গেল ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়েছে। অর্জিত হয়েছে ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।
অর্থ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। আর প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাত্র ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল।
আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথ গতির কারণে প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছিল। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায়, বিশেষ করে কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ায় দ্বিতীয় প্রান্তিকের পর তৃতীয় প্রান্তিকেও প্রবৃদ্ধি বেড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা।
৩০ জুন শেষ হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থ বছর। অর্থাৎ চার প্রান্তিকই (১২ মাস, জুলাই-সেপ্টেম্বর, অক্টোবর-ডিসেম্বর, জানুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল-জুন) শেষ হয়েছে। সোমবার তৃতীয় প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) জিডিপির তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
কৃষি, শিল্প ও সেবা—এই তিন খাতের উপাত্ত নিয়ে জিডিপির তথ্য প্রকাশ করা হয়। গেল অর্থ বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও শিল্প খাতে কমেছে।
জানুয়ারি-মার্চ সময়ে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৪২ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে হয়েছিল ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র দশমিক ৭৬ শতাংশ।
তৃতীয় প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ; দ্বিতীয় প্রান্তিকে হয়েছিল ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ; প্রথম প্রান্তিকে হয়েছিল ২ দশমিক ৪১ শতাংশ।
জানুয়ানি-মার্চ প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে হয়েছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
বিবিএসের সংশ্লিষ্ট উইংয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকের সার্বিক চিত্র খুবই হতাশাজনক ছিল। তবে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ঘুরে দাঁড়ায়। তৃতীয় প্রান্তিকও মোটামুটি ভালো হয়েছে। এখন দেখা যাক, চতৃর্থ প্রান্তিক কেমন হয়।
“তবে চতৃর্থ প্রান্তিক যদি তৃতীয় প্রান্তিকের মতোও যায়; বা এর চেয়ে একটু ভালোও হয়। তাহলেও অর্থ বছর শেষে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের উপরে উঠবে না।”
গত ২৭ মে বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নয় মাস— গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছিল বিবিএস। তাতে দেখা যায়, গত অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
আগের অর্থ বছরে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের সাময়িক হিসাবে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছিল বিবিএস। তবে চূড়ান্ত হিসাবে তা কমে ৪ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে আসে।
গত বছরের জুলাইয়ে কোটাবিরোধী ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন হয়, তা ঠেকাতে একপর্যায়ে কারফিউ জারি করা হয়। তখন চলাচল সীমিত করা হয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে যায়। এরই এক পর্যায় ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়; ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই-আগস্টের এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
এখনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চিয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল দুই সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। কিছুদিন আগে এই তিন উন্নয়ন সংস্থাই বলেছে, অনিশ্চয়তার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অনেক কমবে।
আইএমএফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে গেলো অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, ৩ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে। এডিবি বলেছে, ৩ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল শেখ হাসিনার সরকার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে অন্তবর্তীকালীন সরকার।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে দেশের ভেতরে স্থিরমূল্যে ৮ লাখ ৯২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন হয়, যা গত সাত প্রান্তিকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত হিসাবে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে যদি ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অর্জিত হয়, সেটাও আমি ভালো বলে মনে করি। কেননা, একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। দেশে সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বিনিয়োগ। সহসা ভালো হওয়ারও কোনও লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “এরই মধ্যে ট্রাম্পের শুল্ক ধাক্কা লেগেছে দেশে। এই ধাক্কায় জুনে রপ্তানি আয় কমেছে। তার নেতিবাচক প্রভাব জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে পড়বে। সব মিলিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা।”
আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এই ঋণের পাঁচ কিস্তি ৩৬৫ কোটি (৩.৬৫ বিলিয়ন) ডলার ইতোমধ্যে পেয়েছে সরকার।
এই ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল তিন মাস পরপর জিডিপির হালনাগাদ হিসাব প্রকাশ করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমশক্তি জরিপও প্রান্তিকভিত্তিক করতে হবে।
সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই বিবিএস প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে। ইতোমধ্যে প্রান্তিকভিত্তিক শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ শুরু হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিক থেকে ত্রৈমাসিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে বিবিএস।
তার আগে পুরো এক বছরের হিসাব দিয়ে দুই বার জিডিপির তথ্য প্রকাশ করত বিবিএস। সংশ্লিষ্ট অর্থ বছরের প্রথম ছয়-সাত মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রথমে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধিসহ সাময়িক হিসাব দেওয়া হতো। পরে পুরো বছরের তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হত জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব।
সে হিসাবেই গত বছরের ২১ মে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হয়েছে বলে জানানো হয়।
পরে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করে বিবিএস। তাতে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জনের খাত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে বরাবরই দেখিয়ে আসছে।
২০০৮-০৯ অর্থ বছরে দেশে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে অর্জিত হয় ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ওই প্রবৃদ্ধি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।
পরের বছর কোভিড মহামারীর ধাক্কায় তা ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে তা আবার বেড়ে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছিল। পরের বছর (২০২১-২২) ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ১০ শতাংশে উঠলেও ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আবার কমে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে আসে।
গত ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছে অন্তবর্তী সরকার।