চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৬২৭ কোটি (৬.২৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা ছিল একক মাসের হিসাবে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি; গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে বেড়েছিল ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল দেশে। গত অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে ৪৩৯ কোটি ১১ লাখ (৪.৩৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। ওই অঙ্ক ছিল ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের ১২ মাসের মধ্যে (জুলাই-জুন) সবচেয়ে কম।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে হঠাৎ করে আমদানি বাড়ায় ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা আশা করেছিলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যে মন্দা দেখা দিয়েছিল, তা কেটে যাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। এক মাস না যেতেই ফের হোঁচট খেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ৫২২ কোটি ২৭ লাখ (৫.২৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে ১০৪ কোটি ৭৮ লাখ (১.০৫ বিলিয়ন) ডলার কম। শতাংশ হিসাবে কমেছে ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ।
আর গত আগস্টের চেয়ে কমেছে ১ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের আগস্ট মাসে ৫২৭ কোটি ১৫ লাখ (৫.২৭ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও শিল্পর কাঁচামাল আমদানি হয়েছিল।
এরই মধ্যে গত ১৮ অক্টোবর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দেশের আমদানি-রপ্তানি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। আমদানি করা অনেক পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল পুড়ে গেছে। এতে আমদানিকারকরা আর্থিকভাবে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। যার নেতিবাচক প্রভাব আগামী মাসগুলোতে আমদানিতে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম দুই মসের (জুলাই-আগস্ট) হিসাবে অবশ্য আমদানি ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এই দুই মাসে মোট ১ হাজার ১৪৯ কোটি ৩২ লাখ (১১.৪৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আমদানির অঙ্ক ছিল ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট সময়ে পণ্য আমদানির জন্য ১১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা গত বছরের একই সময়ে চেয়ে ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।
আর এলসি নিম্পত্তি হয়েছে ১১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের; বেড়েছে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।
গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে ৪৩৯ কোটি ১১ লাখ (৪.৩৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। যা ছিল ওই আর্থিক বছরের ১২ মাসের মধ্যে (জুলাই-জুন) সবচেয়ে কম। আগের মাস মে মাসের চেয়ে কম ২৪ দশমিক ১২ শতাংশ। আর গত বছরের শেষ মাস জুনের চেয়ে কম ছিল প্রায় ২৭ শতাংশ কম।
গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে সমালোচনার জবাবে উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দেখিয়ে আসত আওয়ামী লীগ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে তাদের সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে যে অস্থিরতা চলছে, তার মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা না কাটলে আমদানি বাড়বে না বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা নেতারা।
শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে কেউ বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। এ কারণেই আমদানি কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে দেশে মোট ৬ হাজার ৮৩৫ কোটি (৬৮.৩৫ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। আগের অর্থ বছরে (২০২৩-২৪) আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬৭২ কোটি (৬৬.৭২ বিলিয়ন) ডলার।
হিসাব বলছে, গত অর্থ বছরে আমদানি বেড়েছিল মাত্র ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
তবে গত অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে আমদানি তলানিতে নেমে আসে। ওই মাসে ৪৩৯ কোটি ১১ লাখ (৪.৩৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়। যা ওই আর্থিক বছরের ১২ মাসের মধ্যে (জুলাই-জুন) সবচেয়ে কম। আগের মাস মে মাসের চেয়ে কম ২৪ দশমিক ১২ শতাংশ। আর গত বছরের শেষ মাস জুনের চেয়ে কম প্রায় ২৭ শতাংশ কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে ৫৯৮ কোটি ৮১ লাখ (প্রায় ৬ বিলিয়ন) পণ্য আমদানি হয়েছিল। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। আগের বছরের জুলাইয়ের চেয়ে কমেছিল ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
দ্বিতীয় মাস আগস্টে আমদানির অঙ্ক ছিল ৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দশমিক ৪৬ শতাংশ। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক শূন্য নয় শতাংশ; আমদানির অঙ্ক ছিল ৫ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
অক্টোবরে ৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়; বেড়েছিল ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। নভেম্বরে আমদানি ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ কম হয়; আমদানির অঙ্ক ছিল ৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বরে আমদানি বাড়ে ২৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ; ৬ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে আমদানি বাড়ে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ; ৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। ফেব্রুয়ারিতে আমদানির অঙ্ক ছিল ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ; বাড়ে ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ। মার্চে আমদানির অঙ্ক ছিল ৫ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয় ১৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।
তবে এপ্রিল মাসে আমদানি ২ দশমিক ৯২ শতাংশ কমে যায়; আমদানি হয় ৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। মে মাসে আমদানির অঙ্ক ছিল ৫ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার; বাড়ে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
ডলার সংকট অনেকটা কেটে গেছে; দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ-উৎকণ্টার মধ্যে থাকা বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেড়েছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়– এমন পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করেই চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটও কাটেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
আগামী দিনগুলোতে কী হবে– এ নিয়ে চিন্তার মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা। সবার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর এসব কারণে দেশে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। ফলে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ মন্থর হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা দেখা যায়, গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সামগ্রিক আমদানি ব্যয় বেড়েছে আড়াই শতাংশের মতো। ভোগ্যপণ্য এবং খাদ্যশস্যের আমদানি বেড়েছে। তবে কমেছে মূলধনী পণ্য আমদানি। গত অর্থ বছরে মূলধনী পণ্যের আমদানি ১০ শতাংশ কমেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ১৯ শতাংশের বেশি।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে চালের আমদানি সবচেয়ে বেড়েছে। গত অর্থ বছর ৬৮ কোটি ২৪ লাখ ডলারের চাল আমদানি হয়েছে। আগের অর্থ বছরের তুলনায় যা প্রায় ২৬ গুণ বেশি। এর আগের অর্থ বছরে দুই কোটি ৫৪ লাখ ডলারের চাল আমদানি হয়।
তবে গমের আমদানি ২০ শতাংশ কমে ১৬২ কোটি ডলারে নেমেছে। ভোজ্যতেলের আমদানি প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়ে ২৭১ কোটি ডলার হয়েছে। ডালের আমদানি বেড়েছে ৩৪ শতাংশের বেশি। তবে মসলার আমদানি সাড়ে ৪ শতাংশ কমে ৪৬ কোটি ডলারে নেমেছে। চিনির আমদানিও সাড়ে ৪ শতাংশ কমে ১১০ কোটি ডলারে নেমেছে।
গত অর্থ বছরে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকসংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানি ১০ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৮৪৪ কোটি (১০.৮৪ বিলিয়ন) ডলার হয়েছে। টেক্সটাইলসংশ্লিষ্ট কাঁচামালের আমদানি ১৬ শতাংশ বেড়ে ৮৯৬ কোটি (৮.৯৬ বিলিয়ন) ডলার হয়েছে। সূতা আমদানি ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়ে ৩৬২ কোটি (৩.৬২ বিলিয়ন) ডলার হয়েছে।
তবে পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানি ১৬ শতাংশ কমে ৫১৪ কোটি (৫.১৪ বিলিয়ন) ডলারে নেমেছে। অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের আমদানি প্রায় ৩৪ শতাংশ কমে ৬২ কোটি ডলার হয়েছে। তুলা আমদানি ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ কমে ৩৪৬ কোটি ডলারে নেমেছে। সব মিলিয়ে মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি বেড়েছে ২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ দশমিক ৭২ শতাংশ বাড়লেও নিস্পত্তি কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ।
অন্যদিকে মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। নিস্পত্তি কমেছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
তবে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেল আমদানির এলসি ও নিস্পত্তি বেড়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংকট, উচ্চ সুদসহ বিভিন্ন কারণে সামগ্রিক আমদানিতে প্রবৃদ্ধি এখন কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিচ্ছে। যে কারণে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর থেকে এক অঙ্কের ঘরে নামলেও নীতি সুদহার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখেছে।
মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে না নামা পর্যন্ত নীতি সুদহার কমানো হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। গত ৩১ জুলাই চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় তিনি এই ঘোষণা দেন।
২০২০ সালের করোনাপরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। এর পরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বিভিন্ন নীতিসহায়তা দেয় সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার অনেক বাড়লেও দেশে ৯ শতাংশের সীমা রাখা হয়। ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে কম সুদের ঋণসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়।
এতে করে দেশ থেকে অর্থ পাচার ব্যাপক বেড়ে যায়। যে কারণে ২০২১ সালের ৮৪ টাকা দরের ডলার উঠে যায় ১২২ টাকায়। আবার ওই সময়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়ানো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গত বছরের জুলাইতে ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়নে নেমে আসে।
তবে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার। এতে করে ডলারের দর স্থিতিশীল রয়েছে। বরং দাম কমে ১১৯ টাকা ৫০ পয়সায় নেমেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে তা ১২২ টাকা হয়েছে।
গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ; নিস্পত্তির পরিমাণ কমেছে ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ।
গত অর্থ বছরে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য ১৭৪ কোটি ৫৫ লাখ (১.৭৪ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের এই অঙ্ক ছিল ২৩৩ কোটি ৯৯ লাখ (২.৩৪ বিলিয়ন) ডলার।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ১৯৮ কোটি ৫১ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলারের এলসি নিস্পত্তি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে নিস্পত্তির অঙ্ক ছিল ২৬৬ কোটি ১৬ লাখ (২.৬৬ বিলিয়ন) ডলার।
অন্যদিকে গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র ৬৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। যা দুই দশক বা ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
সব মিলিয়ে দেশে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে; ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা নিয়ে চিন্তায় আছেন উদ্যোক্তারা।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। সেই খাতে ঋণপ্রবাহ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ার অর্থ হলো বিনিয়োগ থমকে যাওয়া। আর বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে না। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
দেশের সার্বিক আমদানি পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের সঙ্গে।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সার্বিক চিত্র উন্নতি হয়েছে। তবে সূচকগুলোর উন্নতির সঙ্গে রয়েছে কিছু নেতিবাচক দিক। আর বর্তমানে যেসব সূচক উন্নতি হয়েছে, সামনে নেতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
জাহিদ হোসেন বলেন, “অবস্থা অনেকটা স্বস্তিদায়ক দেখা যাচ্ছে। চলতি ও আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে যে ঘটনা, সেখানে কিছু ইতিবাচক কারণ আছে; আবার নেতিবাচক কারণও আছে। ইতিবাচকের মধ্যে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল। তার চেয়ে বড় কারণ ছিল রেমিটেন্সের উল্লম্ফণ। এ কারণে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে।
“তবে এখানে নেতিবাচক হচ্ছে আমদানি বাড়ছে না। জুন মাসে আমদানি একেবারেই কমে গিয়েছিল: জুলাইয়ে বেশ খানিকটা বেড়েছিল। আগস্টে আবার কমে গেছে। এটার প্রধান কারণ হচ্ছে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। বিনিয়োগের স্থবিরতা তো অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য শুভ নয়।”
বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ সামনেও ধরে রাখতে হবে। নাহলে চাপের মধ্যে পড়ার শঙ্কা রয়েছে বলেও মনে করেন জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে ধরে যদি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন, তখন আমদানি বাড়বে। তখন চলতি হিসাবে আর উদ্বৃত্ত থাকবে না। সেটা বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চাপ তৈরি করতে পারে। সেই চাপটা মোকাবেলার জন্য যোগানে যে উন্নতি হয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে।
“বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেটা বেড়েছে, তা কোনও নীতি নেওয়ার জন্য হয়নি। আসলে এটা হয়েছে সরকার পরিবর্তনের কারণে। কারণ যারা টাকা পাচার করতেন, তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। যে কারণে হুন্ডি বাজারে মন্দা এসেছে। তাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স বেড়েছে।”
জাহিদ হোসেন বলেন, “ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমা মানে, ভবিষ্যতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। নতুন কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নতুন সরকার আসার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “স্বাভাবিক কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছেন। পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হবে, তখন আবার আমদানি করবেন। কিন্তু কবে স্বাভাবিক হবে, সেটাই এখন বড় বিষয়।”
“দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এখন বিনিয়োগের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। আর এ জন্য আমদানি বাড়াতে হবে। সামনে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তাদের এ বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে,” বলেন জাহিদ হোসেন।
পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দর বৃদ্ধি– একের পর এক ধাক্কায় বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পোশাক শিল্পের অস্থিরতা চলছে। ট্রাম্প শুল্ক কমায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হলে আমদানি বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।”
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ডলার-সংকট কেটে গেছে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া একটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এখন আমদানিতে আরোপিত সব বিধিনিষেধ তুলে দিলে অর্থনীতি গতি পাবে। এতে সংকট কেটে যাওয়ার বার্তা যাবে। ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর আস্থা বাড়াবে।”
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিক একটি হিসাব দিয়েছেন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
গত সোমবার (২০ অক্টোবর) সোনারগাঁও হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, কার্গো ভিলেজের ভয়াবহ আগুনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা।
উদ্বেগ প্রকাশ করে হাতেম বলেন, “কার্গো ভিলেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন শনাক্ত ও প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে দেশের আমদানি-রপ্তানি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য এক বড় সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা শঙ্কিত এবং আমাদের বৈদেশিক ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন।
“এই ধরনের ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট কার্যকর নয় এবং এটি নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একইভাবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।”
হাতেম বলেন, “অনেক বছর ধরে আমরা রপ্তানিকারকরা অভিযোগ করে আসছি যে, আমাদের পণ্য ও মালামাল খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়, সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই এবং প্রায়ই আমদানিকৃত মালামাল চুরি হয়। এটি শুধু ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণ নয় বরং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে।”