Beta
বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৫

ইউটিউবের দল কীভাবে সাফল্য পেল জাপানের নির্বাচনে

kamia
[publishpress_authors_box]

দলটির প্রধান একটি সুপার মার্কেটের সাবেক ম্যানেজার। কোভিড মহামারির সময় ইউটিউবে ‘জাপানিজ ফার্স্ট’ স্লোগান নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গড়েন।

এখন সেই ইউটিউব থেকে শুরু হওয়া দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট দল সানসেইতো জাপানের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত জয় পেয়ে সামনে এসেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গড়ে ওঠা অন্যান্য পপুলিস্ট ও দক্ষিণপন্থী দলের মতো সানসেইতোও সেসব থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। জাপানের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে জানায়, এবারের উচ্চকক্ষ নির্বাচনে দলটি ১৪টি আসন পেয়েছে। এর আগের নির্বাচনে দলটি মাত্র একটি আসন পেয়েছিল।

২৪৮ আসনের উচ্চকক্ষে সানসেইতোর পাওয়া আসন সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবুও এটি স্পষ্ট, সানসেইতো যে বার্তা দিচ্ছে, তা জাপানি জনগণের একটি অংশের কাছে সমর্থন পাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে এই অপ্রত্যাশিত সাফল্য। তার দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) এই নির্বাচনের পর এখন উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। ফলে ইশিবার পদত্যাগের দাবি উঠেছে। যদিও তিনি এখনও পদ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

ইন্টারনেটে জন্ম

সানসেইতো’র উত্থান বিশেষভাবে নজর কাড়ে এর ব্যতিক্রমধর্মী উৎপত্তির কারণে। দলের প্রধান সোহেই কামিয়া ২০২০ সালে ‘ইন্টারনেটে মানুষ জড়ো করে’ দলটি গঠন করেন। এরপর স্থানীয় পরিষদগুলোতে ধীরে ধীরে আসন পেতে শুরু করেন। চলতি মাসের শুরুতে দেওয়া একটি ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। সোমবার পর্যন্ত দলের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি।

দলটি মূলত মহামারির সময় জনপ্রিয়তা পায়। ওই সময় তারা টিকা নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব এবং আন্তর্জাতিক অভিজাতদের গোপন পরিকল্পনা নিয়ে প্রচার চালায় বলে রয়টার্স জানিয়েছে।

তবে উচ্চকক্ষ নির্বাচন সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা “জাপানিজ ফার্স্ট” স্লোগান দিয়ে বেশি পরিচিতি পেতে শুরু করে। সেখানে তারা অতিরিক্ত পর্যটন ও বিদেশি অভিবাসীদের আগমনের বিরুদ্ধেই কথা বলেছে।

বিষয়গুলো বর্তমানে বেশ সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জাপান ঐতিহ্যগতভাবে অভিবাসনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি বজায় রাখত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা বয়স্ক জনসংখ্যা ও নিম্ন জন্মহার মোকাবেলায় বিদেশি পর্যটক ও কর্মী আকর্ষণের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে।

এতে কিছুটা ফলও এসেছে।

জাপানে গত দশকে বিদেশি বাসিন্দার সংখ্যা ২২ লাখ ৩০ হাজার থেকে বেড়ে ৩৭ লাখ ৭০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। আর এটি এখনও ১২ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ।

পর্যটকের সংখ্যাও বারবার রেকর্ড ভেঙেছে। এর ফলে কিছু শহর পর্যটকে ভরে গেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে অসভ্য আচরণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় বাড়ছে। যেমন গরম পানির ঝরনাগুলোর ওপর চাপ।

অনেকেই মনে করছেন, জাপানে বিদেশির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এমনকি সরকারও এই ইস্যু নিয়ে কাজ করতে একটি নতুন টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে।

সানসেইতো এই জনঅসন্তোষকে কাজে লাগিয়েছে তাদের “জাপানিজ ফার্স্ট” প্রচারে। তারা শুধু বিদেশি ইস্যু নয়, বরং মজুরি স্থবিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে নাগরিকদের অভিযোগও তুলে ধরে।

জুলাইয়ে দেওয়া এক বক্তৃতায় কামিয়া বলেন, “এখন জাপানি মানুষের জীবন দিনে দিনে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নেই, ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে।”

তিনি সতর্ক করে বলেন, “জাপানে আরও বেশি বিদেশি আসছে।” তিনি জানান, পর্যটক নিয়ে তার আপত্তি নেই। তবে সস্তা বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরতা জাপানি মজুরি হ্রাস করবে এবং যারা ভাল চাকরি পাবে না, তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।

সানসেইতো চায় প্রতিটি শহর বা অঞ্চলে বিদেশি বাসিন্দার সংখ্যা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা হোক। তারা অভিবাসন নীতিতে আরও কঠোরতা, বিদেশিদের জন্য সুযোগ-সুবিধা কমানো এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া কঠিন করার পক্ষপাতী।

এছাড়াও দলটি নিরাপত্তা ও গুপ্তচরবৃত্তি প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি জানায়। তারা কর কমানোর পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির পক্ষে এবং এমন এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চায়, যা টিকা থেকে কিছুটা সরে আসবে।

প্রতিরক্ষা খাতে তাদের দাবি আরও জোরালো। দলটি মনে করে, জাপান পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত দেশগুলো দিয়ে ঘেরা। তাই দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় একটি “প্রতিরোধ ক্ষমতা” গড়ে তোলা প্রয়োজন। যদিও দীর্ঘমেয়াদে তারা নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে।

‘মাগা’র সঙ্গে তুলনা

সোহেই কামিয়ার দল সানসেইতোকে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন (মাগা)’ আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করছেন। একইসঙ্গে এর তুলনা করা হচ্ছে জার্মানির ডানপন্থী দল এএফডি ও যুক্তরাজ্যের রিফর্ম ইউকে দলের সঙ্গেও।

জাপান সোসাইটি নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থার প্রধান জোশুয়া ওয়াকার রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সানসেইতো এখন প্রচণ্ড আলোচিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, কারণ এর মূল বার্তাগুলো পপুলিস্ট ও বিদেশিবিরোধী।”

তিনি আরও বলেন, “এটা সানসেইতো’র শক্তি যতটা না, তার চেয়ে বেশি হলো এলডিপি ও ইশিবার দুর্বলতার প্রতিফলন।”

তবে দলটির নীতিমালার কারণে অনেকেই সানসেইতোকে ‘বিদেশিবিদ্বেষী’ ও বৈষম্যমূলক বলে সমালোচনা করেছেন। নির্বাচনের আগে কামিয়া দলের কিছু বিতর্কিত অবস্থান কিছুটা নরম করার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে নারী ভোটারদের আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন বলে রয়টার্স জানিয়েছে।

তবে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর কামিয়ার বক্তব্য ছিল বিজয়ী ও আত্মবিশ্বাসী। রয়টার্সের তথ্যমতে, তিনি বলেন, “জনগণ এখন বুঝতে পেরেছে যে প্রচারমাধ্যম ভুল বলছিল এবং সানসেইতো ঠিক ছিল।”

ইশিবার ভবিষ্যৎ কী

নির্বাচনের ফলাফল প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার জোট সরকারকে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।

এরইমধ্যে গত অক্টোবরে তিনি পার্লামেন্টের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন। গত ১৫ বছরে এটি ছিল প্রথমবার এবং জাপানি ভোটারদের কাছ থেকে এলডিপির জন্য এটি একটি স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান।

সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ইশিবা স্বীকার করেন, উচ্চকক্ষ নির্বাচনের ফলাফল তাদের দলের জন্য ছিল “একটি কঠিন রায়।” তিনি দলের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, তাদের জোটসঙ্গী দলের সঙ্গে মিলেই তারা সরকার চালিয়ে যাবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অন্য দলের সঙ্গেও সহযোগিতা করবেন।

এর আগে রবিবার ভোট গ্রহণ শেষে এনএইচকে’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী ও এলডিপি দলের নেতা হিসেবে দায়িত্বে থাকবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান শুল্ক আলোচনার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেন।

কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বশেষ বাণিজ্যনীতির আওতায় ১ আগস্ট থেকে জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক বসতে যাচ্ছে।

সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে ইশিবা বলেন, তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব কথা বলতে চান, যাতে একটি সমাধানে পৌঁছানো যায়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত