২০১৯ সালের ৫ আগস্ট রাত। জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও রাজ্যের অধিকার পাল্টে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। এমন সিদ্ধান্তের পর পুরো উপত্যকাজুড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর দমন অভিযানে শত শত কাশ্মীরিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সেই রাতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন সোনম ওয়াংচুক। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সোশাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন, “ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী, লাদাখের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য।”
ভারতের অন্যতম সুপরিচিত উদ্ভাবক ও শিক্ষা সংস্কারক ওয়াংচুক তখন ইঙ্গিত করেছিলেন লাদাখবাসীর সেই বহু বছরের দাবির দিকে, শীতল মরুভূমি লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আলাদা করে দেওয়া। এই অঞ্চলটি চীনের সীমান্তঘেঁষা ও পাকিস্তানও এর দাবি করে আসছে।
আগস্ট ২০১৯ পর্যন্ত লাদাখ ছিল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অংশ। কিন্তু মোদি সরকারের সিদ্ধান্তে এটি রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন প্রশাসনিক কাঠামো একটি ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে’ পরিণত হয়। ফলে এটি সরাসরি নয়াদিল্লির অধীনে পরিচালিত হতে শুরু করে।

তবে জম্মু ও কাশ্মীরের বাকি অংশকেও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হলেও, সেখানে একটি স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত বিধানসভা বহাল রাখা হয়। কিন্তু লাদাখকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়াটা পরবর্তী ছয় বছরে শান্তিপ্রিয় লাদাখকে ধীরে ধীরে পরিণত করে রাজনৈতিক অস্থিরতার আগুনে। আর সেই আন্দোলনের অগ্রভাগে উঠে আসেন হতাশ ও ক্ষুব্ধ সোনম ওয়াংচুক।
ওয়াংচুককে গত ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে নিজ রাজ্য থেকে এক হাজার মাইল দূরে রাজস্থানের যোধপুরের জেলে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড’ ও ‘সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র’। অভিযোগ করা হয়, তার নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের একটি অংশ নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়।
সেই সংঘর্ষে ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর গুলিতে চারজন আন্দোলনকারী নিহত হন, যাদের মধ্যে এক সাবেক সেনা সদস্যও ছিলেন। তারা স্থানীয় বিজেপি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। প্রশাসন ওয়াংচুককে সেই সহিংসতার প্ররোচক হিসেবে অভিযুক্ত করে।
অদ্ভুতভাবে, এই সেই বিজেপি ও মোদি সরকার, যারা এর আগে লাদাখে বিভিন্ন প্রচারাভিযানে ওয়াংচুকের সহায়তা নিয়েছিল। অন্য রাজ্যগুলোর বিজেপি সরকারও তাকে শিক্ষাবিদ পরামর্শদাতা হিসেবে আহ্বান করেছিল। কিন্তু আজ সেই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, যিনি একসময় বলিউডের অন্যতম বিখ্যাত ও সফল চলচ্চিত্রের অনুপ্রেরণা ছিলেন, দেশদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত। সরকারের পক্ষ থেকে এমনও ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে যে তার সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পেছনে পাকিস্তানের প্রভাব থাকতে পারে।
আল জাজিরাকে ওয়াংচুকের স্ত্রী গীতাঞ্জলি আঙমো বলেন, “এক মাসের মধ্যেই একই সরকার, যারা তাকে পুরস্কৃত করছিল, এখন তাকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলছে। সবই পরিষ্কার: এটা তাকে চুপ করানোর চেষ্টা, ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা। কারণ তারা তাকে কিনতে পারেনি।”
‘লে শহরে শোক’
সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে লাদাখের স্থানীয় কর্মীরা ওয়াংচুকের নেতৃত্বে অনশন শুরু করেন। এটি ছিল গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদগুলোর একটি। আর এর মূল দাবি ছিল ‘ষষ্ঠ তফসিল’-এর আওতায় সাংবিধানিক সুরক্ষা।
ভারতের সংবিধানের এই ধারা আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে বিশেষ প্রশাসনিক ও শাসনব্যবস্থার অধিকার দেয়। লাদাখের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষই এই আদিবাসী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু অনশনের ১৫তম দিনে গত ২৪ সেপ্টেম্বর কিছু তরুণ বিক্ষোভকারী মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লেহ শহরে বিজেপি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে চারজন নিহত হন। তাদের একজন ছিলেন সাবেক সেনা সদস্য। আহত হন আরও অনেকে। এরপর প্রশাসন ব্যাপক দমন অভিযান চালিয়ে ৮০ জনেরও বেশি মানুষকে আটক করে। তাদের মধ্যে ছিলেন সেই আন্দোলনের নেতৃত্বও, যারা শুরুতে সম্পূর্ণ অহিংস পথে অনশন চালাচ্ছিলেন।
ওয়াংচুককে আটক করা হয় জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায়। এই আইনে বিচার ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত আটক রাখা যায়। ওয়াংচুক ও অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে এক ডজনেরও বেশি স্থানীয় কর্মী স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
এটি ছিল লাদাখের আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা ও দমন অভিযান।
লেহ শহরের ত্রিশোর্ধ্ব এক ব্যবসায়ী স্তানজিন দর্জে ওয়াংচুক ও অন্যদের পাশে বসে অনশনে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু দমন অভিযানের পর তিনি এলাকার অন্য বাসিন্দাদের মতোই অভূতপূর্ব কারফিউ-সদৃশ নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। তার বন্ধুদের কথায়, দিন দিন দর্জে বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিলেন।
গত বুধবার তিনি আত্মহত্যা করেন। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে।
আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব লাদাখ বৌদ্ধ সংঘের সভাপতি তসেরিং দর্জে জানান, তিনি সোনমের ভক্ত ছিলেন। বারবার তার খোঁজ নিতেন, নাম করতেন। ব্যবসায়ী স্তানজিনও এই সংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য ছিলেন। তার সম্পর্কে তসেরিং বলেন, “তিনি খুবই বিচলিত ও দুঃখিত ছিলেন। আমরা সবাই প্রশ্ন করছি, সোনমের অপরাধ কী ছিল? তিনি তো শুধু বসে ছিলেন। তাকে কেন গ্রেপ্তার করে লাদাখের বাইরে জেলে পাঠানো হলো?”
ইঞ্জিনিয়ার থেকে দেশজুড়ে উদ্ভাবন ও টেকসই জীবনের প্রতীক হয়ে ওঠা সোনম ওয়াংচুক লাদাখের তরুণদের কাছে ছিলেন অনুপ্রেরণা। তেসরিং বলেন, “আমরা সবাই লেহতে শোকাহত, আমাদের শহীদ ও বন্দি মানুষদের জন্য।”
জাতীয় নায়ক
১৯৬৬ সালে লেহ শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে পার্বত্য গ্রাম উলেতোকপোতে জন্মান সোনম ওয়াংচুক। নয় বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বাড়িতেই মা ছেরিং ওয়াংমোর কাছে পড়ালেখা করেন। ১৯৭৫ সালে তার বাবা সোনম ওয়াংগ্যাল (জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের একজন রাজনীতিক ছিলেন) মন্ত্রী নিযুক্ত হলে পরিবারটি চলে আসে শ্রীনগরে, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানীতে।
কিন্তু শ্রীনগরের স্কুলে ওয়াংচুকের পড়াশোনা শুরু হয় কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কারণ তিনি শুধুই লাদাখি ভাষা জানতেন। অথচ শ্রেণিগুলো পরিচালিত হতো উর্দু ও কাশ্মীরিতে। পরে তিনি দিল্লিতে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য যান। এরপর শ্রীনগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এনআইটি) যন্ত্রপ্রকৌশল (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৮৮ সালে স্নাতক শেষ করেই তিনি কয়েকজন সহপাঠীকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ (এসইসিএমওএল)। এটি লাদাখের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি বিকল্প স্কুল মডেল হিসেবে গড়ে ওঠে।
ততদিনে প্রায় ৯৫ শতাংশ লাদাখি শিক্ষার্থী রাজ্য পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতো। কারণ তাদের জন্য পাঠ্যক্রমটি ছিল উর্দুভিত্তিক। কারণ এই ভাষা লাদাখের অধিকাংশ মানুষের কাছেই ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। ঐক্যবদ্ধ রাজ্য হিসেবে তখন জম্মু ও কাশ্মীরে উর্দুই ছিল প্রাধান্য পাওয়া ভাষা।
এসইসিএমওএল প্রতিষ্ঠার পর পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। প্রথমে যেখানে মাত্র ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক (দশম শ্রেণি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতো, সাত বছরের মধ্যে সেই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ শতাংশে, পরে ৭৫ শতাংশে পৌঁছে যায়।
ওয়াংচুক লেহ শহরের কাছে গড়ে তোলেন এসইসিএমওএল অল্টারনেটিভ স্কুল ক্যাম্পাস। এর ভর্তি মানদণ্ড ছিল একটাই, যারা প্রচলিত স্কুলে ফেল করেছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের শেখানো হতো বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে: যেমন রেডিও স্টেশন পরিচালনা, কৃষিকাজ, যন্ত্র মেরামত, এমনকি পুরো ক্যাম্পাসের ব্যবস্থাপনা নিজেরাই করত শিক্ষার্থীরা।
লাদাখের শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটানোর জন্য ১৯৯৬ সালে তাকে দেওয়া হয় জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপালের পদক।
এদিকে ১৯৮০-এর দশকে ওয়াংচুকের বাবা সোনম ওয়াংগ্যালও লাদাখের জনগোষ্ঠীর আদিবাসী স্বীকৃতির দাবিতে একাধিক অনশন ধর্মঘট পরিচালনা করেছিলেন।
১৯৮৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লেহ শহরে গিয়ে অনশনে থাকা ওয়াংগ্যালকে এক প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে একটি ঠান্ডা পানীয় অফার করেন এবং লাদাখের জনগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
বাবার সেই লড়াইয়ের বছরগুলো পার হয়ে যখন ওয়াংচুক লেহতে এসইসিএমওএল প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তিনিও ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি পান। তিনি উদ্ভাবন করেন ‘আইস স্টুপা’, শীতকালে পানি সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম হিমবাহ, এবং ভারতীয় সেনাদের জন্য সৌরচালিত তাঁবু, যা হিমালয়ের প্রচণ্ড ঠান্ডায় কার্যকর প্রমাণিত হয়।
২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে হিমালয় অঞ্চলে পরিবেশগত ন্যায়বিচার নিয়ে কাজ করা গবেষক মাংশি আশার বলেন, ওয়াংচুক শুধু একজন উদ্ভাবক নন, তিনি ছিলেন এক জলবায়ু কর্মী। তিনি টেকসই জীবনধারার প্রচারে যুক্ত ছিলেন।
এই যাত্রাপথে তিনি একাধিক সম্মাননা অর্জন করেন। এর মধ্যে অন্যতম ২০১৮ সালে এশিয়ার ‘নোবেল পুরস্কার’ খ্যাত ফিলিপাইনের ম্যাগসেসে পুরস্কার।
তার শিক্ষা দর্শন অনুপ্রেরণা দেয় বলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’ এর চরিত্র ফুংসুখ ওয়াংরুকে। ওই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুপারস্টার আমির খান। ছবিতে খানকে দেখা যায় এক ভিন্নধর্মী প্রতিভা হিসেবে, যিনি মুখস্থ বিদ্যার বিরোধিতা করেন, কঠোর শিক্ষকতাকে চ্যালেঞ্জ করেন, এবং দেখান যে প্রকৃত শিক্ষা কৌতূহল থেকে জন্ম নেয়।
সিনেমার মূল বার্তাটি “সাফল্য আসে প্রশ্ন করার সাহস থেকে, শুধুমাত্র পরীক্ষায় শীর্ষে থেকে নয়” ভারতের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনি তোলে। বিশেষ করে চীনে, যেখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বিপর্যস্ত ছাত্রছাত্রীরা এই গল্পে নিজেদের খুঁজে পায় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে।
কিন্তু আজ ওয়াংচুককে অভিযুক্ত করা হচ্ছে আরও গুরুতর এক অপরাধে, ভারত রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ জানানোয়।
লাদাখের পুলিশপ্রধান এস. ডি. সিং জামওয়াল জানিয়েছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ‘বিশ্বাসযোগ্য যোগাযোগের সূত্র’ পাওয়ার পর ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এক পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি গত মাসে গ্রেপ্তার হন, তিনি নাকি ওয়াংচুকের আন্দোলনের ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
পুলিশ আরও দাবি করেছে, ওয়াংচুকের পাকিস্তান সফর যেখানে তিনি জাতিসংঘ সহযোগিতায় ডন মিডিয়া গ্রুপ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এর সঙ্গে তার ইসলামাবাদ সংযোগের ইঙ্গিত করা হচ্ছে। তবে সেই জলবায়ু সম্মেলনে তিনি বরং প্রধানমন্ত্রী মোদির জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছিলেন।
এদিকে তার গ্রেপ্তার লাদাখের সংকট আরও ঘনীভূত করেছে। আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী স্থানীয় সংগঠনগুলো মোদি সরকারের সঙ্গে চলমান আলোচনায় অংশগ্রহণ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। তারা দাবি জানিয়েছে, সব আটক ব্যক্তির নিঃশর্ত মুক্তি ও নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ।
লাদাখ বৌদ্ধ সংঘের নেতা তসেরিং দর্জে বলেন, “সরকার আমাদের দাবি না মানলে আমরা আবার আন্দোলনে নামব, অন্য উপায় নেই। আমাদের মানুষ মারা গেছে। আমাদের নেতারা এখন জেলে। আমরা আর কী করতে পারি?”
‘আগুন থেকে আগুনে’
ওয়াংচুকের মূল মনোযোগ যদিও ছিল শিক্ষা সংস্কার ও পরিবেশ সংরক্ষণে। তবু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অবস্থানও নিতে শুরু করেন।
২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনা সেনাদের সংঘর্ষের পর, তিনি দেশবাসীকে চীনা পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান। ২০২৩ সালে তিনি খারদুং লাতে (বিশ্বের অন্যতম উচ্চতম মোটরচালিত গিরিপথ) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তুলে ধরতে এক জলবায়ু উপবাস ঘোষণা করেন। তাকে তখন গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
পরের বছর তিনি ঘোষণা করেন, লাদাখের সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবিতে মৃত্যু পর্যন্ত অনশন চলবে। সরাসরি নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি শিল্প খননপুঁজির প্রভাবের বিরুদ্ধেও সরব হন। একই বছর তিনি নেতৃত্ব দেন ‘পাশমিনা মার্চ’-এর, যেখানে স্থানীয় মানুষ তাদের পশুপাল নিয়ে মিছিল করেন, যাতে পাহাড়ি জীবিকা ও পশুপালনের সংকটকে সামনে আনা যায়।
সেপ্টেম্বর মাসে গ্রেপ্তারের ঠিক এক সপ্তাহ আগে ওয়াংচুক এক ভিডিও বার্তায় স্মরণ করেন ২০১৯ সালের আগস্টের সেই উল্লাসের কথা, যখন মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করেছিল। কিন্তু পরে তিনি বলেন, “আমরা বুঝতে পারলাম, আমরা এক আগুন থেকে আরেক আগুনে পড়েছি।”
তিনি বলেন, “লাদাখ এখন গণতন্ত্রবিহীন এক ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে।”
গবেষক মাংশি আশার বলেন, জলবায়ু আন্দোলন ও দৈনন্দিন রাজনীতির সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “একটি কেন্দ্রীভূত ও ঊর্ধ্বমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণব্যবস্থায়, যেখানে কর্পোরেট স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্র নিজেকে ‘সর্বময় মালিক’ হিসেবে দেখে, সেখান থেকে সম্পদ আহরণ করা অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীগুলো সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে টেকসই উন্নয়নের চিন্তাভাবনা স্বাভাবিকভাবেই মিশে যায় গণতান্ত্রিক ও বিকেন্দ্রীকৃত শাসনের দাবির সঙ্গে।”
তার মতে, লাদাখের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবি সরাসরি যুক্ত জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির সঙ্গে, যা এই অঞ্চল ও এর জনগণের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কারগিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্সের সদস্য সাজাদ কারগিলি বলেন, “একটি সমাজে কেউ রাজনীতি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু রাজনীতি তাকে কখনও ছেড়ে যায় না। দেরিতে হরেও রাজনীতি সোনম ওয়াংচুককেও ধরেছে। তিনি তার উদ্ভাবকের অতীত দিয়ে তা থেকে পালাতে পারতেন না।”
তিনি আরও বলেন, “আমি ওয়াংচুকের সব রাজনৈতিক মতের সঙ্গে একমত নই। কিন্তু আজ, আমরা তার সবচেয়ে বড় সমর্থক। কারণ আমরা একই অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আছি।”
কারগিলির মতে, লাদাখি নেতাদের ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে অভিযুক্ত করে মোদি সরকার বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে।
তিনি বলেন, “লাদাখ অত্যন্ত সংবেদনশীল সীমান্তাঞ্চল চীন ও পাকিস্তানের সন্নিকটে। এখানে জনগণকে পাশে রাখা খুব জরুরি। কিন্তু সরকারের কঠোর নীতি এখন লাদাখের মানুষকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে।”
তিনি সতর্ক করেন, লাদাখের অন্য নেতারাও এখন প্রস্তুত হচ্ছেন, যে কোনও সময় তাদেরও গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
‘টিকটিক করা টাইম বোমা’
হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ অলটারনেটিভস লাদাখের (এইচআইএএল) সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সোনম ওয়াংচুকের স্ত্রী অঙমো বলেছেন, তার স্বামীর গ্রেপ্তার আসলে কয়েক মাসব্যাপী এক “উইচ হান্টের’ ফলাফল। সেখানে প্রশাসন ওয়াংচুকের আন্দোলনের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠেছিল। দাতাদের প্রতি হুমকি, তদন্তকারী সংস্থার ভয় দেখানো সফর, এবং বিদেশি অনুদান গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স বাতিল, এই সবই সেই তৎপরতার অংশ ছিল।
তবুও অঙমো বলছেন, এই আন্দোলন টিকে থাকবে।
এখন অঙমোকে একদিকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতের মামলাগুলোর মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অন্যদিকে এসইএমসিওএল ও এইচআইএএল প্রতিষ্ঠান দুটোকে সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তাদের আরও দুই কর্মীসহ বেশ কয়েকজন নেতা বর্তমানে আটক রয়েছেন।
লাদাখ প্রশাসন গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে জানায়, ওয়াংচুক “সরকারের পতনের আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘আরব বসন্ত’-এর মতো আন্দোলনের মাধ্যমে। তাদের দাবিগুলো পূরণ না হলে একাধিকবার তিনি লাদাখিদের তিব্বতের প্রতিবাদের মতো আত্মাহুতি দেওয়ার কথাও বলেছেন।”
লেহতে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় চারজন নিহত হওয়ার ঘটনায় তাকে দায়ী করে প্রশাসন জানায়, “লেহ এপেক্স বডির অন্যান্য নেতারা (যার মধ্যে প্রবীণরাও ছিলেন) উত্তেজিত ভিড়কে শান্ত করার চেষ্টা করলেও ওয়াংচুক শান্তি রক্ষায় কোনও উদ্যোগ নেননি।”
উল্লেখ্য, এপেক্স বডিটি হলো লেহ অঞ্চলের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনগুলোর একটি যৌথ জোট। তারা সীমান্ত অঞ্চলের সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবি জানাতে একত্র হয়েছে।
লাদাখ প্রশাসন আরও বলেছে, “উইচ হান্ট বা ধোঁয়াশার কোনও প্রশ্নই আসে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পদক্ষেপগুলো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও নথির ভিত্তিতেই নেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষভাবে চালিয়ে যেতে দেওয়া উচিত, যাতে প্রক্রিয়াটি ব্যাহত না হয়।”
কিন্তু অঙ্গমোর দৃষ্টিতে সরকার তার স্বামী ও অন্যান্য প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে যে অভিযান চালাচ্ছে, তা লাদাখকে একটি “টিকটিক করা টাইম বোমায়” পরিণত করছে।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “ওরা কেন লাদাখকে কাশ্মীর বানাতে চাইছে?”
তবে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত তিনি তার স্বামীকে নিয়ে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সোমবার মোদি সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে যেন তারা ওয়াংচুকের গ্রেপ্তারের বিস্তারিত কারণসমূহ অঙমোর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করে। একই সঙ্গে আদালত তার স্বামীর বিচারের বিরুদ্ধে দায়ের করা অঙমোর আবেদনের শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে আগামী ১৪ অক্টোবর।
অঙমো বলেন, “আমি জানি না ওর অবস্থা কেমন, ওরা ওকে কী খেতে দিচ্ছে, কিংবা ওষুধ পাচ্ছে কি না। আমাদের মধ্যে এমন এক ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে আমরা সত্যি কথাটা বলতে না পারি: এটা আর কোনও গণতন্ত্র নয়।”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা।