ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার গাজা যুদ্ধের অবসান নিয়ে আলোচনার মধ্যেই এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে সোশাল মিডিয়া এক্সে একটি ছবি পোস্ট করলেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি নিজ হাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গলায় বিশাল এক নোবেল শান্তি পুরস্কারের মেডেল ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। তিনি ক্যাপশনে লিখেছেন, “তিনি এটির প্রাপ্য!”
এই মক-আপ পোস্টটি ছিল এক আন্তর্জাতিক প্রচারের অংশ। আর এর লক্ষ্য নরওয়ের পাঁচ সদস্যের গোপন কমিটিকে রাজি করানো যাতে যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
ট্রাম্প নিজে এই পুরস্কার নিয়ে বহুদিন ধরে আসক্ত। কয়েক মাস ধরে তার দেশীয় সমর্থকরা ও কিছু আন্তর্জাতিক নেতা (যারা তার অনুগ্রহ লাভ করতে চান) এই প্রচারে সরব হয়েছেন। কিন্তু শুক্রবার যখন কমিটি এই বছরের বিজয়ীর নাম ঘোষণা করবে, বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই প্রয়াস সম্ভবত ব্যর্থ হবে।
পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অসলোর পরিচালক নিনা গ্রেগার বলেন, “এ ধরনের প্রকাশ্য প্রার্থীতা ও প্রচার আমরা খুব কমই দেখি।” তার ভাষায়, শান্তি পুরস্কার “দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই শান্তিকে সম্মান জানায়। তিনি বলেন, “এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি মনে করি না যে ট্রাম্প এ বছর এটি পাবেন।”
তবে ট্রাম্পের এই অপ্রচলিত প্রচার সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয়। প্রেসিডেন্ট নিজে, তার সমর্থকরা, বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান এবং গাজার জিম্মি পরিবারগুলো পর্যন্ত যুক্তি দিচ্ছেন যে গাজা, ইউক্রেন এবং আরও কিছু অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তার ভূমিকা বিবেচনার দাবিদার। তারা উল্লেখ করেছেন, ট্রাম্প রুয়ান্ডা ও কঙ্গো, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তান, সার্বিয়া ও কসোভো, মিশর ও ইথিওপিয়া, এবং আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি প্রচেষ্টাতেও ভূমিকা রেখেছেন।
যদি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে, তবে ট্রাম্পের এই প্রচার যতই অপ্রচলিত হোক, তা অনেকের কাছে যথাযথ বলে মনে হতে পারে।
হোয়াইট হাউসে বৃহস্পতিবার ট্রাম্প বলেন, “আমি সাতটা চুক্তি করেছি, আর এগুলোই শেষ করেছে যুদ্ধগুলো। একটা ৩১ বছর ধরে চলছিল, একটা ৩৪, একটা ৩৫, আরেকটা ১০ বছর। আমি সাতটা চুক্তি করেছি। এটা হবে অষ্টম।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমি জানি না নোবেল কমিটি কী করবে, কিন্তু আমি এটা জানি, মানব ইতিহাসে কেউ নয় মাসে আটটা যুদ্ধ শেষ করতে পারেনি।”
ট্রাম্পের এই প্রচার বিদেশি নেতা ও দেশীয় রাজনীতিকদের কাছে তার প্রশংসা আদায়ের এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে।
গত আগস্টের এক মন্ত্রিসভা বৈঠকে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফ বলেন, তার একটাই ইচ্ছে “যে নোবেল কমিটি অবশেষে বুঝুক এবং স্বীকার করুক যে আপনি এই পুরস্কার প্রবর্তনের পর থেকে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী।”
গাজায় বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবারের কিছু সদস্যও ট্রাম্পের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তারা নোবেল কমিটিকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, “গত এক বছরে কোনও নেতা বা প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে বেশি শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেননি। অনেকে শান্তি নিয়ে সুন্দরভাবে কথা বলেছেন, কিন্তু তিনিই সেটি বাস্তবে অর্জন করেছেন। অনেকে ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু তিনি বাস্তব ফল এনে অসংখ্য প্রাণ বাঁচিয়েছেন।”
তবুও বিশ্লেষকদের মতে, শেষ মুহূর্তের এই তৎপরতা কমিটির সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলবে না।
নরওয়ের পার্লামেন্টের নিয়োগপ্রাপ্ত পাঁচ সদস্যের এই কমিটিতে মনোনয়ন দিতে পারেন সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, বর্তমান বা সাবেক কমিটি সদস্য এবং অতীতের নোবেল বিজয়ীরা। তবে কেউ নিজেকে মনোনীত করতে পারেন না।
এ বছর সেপ্টেম্বর থেকে কমিটি মোট ৩৩৮টি মনোনয়ন পেয়েছে। এর মধ্যে ২৪৪ জন ব্যক্তি ও ৯৪টি সংস্থা। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৮৬। আর সর্বকালের রেকর্ড ২০১৬ সালে, ৩৭৬ জন প্রার্থী।
এই বছরের মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ৩১ জানুয়ারি। অর্থাৎ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেওয়ার ১১ দিন পর। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কমিটি তালিকাটি সংকুচিত করে সাধারণত ২০ থেকে ৩০ জনে নামিয়ে আনে। তবে কমিটি কখনোই প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করে না।
সম্ভবত ট্রাম্পের আকাঙ্ক্ষাকে আরও উসকে দিয়েছে বারাক ওবামার উদাহরণ। ওবামা তার প্রথম মেয়াদের মাত্র নয় মাস পর, ২০০৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। কমিটির ভাষায়, তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে “একটি নতুন পরিবেশ” সৃষ্টি করেছিলেন।
অনেক রিপাবলিকান তখন কমিটিকে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন। কারণ তার দুই বছর আগে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরও জলবায়ু পরিবর্তন সচেতনতার জন্য একই পুরস্কার পান। তাদের মতে, ওবামা বা গোর কেউই তেমন কোনও প্রকৃত শান্তি অবদান রাখেননি।
গত বছরের নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, “যদি আমার নাম ওবামা হতো, আমি ১০ সেকেন্ডেই নোবেল পেতাম।”
তার প্রথম মেয়াদেই মিত্ররা ট্রাম্পকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিলেন। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠকের পর, যখন তিনি দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি সীমিত করতে চেষ্টা করেন, তখনই প্রথমবার তার নাম যায়। পরে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের পরেও (যে ঐতিহাসিক চুক্তি ইসরায়েল ও একাধিক আরব দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে) তার নাম ওঠে আলোচনায়।
নরওয়ের পার্লামেন্টের এক সদস্য ২০২১ সালের পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেন, যা পরে ফিলিপাইনসের সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও রাশিয়ার দিমিত্রি মুরাতভ পান।
ডিনামাইট আবিষ্কারক সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল তার উইলে লিখেছিলেন, শান্তি পুরস্কার দেওয়া হবে সেই ব্যক্তি বা সংগঠনকে, যারা “জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে।”
নোবেল কমিটি এর আগে যেসব ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করেছে, তাদের মানবাধিকার, বহুপাক্ষিকতা, গণতন্ত্র ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভূমিকার জন্য প্রশংসা করেছে। ট্রাম্পের এই বিষয়গুলোতে অঙ্গীকার নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
গত মাসে পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অসলোর অনুমানভিত্তিক তালিকায় ট্রাম্পের নাম ছিল না।
ক্রিপ্টোভিত্তিক প্রেডিকশন মার্কেট পলিমার্কেট সম্প্রতি ট্রাম্পকে পঞ্চম সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দেখিয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ জয়ের সম্ভাবনা দিয়ে।
গ্রেগার বলেন, “তিনি গাজা যুদ্ধের অবসানে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তার জন্য নিশ্চয়ই প্রশংসা প্রাপ্য, এবং এই শান্তি পরিকল্পনা বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এখনই বলা সম্ভব নয়, এটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি বয়ে আনবে কি না।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ট্রাম্পের সরে আসা এবং গ্রিনল্যান্ড অধিগ্রহণের ইচ্ছা, এসব কিছুই আলফ্রেড নোবেলের সেই নীতির সঙ্গে খাপ খায় না, যেখানে পুরস্কার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এমন ব্যক্তিকে, যিনি জাতিগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য বৃদ্ধিতে কাজ করেন।”
গ্রেগারের মতে, গাজা ও ইউক্রেনে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হলে আগামী বছর কমিটি তাকে আরও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে পারে। সেই ক্ষেত্রে কাতার ও মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য পক্ষ, যারা আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তারাও যৌথভাবে বিবেচিত হতে পারেন।
বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবের সঙ্গে বৈঠকের সময় যখন ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তিনি খানিকটা পরাজিত ভঙ্গিতে বলেন, তিনি জানেন না তার সম্ভাবনা কতটা। আরও জানান, আন্তর্জাতিক সংঘাত মেটানোর প্রচেষ্টা তিনি পুরস্কার পাওয়ার জন্য করেননি।
তিনি বলেন, “আমি এটা ওই কারণে করিনি। আমি করেছি, কারণ এতে অসংখ্য প্রাণ বেঁচে গেছে।”
তথ্যসূত্র : ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।