তামিলনাড়ুর কারুরের এই পদদলন কি এড়ানো যেত, বাঁচানো কি যেত ১০ শিশুসহ ৩৯টি প্রাণ? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকে ‘হ্যাঁ’ই বলছেন। তাহলে কার দোষে? অভিযোগের আঙুলটি বিজয় থালপতি এবং তার দল তামিলাগা ভেট্রি কাজাগমের (টিভিকে) দিকেই।
তামিলনাড়ুতে চলচ্চিত্র তারকারা ভক্তদের কাছে ঈশ্বরতুল্য। তা এমজি রামচন্দ্রন (এমজিআর), রজনীকান্তের পর হালের অ্যাকশন হিরো বিজয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রুপালি পর্দার জনপ্রিয়তাকে রাজনীতির কঠিন মাঠে সফলভাবে অনুবাদ করেছিলেন এমজিআর, হয়েছিলেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী।
চলচ্চিত্রের সাফল্যে ভর করে রাজনীতির মাঠে নেমেছেন বিজয়ও। তবে শনিবার রাজ্যের কারুরে তার সমাবেশে পদদলিত হয়ে ৩৯ মৃত্যুর ঘটনা শুরুতেই কাঁটা বিঁধিয়ে দিল তার নতুন অভিলাষে।
আগামী বছরের প্রথম দিকে অনুষ্ঠেয় তামিলনাড়ু রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে দল গঠন করে প্রচার চালাচ্ছেন বিজয়।
ঘটেছিল কী?
এমজিআর ও জয়ললিতা তাদের চলচ্চিত্রখ্যাতিকে বহু দশকের রাজনৈতিক ক্ষমতায় রূপান্তর করেছিলেন। ৫১ বছর বয়সী বিজয় এখন রাজনীতিতে নেমে জাতপাত ও শ্রেণিভেদ অতিক্রম করে বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন তামিলনাড়ুতে। বিশেষত তরুণদের মধ্যে।
গত আগস্টের সফল সমাবেশের পর তার দল টিভিকে শনিবার কারুরে সমাবেশ ডাকে। সেখানে পদদলনের ঘটনায় কমপক্ষে ৩৯ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি শতাধিক আহত হয়।
তামিলনাড়ুর পুলিশের মহাপরিচালক জি ভেঙ্কটরমন বলছেন, আয়োজকরা ১০ হাজার জনসমাগম আশা করছিল। কিন্তু সেখানে ২৭ হাজার মানুষ উপস্থিত হয়। সমাবেশের জন্য ৫০০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছিল, যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
নামাক্কাল এলাকায় সমাবেশ করে ছাদখোলা বাসে কারুর রওনা হন বিজয়। সেই বাসের চারপাশ ঘিরে তার সমর্থকরাও নামাক্কল থেকে কারুরের দিকে চলছিল। অন্যদিকে কারুরে আগে থেকে অবস্থান করছিল হাজার হাজার মানুষ।
বিজয়কে দেখতে সমাবেশস্থলের আশপাশের গাছের ডালেও অনেকে চড়ে বসেছিলেন। কিন্তু ডাল ভেঙে পড়ে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল।
ভিডিওগুলিতে দেখা যায়, তার চারপাশে বিশৃঙ্খলার মধ্যেই বিজয় বক্তৃতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কেন এত মৃত্যু?
তামিলনাড়ুর পুলিশ প্রধান ভেঙ্কটরমনের মতে, সমাবেশে আসতে বিজয়ের সাত ঘণ্টা দেরি অনিয়ন্ত্রিত ভিড় তৈরি করে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
তিনি বলেন, টিভিকে তাদের অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে ঘোষণা করেছিল যে বিজয় দুপুর ১২টার মধ্যে সমাবেশস্থলে পৌঁছাবেন। ফলে দুপুরের আগে থেকেই ভিড় শুরু হয়।
তবে সমাবেশের জন্য পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল বিকাল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। তবে বিজয় ৩টায়ও পৌঁছতে পারেননি।
“কিন্তু তিনি আসেন সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে। প্রখর রোদের মধ্যে লোকজনের পর্যাপ্ত খাবার ও পানির অভাব ছিল,” বলেন পুলিশ কর্মকর্তা ভেঙ্কটরমন।
বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষ বিজয়ে গাড়ি ঘিরে আছে, তিনি তার ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন।
কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, গরমে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়া সমর্থকদের দিকে জলের বোতল ছুড়ছেন বিজয়। এক পর্যায়ে ভিড় অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লে পুলিশের সাহায্য চাইছেন তিনি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুর্গাদেবী বিবিসিকে বলেন, “কারও কাছে খাবার বা পানি ছিল না। আমি নিজের চোখে দেখেছি, বাচ্চারাও অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল।”
পদদলনের ঘটনার শুরুটা কীভাবে- সে প্রশ্নে ভেঙ্কটরমন বলেন, “ঠিক কী কারণে পদদলন শুরু হয়েছিল, তা এখনই বলা কঠিন। তবে টিভিকের আগের সমাবেশগুলোর তুলনায় এবার ভিড় বেশি ছিল।”
কেন সমালোচনা?
বিজয় এবং তার দলের নেতাদের এটা জানা ছিল যে তাকে ঘিরে ভক্তদের উন্মাদনা হবেই, ফলে পদদলনের ঝুঁকি থেকেই যায়।
বিজয়ের ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী প্রায় দেড় বছর আগে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই এই বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, তারা ভয় পাচ্ছেন যে ভক্তদের উন্মাদনা না পদদলনের দিকে নিয়ে যায়। তাই তাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে বিজয়কে প্রচারে আনা।
তামিলনাড়ুতে অভিনেতাদের দেবতার মূর্তিতে বসিয়ে পূজা করার চলও রয়েছে। এখন বিজয়ের জনপ্রিয়তা এতটাই যে ভক্তরা তার সিনেমার ট্রেলার দেখার জন্যও টিকেট কেনে।
বিজয়ের ভিড় টানার ক্ষমতা ব্যবহার করলেও তার ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে তার দলের নেতাদের উদাসীন থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা।
চেন্নাইয়ের প্রবীণ সাংবাদিক টি আর জওহর লিখেছেন, “আমি বিজয়কে ক্ষয়ক্ষতি এবং বিপদের ঝুঁকি ছাড়া অন্য কোনও চোখে দেখতে পারিনি। তার উন্মত্ত ভক্তদের পরিচিত গোঁড়ামির কারণে তিনি রাজ্যের শান্তি ও জনশৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছিলেন।”
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন এই পদদলনের সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে এক সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।
কারুরের মানুষ এই কারণেও ক্ষুব্ধ যে বিজয় দুর্ঘটনার মাত্রা সম্পর্কে জানার পরও ঘটনাস্থল ছেড়ে চেন্নাই চলে যান।
জনবহুল ভারতে তিন মাস আগে গত জুনে বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে আরসিবির বিজয় সমাবেশে পদদলনে ১১ জন মারা গিয়েছিল। তার আগে মে মাসে গোয়ার শিরগাঁওয়ের একটি মন্দিরে পদদলনে ছয়জন নিহত হয়। মে মাসে নয়াদিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে পদদলনে নিহত হয়েছিল ১৮ জন। জানুয়ারিতে মহাকুম্ভে পদদলনে কমপক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়েছিল।
বিজয় যে ভক্তদের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করেন, তা জানার পরও তিনি ও তার দল কিংবা প্রশাসন আগাম সতর্কতা না নেওয়ায় ৩৯টি প্রাণ ঝরে গেল বলে সমালোচনা হচ্ছে।
ভিড় বাড়ানোর কৌশল হিসাবে বিজয় সমাবেশে দেরিতে এসেছিলেন কি না, তাও তদন্ত করতে বলা হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অরুণা জগদীসানের তদন্ত কমিশনকে।
বিজয় কী বলছেন?
পদদলনের একদিন পর রবিবার এক্স-এ এক পোস্টে বিজয় লেখেন, “গতকাল কারুরে যা ঘটেছে, তা কল্পনাকেও হার মানায়। আমার হৃদয় ভেঙে গেছে; আমি অসহনীয়, অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ও শোকে আছি।
“কারুরে যারা আমার প্রিয় ভাই ও বোনদের হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা ও সহানুভূতি জানাই। হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন, তাদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য আমি প্রার্থনা করি।”
পদদলনে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিজয়।
তথ্যসূত্র : ইন্ডিয়া টুডে, এনডিটিভি