জুলাই অভ্যুত্থানের পর এক বছরে বাংলাদেশকে যতটা বদলানো সম্ভবপর ছিল, ততটা না হলেও হতাশ নন এই আন্দোলনের নেতৃত্বদাতারা।
শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবশেষ এখনও রয়ে যাওয়ায় তা মোকাবেলা করেই অভ্যুত্থানের স্বপ্ন পূরণের কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তখনকার সমন্বয়ক সারজিস আলম।
অভ্যুত্থানের পর যে রাজনৈতিক দল গঠন বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে তরুণরা, সেই জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মুখ্য সংগঠকের দায়িত্বে এখন রয়েছেন সারজিস।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক থেকে এখন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা আবদুল হান্নান মাসউদ আরেকটি বিপ্লবের আশা করছেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গত বছরের জুলাইয়ে ব্যাপক রক্তক্ষয়ের মধ্যদিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তাতে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর আন্দোলনকারী নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় এবং তার প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে মঙ্গলবার ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে এক আয়োজনে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন ড. ইউনূস।
তবে হান্নান মাসউদ সেই অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন, “যাদের সাহসিকতায় আর নেতৃত্বে এই অভ্যুত্থান আর এই সরকার, বছর না পেরোতেই তারা মূল্যহীন।
“আমার সহযোদ্ধা, যারা মৃত্যুকে পরোয়া না করে হাসিনার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে- তারা এবং সকল শহীদ পরিবার তাদের প্রাপ্য সম্মান না পেলে, আমি আব্দুল হান্নান মাসউদ ব্যক্তিগতভাবে আগামীকালকের জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রোগ্রাম বর্জন করার ঘোষণা দিচ্ছি।”
এরপর আরেক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “আমরা আসলেই দেশটারে অনেক ভালোবাসি। এই নিখুঁত ভালোবাসাও প্রতিবারই প্রতারিত হয়ে আসছে … আবার বিপ্লব হবে, সে বিপ্লব যেন বেহাত না হয়।”

হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলেন সারজিস আলম তার ফেইসবুক পোস্টে।
তিনি লিখেছেন, “স্বৈরাচারী খুনি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থান! লুকিয়ে দেশ ছেড়ে পালালো শেখ হাসিনা। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতিত হয়ে আসা মানুষগুলো স্বপ্ন দেখতে লাগলো কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের।
“১ বছর অতিক্রম শেষে আমরা এখনও আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পাইনি। হয়ত ১ বছরে পাওয়া সম্ভবও নয়। কিন্তু ১ বছরে যতটুকু পাওয়া সম্ভব ছিল, ততটুকুও আমরা পাইনি। এক্ষেত্রে কারও দায় হয়ত কম, কারও হয়ত বেশি। কিন্তু এককভাবে কাউকে দায়ী করার সুযোগ নেই।”
এই না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সারজিস লিখেছেন, “একটা কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের জন্য রাষ্ট্রীয় বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একই সাথে এগিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র বিনির্মাণে এই প্রত্যেকটি অংশ একে অপরের পরিপূরক।
“ব্যক্তি হাসিনা পালিয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে যে অসুস্থ এবং অপকর্মের চর্চাগুলো ক্ষমতায় থেকে তিনি ও তার বন্দোবস্ত অধিকাংশ মানুষের মননে, মগজে, চিন্তায়, অস্থিমজ্জায়, ভাবনায়, আচরণে সন্নিবেশিত করেছেন, সেগুলো চাইলেই একটা ব্যক্তির মতো পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
এনসিপির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে। সেই লক্ষ্য অর্জনে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন দলটির নেতারা।
সারজিস লিখেছেন, “আমাদের প্রতিনিয়ত ফাইট করতে হবে এই নষ্ট সিস্টেম, চিন্তা আর ব্যক্তিদের সাথে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি আমাদের লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে কিছুটা বিলম্ব হলেও আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব।
“যে প্রজন্ম একটা অভ্যুত্থান করে শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্টের পতন ঘটাতে পারে, সেই প্রজন্মের সামনে আগামীতে অন্য কেউ যেকোনো কিছু করে অন্তত পার পেয়ে যাবে না।”
তবে লড়াইয়ের এই পথটি যে বন্ধুর, সহযোদ্ধাদের তাও স্মরণ করিয়ে দিলেন সারজিস।
তিনি লিখেছেন, “এই পথচলায় ষড়যন্ত্র হবে, ফাঁদ থাকবে, পিছুটান থাকবে, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা করা হবে, মনোবল ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হবে, কিন্তু দমে যাওয়ার সুযোগ নেই।
“তারা সর্বোচ্চটা ব্যবহার করে আমাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে, বিশ্বাস ভাঙবে, একজনকে আরেকজনের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতীয়মান করবে। আমাদেরকে এসব মোকাবেলা করেই দাঁতে দাঁত কামড়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।”
“৫ই আগস্ট আমাদের সবার কাছে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আমানত স্বরূপ। আমৃত্যু সেই পরম আমানতের খেয়ানত না করার প্রতিজ্ঞাই আমাদেরকে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ এনে দিতে পারে,” লিখেছেন সারজিস।



