শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। তবে শেষটা হয় তীব্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রায় দেড়যুগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার পতনে। আর স্বৈরাচারের তকমা নিয়ে ভারতে পালাতে হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সেই জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি হয়েছে মঙ্গলবার।
৩৬ দিনের সেই গণঅভ্যুত্থানে প্রথম নিহত আবু সাঈদের কবর জিয়ারত, দোয়া মাহফিল, পদযাত্রা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণসহ নানা আয়োজনে দিনটিকে স্মরণ করেছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন সংগঠন। এ নিয়ে নানা আয়োজন ছিল সরকারের পক্ষেও।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে মাসব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ‘জুলাই স্মৃতি উদ্যাপন অনুষ্ঠানমালা’র শুরু হয়েছে মঙ্গলবার ১ জুলাই। মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত এসব অনুষ্ঠান চলবে।
এদিন সরকারের উদ্যোগে মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে শহীদদের স্মরণে দোয়া ও প্রার্থনা হয়েছে। জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচিরও সূচনা হয়েছে, যা চলবে ১ আগস্ট পর্যন্ত। এছাড়া জুলাই শহীদ স্মরণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে চালু হয়েছে শিক্ষাবৃত্তি। উদ্বোধন করা হয়েছে ‘জুলাই ক্যালেন্ডার’।
কয়েকদিন বিরতি দিয়ে ৫ জুলাই, ৭ জুলাই, ১৪ জুলাই এবং ৫ আগস্ট বিভিন্ন অনুষ্ঠান করবে সরকার। সবচেয়ে বড় আয়োজন থাকবে ৫ আগস্ট। এদিন ৩৬ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ারিং, ৩৬ জেলার কেন্দ্রে জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদ পরিবারের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ অভিমুখে বিজয় মিছিল, এয়ার শো, গানের অনুষ্ঠান, ‘৩৬ ডেইস অব জুলাই’সহ জুলাইয়ের অন্যান্য ডকুমেন্টারি প্রদর্শন এবং ড্রোন শোর আয়োজন রয়েছে।
বিভিন্ন সংগঠনের কর্সসূচি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অঙ্গসংগঠন।
এনসিপি
মঙ্গলবার রংপুরে আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের মধ্যদিয়ে দেশ জুড়ে ‘জুলাই পদযাত্রা’ শুরু হয়েছে এনসিপির। অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সংগঠনটি ৩৬ দিনের কর্মসূচি নিয়েছে। এই পদযাত্রা নাম দেওয়া হয়েছে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’। রংপুরে শুরু হওয়া এই পদযাত্রা চলবে দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ।
এছাড়া ৩ আগস্ট ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ এবং দলের ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠান, ১৬ জুলাই আবু সাঈদকে স্মরণ করে ‘বৈষম্যবিরোধী শহীদ দিবস’ পালন এবং ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনকে ‘ছাত্র-জনতার মুক্তি দিবস’ হিসেবে উদযাপন করবে সংগঠনটি।
পীরগঞ্জে মঙ্গলবার আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের আগে যাত্রাপথে গাইবান্ধায় পথসভা ও পদযাত্রা করে এনসিপি। বিকালে রংপুর শহরের পার্কের মোড়, লালবাগ, শাপলা, জাহাজ কোম্পানির মোড়, টাউন হল, ডিসির মোড়, মেডিকেল মোড় ও চেকপোস্ট এলাকায় পথসভা করে সংগঠনটি। এরপর সন্ধ্যায় কাউনিয়া বাসস্ট্যান্ডে পথসভার মাধ্যমে প্রথম দিনের কর্মসূচি শেষ করে এনসিপি।
বিএনপি-ছাত্রদল
পয়লা জুলাইয়ের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ছাত্রদলের উদ্যোগে ‘আলোয় আলোয় স্মৃতি সমুজ্জ্বল’ কর্মসূচির মাধ্যমে শুরু হয় বিএনপির ৩৬ দিনব্যাপী জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরপূর্তি অনুষ্ঠান।
বিকালে রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আলোচনা সভা ও শহীদ পরিবারের সম্মানে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিএনপি।
‘গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ : জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন।
এর বাইরে বিজয় মিছিল, মৌন মিছিল, ছাত্র সমাবেশ, আলোচনা সভা, মানববন্ধন, প্রদর্শনী, রক্তদান, গ্রাফিতি অঙ্কন, পথনাটক, ফুটবল টুর্নামেন্ট, শিশু অধিকারবিষয়ক অনুষ্ঠান, ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কর্মসূচির আয়োজন থাকবে দলটির ৩৬ দিনের কর্মসূচিতে।
জামায়াত ইসলামী
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৩৬ দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দেশব্যাপী গণসংযোগ করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আগামী ১৯ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশ এবং ৫ আগস্ট দেশজুড়ে গণমিছিল করবে সংগঠনটি।
এছাড়া দলটির সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির আলাদাভাবে গণঅভ্যুত্থানের এক বছরপূর্তিতে ‘জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ’ প্রতিপাদ্যে ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি নিয়েছে।
অন্যান্য সংগঠনের আয়োজন
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে রাষ্ট্র সংস্কার- (২০১৮-২০২৪) শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে গণঅধিকার পরিষদ।
যেভাবে আন্দোলনের শুরু
গত বছরের পয়লা জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলের পর রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ করে সংগঠনটি।
সেই সমাবেশ থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি পরের তিনদিন (২, ৩ ও ৪) জুলাই রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচিরও ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম (বর্তমানে এনসিপির আহ্বায়ক)।
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। কোথাও কোথাও মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা।
তার আগে কী হয়েছিল
২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়ন উচ্চ আদালত। ওইদিন আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন।
আন্দোলনের মুখে আদালতের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। যার শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয় ৪ জুলাই। তবে ৪ জুলাই ওই আবেদনের শুনানি হয়নি। তারপর থেকে আন্দোলন বেগবান হয়।
ব্যাপক রক্তক্ষয়ের পর সেই আন্দোলন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তাতে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।