Beta
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫

সঞ্চয়পত্র : বিক্রি বাড়তে না বাড়তেই কমল মুনাফার হার

Savings Certificates
[publishpress_authors_box]

মুনাফার হার বাড়ায় আবারও সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছিল মানুষ; বাড়ছিল বিক্রি। ডুবতে বসা পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছিল অনেকে।

কিন্তু এরই মধ্যে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানো হলো; আগামী ছয় মাসের জন্য কমানো হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম দিন ১ জুলাই মঙ্গলবার থেকে সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার হবে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।

ছয় মাস আগে চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে মেয়াদ পূরণ সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্রের ধরন অনুসারে মুনাফার হার সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ করা হয়েছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ গত সোমবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার এক সার্কুলার জারির মাধ্যমে সব ব্যাংকেরে প্রধান নির্বাহীর কাছে প্রজ্ঞাপনটি পাঠিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জনিয়েছেন।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আইএমএফ বরারবরই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর কথা বলে আসছে। ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল সুদের হার কমাতে হবে। এরপরও তাদের কথা উপক্ষো করে জানুয়ারিতে মুনাফার হার বাড়ানো হয়। আইএমএফের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড় করার সময়ও তাদের শর্ত ছিল সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমাতে হবে।”

“তাদের সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই হঠাৎ করে মুনাফার হার কমানো হয়েছে,” বলেন ওই কর্মকর্তা।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সবশেষ সঞ্চয়পত্র বিক্রির যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বা প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।

এর মানে হচ্ছে, এপ্রিলে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, সেখান থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধের পর ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা ছিল। এই টাকা সরকার রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগিয়েছে। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ দিতে হয়।

আগের মাস মার্চে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ সুদ-আসল পরিশোধ করার পর সরকার এই টাকা প্রয়োজন মতো খরচ করেছে।

অথচ এর আগে টানা পাঁচ মাস (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল ঋণাত্মক বা নেগেটিভ (-)। অর্থাৎ ওই পাঁচ মাসে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার।

এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করা হয়েছে।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের অক্টোবরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।  এর মানে, অক্টোবরে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার চেয়ে ৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার।

তেমনি নভেম্বরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। ডিসেম্বরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।

চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি ঋণাত্মক। ফেব্রুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। 

বিক্রি কমে যাওয়ায় জানুয়ারিতে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ বা মুনাফার হার বাড়ানো হয়। মেয়াদ পূরণ সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্রের ধরন অনুসারে এ হার বেড়ে হয়েছে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ করে অন্তর্বর্তী সরকার।

দেশের সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা রাখে ব্যাংকে। তারপর নিরাপত্তা ও অধিক মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ বলা হয়ে থাকে।

কেন মানুষ ফের সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ করছিল— এ প্রশ্নে অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মুনাফার হার বাড়লে মানুষ সঞ্চয়পত্র বেশি কিনবে—এটাই তো স্বাভাবিক। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ভালো না। বিক্রি কমে নেগেটিভ হওয়ায় সঞ্চয়পত্র থেকে কোনও ঋণ নিতে পারছিল না সরকার। অর্থ সঙ্কটে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে বিক্রি যাতে বাড়ে; সরকার যেন ঋণ নিতে পারে—সে জন্যই জানুয়ারিতে সুদের হার বাড়িয়েছিল। বেশি মুনাফার আশায় মানুষ বেশি কিনছিল; বিক্রি বাড়ছিল।”

“এছাড়া মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও কমেছে; এক অঙ্কে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমেছে। ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে; তারা আর এখন ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরাপদ বোধ করছে না। শেয়ার বাজারের কথা আর কী বলবো; ডুবতে বসেছে। সেই কবে থেকে মন্দা চলছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও কোনও আশা নেই।”

“সব মিলিয়ে মুনাফা বেশি এবং নিরাপদ বিনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সবাই সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছিল। এখন মুনাফার হার কমায় ফের বিক্রি কমবে; বিনিয়োগ কমে যাবে। সরকার আর এ খাত থেকে কোনও ঋণ পাবে না। উল্টো কোষাগার থেকে সুদ-আসলের টাকা পরিশোধ করতে হবে,” বলেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। আগের মাসে, অর্থাৎ এপ্রিল মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ১৭। তার আগের মাস মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩৫।

২০২৩ সালের মার্চ মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এরপর থেকেই চড়তে চড়তে আন্দোলনের মাস গত বছরের জুলাইয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল এক যুগের মধ্যে বেশি।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, টানা পাঁচ মাস (অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি) বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধ বেশি হওয়ায় সোমবার (৩০ জুন) শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সঞ্চয়পত্রের নিট বা প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৪৩১ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)।

অর্থাৎ ১০ মাসে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে ৭ হাজার ৪৩১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার। এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করা হয়েছে।

অথচ এই অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা পজিটিভ (+)। অর্থাৎ ওই তিন মাসে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধের পরও সরকারের কোষাগারে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমা ছিল; এই টাকা সরকার ঋণ হিসেবে নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করছে।

আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ১০ মাসে অর্থাৎ জুলাই-এপ্রিল সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৬৪৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)।

২০২৩-২৪ অর্থ বছরের পুরো সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি ছিল ২১ হাজার ১২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণাত্মক বা নেগেটিভ।

২০২২-২৩ অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্রের বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধে ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা বেশি চলে গিয়েছিল। অর্থাৎ ওই অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের এই তথ্যই বলছে, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনও ঋণ পায়নি সরকার; উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল কোষাগারে থেকে পরিশোধ করেছে।

সদ্যবিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই-এপ্রিল সময়েও সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে কোনও ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ নিতে পারেনি। উল্টো ৭ হাজার ৪৩১ কোটি ২৬ লাখ টাকা কোষাগার থেকে গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ দিতে হয়েছে।

মুনাফার হার বাড়ানোয় মার্চ থেকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ধনাত্মক (পজিটিভ) হওয়ায় অর্থ বছর শেষে নিট বিক্রি নেভেটিভ (-) না পজিটিভ (+) হয় তা অর্থ বছরের পুরো হিসাব পেলে জানা যাবে।

জানুয়ারি থেকে বর্ধিত মুনাফার হার কার্যকর হয়। কিন্তু ওই মাসের এক সপ্তাহের মতো সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ থাকে। জাতীয় সঞ্চয় অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের উন্নয়নের কাজের কারণে জানুয়ারির কয়েক দিন সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কার্যক্রম বন্ধ ছিল বলে জানান জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও জনসংযোগ) রেজানুর রহমান।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এখন বিক্রি স্বাভাবিকভাবে চলছে। কোনও সমস্যা হচ্ছে না।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জানুয়ারিতে কয়েক দিন বন্ধ থাকায় ওই মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কম হয়েছে। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতেও তার কিছুটা প্রভাব পড়েছিল। অনেকেই জানতোই না যে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি ফের শুরু হয়েছে। তারপর ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে ছিল।”

সব মিলিয়ে মুনাফা বৃদ্ধির প্রভাব জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে খুব একটা পড়েনি। মার্চ থেকে পড়তে শুরু করেছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বা প্রকৃত বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।

এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরে দেশের প্রধান কর আদায়কারী সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আদায় হতাশাজনক হওয়ায় সেই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

সোমবার এনবিআর প্রাথমিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে বিদায়ী অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে ঘাটতি ধরা ছিল ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা টাকা ঋণ বা ধার করার লক্ষ্য ধরা ছিল।

সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা করা হয়।

রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ বাড়াতে চেয়েছিল সরকার। সে কারণেই সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানো হয় বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি।

২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার।

১ জুলাই (মঙ্গলবার) শুরু হওয়া ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নেওয়া ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ ২০২৪ সালের এপ্রিল শেষে ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের এপ্রিল শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকায়।

কোন সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কত কমেছে

নতুন হার অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার হবে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।

কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার তুলনামূলকভাবে বেশি। বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার কম। এ ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ পরিমাণ বা এর কম হলে সুদহার বেশি হবে। ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার কমে আসবে।

আয় ও ঋণ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে সরকার নিয়মিত সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণ করে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের অধীন যত ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্র। এ সঞ্চয়পত্রে এত দিন সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এখন তা কমিয়ে করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে এ মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সেটা কমিয়ে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ করা হয়েছে।

পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পঞ্চম বছর শেষে, অর্থাৎ মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফা ছিল ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এখন তা করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ; এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও কমানো হয়েছে। এ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এ ছাড়া তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলেও মুনাফা কমবে। এ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

এর বাইরে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবেও মুনাফার হার কমিয়েছে সরকার। তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হলে এবং সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ হার ছিল ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের আওতায় ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড ও ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক সাধারণ হিসাবের মুনাফার হার অপরিবর্তিত থাকবে।

এছাড়া ১ জুলাই ২০২৫ তারিখের আগে ইস্যু হওয়া সব জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের ইস্যুকালীন মেয়াদে ওই সময়ের মুনাফার হার প্রযোজ্য হবে। তবে পুনর্বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পুনর্বিনিয়োগের তারিখের মুনাফার হার প্রযোজ্য হবে। ছয় মাস পর মুনাফার হার পুনর্নির্ধারণ করা হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত