায়েস্কের দুঃস্বপ্নের মধ্যে আটকা পড়েছি, যেখানে আমাকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, অথচ আমি সত্যিই জানি না অভিযোগগুলো কী এবং কী বিচার হচ্ছে।”
বাংলাদেশে পূর্বাচলে রাজউকের প্লট দুর্নীতির ঘটনায় দুদক তিনটি মামলা করেছে টিউলিপের বিরুদ্ধে। টিউলিপের নামে কোনও প্লট নেওয়া না হলেও যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য হিসাবে তিনি ক্ষমতা ব্যবহার করে তার খালা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চাপ দিয়ে মা-বোন-ভাইয়ের নাম প্লটগুলো লিখিয়ে নিয়েছিলেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
এই মামলা দায়েরের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরের সময় তার সঙ্গে দেখা করতে চিঠি দিয়েছিলেন টিউলিপ। তখন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছিলেন, তারা চিঠি পেয়েছেন। তবে বিষয়টি আইনি এবং এটি আইনিভাবে সমাধান করা হবে।
টিউলিপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগও ওঠে। রাশিয়া এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। ২০১৩ সালে মস্কোতে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে খালা শেখ হাসিনার সঙ্গে টিউলিপও ছিলেন।
সেই সফর নিয়ে টিউলিপ বলেন, “আমার খালা রাষ্ট্রীয় সফরে রাশিয়া গিয়েছিলেন। আমার বোন ও আমি তাকে দেখতে লন্ডন থেকে রাশিয়া যাই। আমি কোনও ধরনের রাজনৈতিক আলোচনায় ছিলাম না। আমরা দর্শনীয় স্থান দেখছিলাম, রেস্তোরাঁয় যাচ্ছিলাম, কেনাকাটা করছিলাম।
“তারপর শেষ দিনে সমস্ত রাজনীতিবিদ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের একটি চা চক্র এবং সংবর্ধনা অনুষ্োনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং একটি ছবি তোলা হয়েছিল। আমি পুতিনের (রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) সাথে দুই মিনিটের জন্য দেখা করেছিলাম।”
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সময়ই অভিযোগ উঠেছিল, টিউলিপ ২০০৪ সালে তার খালার রাজনৈতিক সহযোগী আবদুল মোতালিফ নামে এক ব্যবসায়ীরে কাছ থেকে লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট উপহার নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দাবি করেছিলেন যে ফ্ল্যাটটি তার বাবা-মা তাকে উপহার দেন।
টিউলিপের ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও হ্যাম্পস্টেডের একটি ফ্ল্যাটের মালিক, তাও তিনি মুফতে পান মোমিন গণি নামে একজন আইনজীবীর কাছ থেকে। এই আইনজীবীও শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত।
নর্থ লন্ডনের ফিঞ্চেলিতে টিউলিপ ২১ লাখ পাউন্ডের যে বাড়িতে এখন ভাড়া থাকেন স্বামী-সন্তানকে নিয়ে, সেই বাড়ির মালিক আব্দুল করিম তার কাছ থেকে ভাড়া নেন না। এই আব্দুল করিম আবার যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা।
টিউলিপকে বিনা ভাড়ায় থাকতে দেওয়ার বিনিময়ে এই ব্যবসায়ীকে বাংলাদেশে সিআইপির মর্যাদা এবং একটি ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুযোগ শেখ হাসিনা করে দেন বলে অভিযোগ ওঠে।
এনিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ওঠার পর যুক্তরাজ্যের বিরোধীদলীয় সদস্যরা টিউলিপের পদত্যাগের দাবি তোলে। কারণ সিটি মিনিস্টার হিসাবে তার দায়িত্ব ছিল আর্থিক খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ।
অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে গেলেও সমালোচনার মুখে তিনি নিজেকে সপে দেন যুক্তরাজ্যের সরকারকে দায়িত্বশীল রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) লরি ম্যাগনেসের কাছে।
ম্যাগনাস তদন্তে টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কিংবা মন্ত্রীর আচরণবিধি ভঙ্গের কোনও প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানালেও প্রধানমন্ত্রী স্টারমারকে দেওয়া চিঠিতে লিখেছিলেন, বাংলাদেশে তার পরিবারের কারণে টিউলিপ সম্মানহানির ঝুঁকিতে রয়েছেন।
পারিবারিক সম্পর্কের কারণে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে বলে মনে করেন টিউলিপ; তিনি বলেন, কিন্তু এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার কোনও হাত থাকার সুযোগই নেই।
আট মাসের মাথায় পদত্যাগ করে স্টারমারকে পাঠানো চিঠিতে টিউলিপ লিখেছিলেন, যদিও তিনি মন্ত্রীর আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি, তবুও তার এই পদ ধরে রাখা সরকারের কাজের গতিতে প্রতিবন্ধকতা হবে। তাই তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত।
তবে স্টারমার তখন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে টিউলিপ আবার ফিরতে পারেন আগের ভূমিকায়।
টিউলিপের ভাষ্যে, “তিনি (স্টারমার) রসিকতা করে বলেছিলেন, “আগের প্রশাসনে, এমনকি যারা মন্ত্রীর আচরণবিধিও ভেঙেছিল, তারাও পদ ছাড়েনি। তুমি কি তা জান?’”
তথ্যসূত্র : গার্ডিয়ান