Beta
বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৫

স্টারলিংক, মিয়ানমার ও ইন্টারনেট স্বাধীনতার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

Starlink
[publishpress_authors_box]

দেশ দেশে সরকার যেমন আছে, তেমন আছে সরকারবিরোধী। এই সরকারবিরোধী গোষ্ঠীগুলো সাধারণত প্রতিরোধ আন্দোলনে জড়িত। আর তাদের জন্য নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের মাধ্যম নিশ্চিত করা এখন জীবন-মরণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগুলো যে সরকারগুলোর বিরুদ্ধে লড়ে, সেসব সরকারই মূল ইন্টারনেট পরিকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এই গোষ্ঠীগুলো নজরদারি, সংযোগ বিচ্ছিন্নতা ও সেন্সরশিপের ঝুঁকিতে পড়ে। এ কারণে বিরোধী গোষ্ঠীগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণ এড়াতে এবং যোগাযোগ বজায় রাখতে বিদেশি মালিকানাধীন নেটওয়ার্ক, যেমন স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।

এই বিকল্পগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দেয় ঠিকই, তবে নতুন ঝুঁকিও তৈরি করে। কারণ বাইরের কোনও শক্তি এই সুবিধা বাতিল বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মিয়ানমারে বিপ্লবী গোষ্ঠী ও সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো (সিএসওএস) ধনকুবের ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা স্টারলিংকের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের অধীনে নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

মিয়ানমারের প্রতিরোধ গোষ্ঠী এবং সাধারণ নাগরিকদের জন্য স্টারলিংক একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী যখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সে সময়ে।

ডিজিটাল অধিকার সংগঠন অ্যাক্সেস নাউয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে ৫০০টিরও বেশি ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের ঘটনা ঘটে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি মিয়ানমার। 

মিয়ানমারের একটি অলাভজনক সংগঠন অথান জানিয়েছে, সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশের সবকটি, ৩৩০ টাউনশিপে কমপক্ষে একবার হলেও টেলিফোন বা ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

সরকারি নিষেধাজ্ঞা এড়াতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ শেয়ার করতে এবং জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে স্টারলিংকের সুবিধা সহায়তা করেছে। এটি জান্তাবিরোধী গোষ্ঠী ও স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

উদাহরণস্বরূপ, জান্তাবিরোধী বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ৬০টিরও বেশি এলাকায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করেছে। একটি স্বাধীন ও নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট পরিষেবা ছাড়া এই গোষ্ঠীগুলো আরও বেশি দমন-পীড়নের মুখোমুখি হতো এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় নিয়ন্ত্রিত তথ্যশূন্যতায় পড়ে থাকত।

তবে এই নির্ভরশীলতা তাদের বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ফেলে। জান্তা সরকার স্যাটেলাইট যোগাযোগ ট্র্যাকও বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। এমনটা হলে নিরাপদ ও গোপন অনলাইন কার্যক্রমের জন্য এই পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) তাদের নজরদারি ক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর ব্যবহার করা এনক্রিপ্টেড মেসেজিং, ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ও অন্যান্য বিকল্প যোগাযোগ মাধ্যমকে লক্ষ্যবস্তু করছে। যেসব সাধারণ নাগরিক স্বাধীন সংবাদ উৎস বা বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন, তারাও শুধু তথ্য পাওয়া ও সংযুক্ত থাকার কারণে টার্গেট হতে পারেন।

স্টারলিংক ইলন মাস্কের মালিকানাধীন ও তার নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এই নেটওয়ার্ক তার হাতে থাকায় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিবর্তনের ভিত্তিতে এই পরিষেবা বাতিল, সীমিত বা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে বলে উদ্বেগ বাড়ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ইউক্রেনে স্টারলিংকের ব্যবহার নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। ইউক্রেনের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জান্তা সরকার স্যাটেলাইট যোগাযোগ ট্র্যাকও বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। এর ফলে যারা নিরাপদ ও গোপন অনলাইন কার্যক্রমের জন্য এই পরিষেবার ওপর নির্ভর করে তারা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।

ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয়।

রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের আলোচকরা ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য দেশটির স্যাটেলাইট পরিষেবা বন্ধের হুমকি দিয়েছিলেন। যদিও মাস্ক এই প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা’ বলেছেন। 

ক্যামেরুনে গত বছর এপ্রিলে স্টারলিংক পরিষেবা বন্ধ করে দেন মাস্ক। দেশটির একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, কোম্পানিটি লাইসেন্স ছাড়াই কাজ করছিল এবং এটি দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় মাস্ক স্থানীয় মালিকানার ৩০ শতাংশ শর্ত পূরণ করতে অস্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে।

বড় আকারের অনলাইন প্রতারণার জন্য দায়ী মিয়ানমারের স্ক্যাম শিল্প আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজর কেড়েছে। এই স্ক্যামে (প্রতারণা) জড়িতরাও স্টারলিংক ব্যবহার করে।

এজন্য মিয়ানমারের ডিজিটাল কর্মীরা প্রায়ই উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, স্ক্যাম কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলোও এই পরিষেবার প্রবেশাধিকার হারাতে পারে। 

মাস্ক (বা ট্রাম্প) অনলাইন স্ক্যামিং ও অবৈধ ব্যবসার উদ্বেগের কারণে স্টারলিংকের ওপর বিস্তৃত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তার ‘অনাকাঙিক্ষত পরিণতি’ হতে পারে। সক্রিয় মানবাধিকার কর্মী ও প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে এই পদক্ষেপ অপরাধমূলক কার্যক্রম কমাতে খুব কমই ভূমিকা রাখবে। কারণ এসব কার্যক্রম প্রায়ই রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও বিকল্প ডিজিটাল পরিকাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

স্পষ্ট করে বলতে গেলে, নেটওয়ার্ক নির্ভরতার বৈশ্বিক প্রভাব মিয়ানমারের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। বিদেশি মালিকানাধীন ডিজিটাল পরিকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো— সাবমেরিন কেবল থেকে ক্লাউড পরিষেবা পর্যন্ত একই ধরনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। 

সরকারগুলো একসময় কানেক্টিভিটিকে শুধু অর্থনৈতিক বা সামাজিক সরঞ্জাম হিসেবে দেখত। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, এটি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার খেলার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এরইমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিকে (যেমন সেমিকন্ডাক্টর) সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করার ইচ্ছা দেখিয়েছে। একই কৌশল স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে।

এই ঝুঁকি কমাতে দেশ ও প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোর ডিজিটাল পরিকাঠামো বৈচিত্র্যময় করতে হবে ও বিকল্প প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে। প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর জন্য সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও যোগাযোগ পদ্ধতির গভীর বোঝাপড়াও প্রয়োজন। 

যোগাযোগের মাধ্যম নির্বাচনের আগে তাদের বিবেচনা করা উচিত তাদের শ্রোতা কারা, কী ধরনের তথ্য তারা তাদের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে চান- এসব। সব ধরনের যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের প্রয়োজন হয় না। সংঘাতপ্রবণ বা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে এটি ডিফল্ট পদ্ধতি হওয়া উচিত নয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, কেন্দ্রীয় ইন্টারনেট সরবরাহকারী ছাড়াই ডিভাইসগুলোর মধ্যে যোগাযোগ সম্ভব করে এমন স্থানীয় মেশ নেটওয়ার্ক একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। এই প্রযুক্তি কম্পিউটার ও ডিভাইসগুলোর সরাসরি সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করে। সেখানে কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন হয় না।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে হাইতির ভূমিকম্পের পর দুর্যোগ-প্রতিরোধী ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সার্ভাল প্রজেক্ট চালু করা হয়। একইভাবে ওপেন মেশ প্রজেক্ট সরকারি ডিজিটাল দমন-পীড়নের মুখে থাকা নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত ও বিনামূল্যে যোগাযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে।

চূড়ান্তভাবে সংযোগ ক্ষমতা এবং এই ক্ষমতা কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হলে তা অনেকের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে বলেও মনে করছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, মিয়ানমারের প্রতিরোধ গোষ্ঠী ও সাধারণ নাগরিকদের বুঝতে হবে, তাদের যোগাযোগের মাধ্যম বিদেশি হাতে ছেড়ে দেওয়া বিপজ্জনক। বিশেষ করে এমন এক যুগে, যেখানে রাজনীতি নির্ধারণ করে কে সংযুক্ত থাকবে আর কে অন্ধকারে পড়ে থাকবে। 

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এটা বুঝতে হবে, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল পরিকাঠামো কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিণতি কী হতে পারে।

এ বিষয়ে সচেতন না হলে শুধু মিয়ানমারই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট স্বাধীনতা ও ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের জন্য একটি উদ্বেগজনক নজির তৈরি হবে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত