ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেকে নিলেন ভলোদমির জেলেনস্কিকে; ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলোর রাষ্ট্রনেতাদের পাশে রেখে বসলেন তার সঙ্গে; সেখানে জানালেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে পুতিন-জেলেনস্কিকে নিয়ে আলোচনার পরিকল্পনা করছেন তিনি।
ছয় মাস আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে সোমবার হোয়াইট হাউসের এই বৈঠকে সন্তোষ জানালেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট; তিনি বললেন, পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় তার আপত্তি নেই। তবে তার আগে ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চেয়েছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।
তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে থামানোর ক্ষেত্রে সোমবারের এই বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ বলে মানছেন ইউরোপের নেতারা।
সোমবার হোয়াইট হাউসের বৈঠকের পরপরই পুতিনকে ফোন করেন ট্রাম্প; তারা ৪০ মিনিট ধরে কথা বলেন। তবে পুতিন-জেলেনস্কিকে নিয়ে ট্রাম্প কোথায় বসবেন, সে বিষয়ে কোনও আভাস এখনও পাওয়া যায়নি। আর মস্কোর তরফেও এই বৈঠকে রাজি হওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট কোনও ঘোষণা আসেনি।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া হারানোর পর ইউক্রেন যখন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে মরিয়া, তখন ২০২২ সালে প্রতিবেশী দেশটিতে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। কৃষ্ণ সাগর পাড়ের এই যুদ্ধের জের টানতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকে।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ফেরার আগেই বলেছিলেন, তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারেন। গত জানুয়ারিতে তিনি হোয়াইট হাউসে ফেরার পর এ যুদ্ধ নিয়ে যা বলছিলেন, তাতে রাশিয়ার প্রতি তার পক্ষপাতই দেখছিল ইউক্রেনসহ ইউরোপ। বিশেষ করে গত ফেব্রুয়ারিতে জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে ডেকে নিয়ে এক রকম অপমান করার পর।
ছয় মাস ধরে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নানা কূটনৈতিক তৎপরতার পর গত শুক্রবার আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলনে বসেন ট্রাম্প। এরপর তিনি বলেছিলেন, জেলেনস্কির উচিৎ হবে যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া, সেজন্য কিছু ভূমি রাশিয়াকে ছেড়ে দিয়ে হলেও।
এরই মধ্যে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয় জেলেনস্কিকে; তার সঙ্গে আতিথ্যের জন্য ডাকা হয় ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন, ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটা, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ইতালির প্রধানমন্ত্র জর্জিও মেলিনি, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবকে।
তাদের নিয়ে উষ্ণ পরিবেশে সোমবার বৈঠকে বসেন ট্রাম্প; সবাইকে নিয়ে বসার আগে শুধু জেলেনস্কিকে নিয়ে ওভাল অফিসে আলোচনা সেরে নেন তিনি।
এরপর ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার সর্বশেষ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে একটি মুখোমুখি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা প্রকাশ করেন।
এই বৈঠক শেষ করেই পুতিনকে ফোন করেন ট্রাম্প। তাদের ৪০ মিনিটের আলাপ অত্যন্ত হৃদ্যতািপূর্ণ ছিল বলে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
রুশ প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, হোয়াইট হাউসের বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু ট্রাম্প জানিয়েছেন পুতিনকে। পুতিন তা শুনেছেন এবং সঙ্কট নিরসনে ট্রাম্পের উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।
ট্রাম্প বলেছেন, পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর তিনি পুতিন-জেলেনস্কিকে নিয়ে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
ট্রুথ সোশালে তিনি লিখেছেন, “প্রায় চার বছর ধরে চলা একটি যুদ্ধ বন্ধের জন্য এটি একটি খুব ভালো প্রাথমিক পদক্ষেপ। ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সঙ্গে সমন্বয় করবেন।”
ক্রেমলিনে পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন ত্রিপক্ষীয় এই বৈঠকের ভাবনা নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের কথা হয়েছে। তারা দুজনে ইউক্রেন সঙ্কটসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমাধানে যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন।
এদিকে হোয়াইট হাউসে থাকা জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস এবং ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটা বলেছেন যে পুতিন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রাজি হয়েছেন। তবে সেই বৈঠকের দিনক্ষণ এখনও ঠিক হয়নি।
গত ফেব্রুয়ারিতে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে যাওয়া জেলেনস্কি এবারের বৈঠককে ‘খুব ভালো’ বলেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তিনি রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠকের জন্য প্রস্তুত।
জেলেনস্কি বলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে এটাই তার সবচেয়ে ভালো বৈঠক। আলোচনা ছিল গঠনমূলক এবং সুনির্দিষ্ট। তিনি যুদ্ধের মানচিত্র সবিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে বর্ণনা করেছেন।
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধরত ইউক্রেনের মূল উদ্বেগের বিষয় তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা। তারা ন্যাটোতে যোগ দিতে চাইছে এই জন্য যে তাতে তারা আক্রান্ত হলে তাদের রক্ষা করা এই জোটের বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়ায়।
ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকেও নিরাপত্তার উদ্বেগের বিষয়টি আবার তোলেন জেলেনস্কি। তবে সেই নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে, সে বিষয়ে কিছু এখনও স্পষ্ট নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে পারে কি না- জানতে চাইলে ট্রাম্প সরাসরি উত্তর এড়িয়ে বলেন যে ইউরোপীয় দেশগুলো হবে ‘প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যুহ’, তবে ওয়াশিংটন ‘অনেক সাহায্য’ করবে।
“আমরাও তাদের সাহায্য করব, আমরাও জড়িত থাকব,” ট্রাম্প বললেও তাতে সাহায্যের রকমফের স্পষ্ট হচ্ছে না।
পরে ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, আলোচনা প্রধানত এই বিষয়ে ছিল যে ইউরোপীয় দেশগুলো কোন ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে হবে।
জেলেনস্কি বলেছেন যে কিয়েভের অংশীদারদের নিয়ে এই নিশ্চয়তাগুলো বিশ্লেষণ করা হবে এবং আগামী ১০ দিনের মধ্যে তা চূড়ান্ত করা হবে।
যদিও ট্রাম্প ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করার সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়েছেন, তবে বিশেষ দূত উইটকফ রবিবার বলেছেন যে এই জোটের প্রতিরক্ষা ম্যান্ডেটের অনুরূপ একটি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া হতে পারে।
ন্যাটো চুক্তির ৫ ধারা অনুযায়ী, জোটের কোনও সদস্য দেশের উপর আক্রমণ হলে তা জোটের সব সদস্যের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তা প্রতিরোধের দায়িত্ব সবার।
ন্যাটো মহাসচিব রুটা সোমবারের বৈঠকের পর ফক্স নিউজকে বলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ওয়াশিংটনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রকৃতি আগামী দিনগুলোতে আলোচনার মধ্য দিয়ে ঠিক করা হবে।
রুটা জানান যে আলোচনায় মার্কিন বা ইউরোপীয় সৈন্যদের ইউক্রেনে মোতায়েনের সম্ভাবনা নিয়ে কোনও কথা হয়নি।
পুতিন সমালোচক হিসাবে পরিচিত শিকাগো ইউনিভার্সিটির হ্যারিস স্কুল অব পাবলিক পলিসির অধ্যাপক কনস্ট্যান্টিন সোনিন বলছেন, কিয়েভের জন্য অর্থপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় অবশ্যই ইউক্রেনের মাটিতে ইউরোপীয় সৈন্যদের থাকা উচিৎ।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “ইউরোপীয় নেতাদের দায়িত্ব হলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বোঝানো যে এই ধরনের নিশ্চয়তা ছাড়া যুদ্ধ এখন বন্ধ হলেও অদূর ভবিষ্যতে আবার শুরু হবে।”
সোনিন ২০১৪ সালে মস্কোর ক্রিমিয়া দখলের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, “রাশিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং সীমান্তকে স্বীকৃতি দিয়ে অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে স্বয়ং পুতিন ২০০৪ সালে এমন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, তবুও তারা ২০১৪ এবং ২০২২ উভয় সালেই এই সমস্ত চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।”
হোয়াইট হাউসে আলোচনার পরও অস্পষ্ট রয়ে গেছে, শান্তি চুক্তি হলে কিয়েভকে কোন কোন ভূখণ্ড রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিতে হতে পারে।
বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন যে রাশিয়ার দখলকৃত ক্রিমিয়া ফিরে পাবে না ইউক্রেন। পাশাপাশি আরও কিছু ভূমি বিনিময় হতে পারে।
তিন বছর ধরা চলা যুদ্ধের পর রাশিয়া এখন ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ দখল করেছে। গত বছর পাল্টা আক্রমণে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলের একটি বিশাল অংশ দখল করেছিল ইউক্রেন, তবে এখন তার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই।
জেলেনস্কি বরাবরই ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার বিরোধী।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছেন, একটি চুক্তির জন্য মস্কো ও কিয়েভ উভয়কেই ছাড় দিতে হবে।
তার ভাষ্যে, “এটি সহজ নয়, হয়ত এটি ন্যায্যও নয়; তবে একটি যুদ্ধের অবসান ঘটাতে এটিই প্রয়োজন। এবং এটি প্রতিটি যুদ্ধের ক্ষেত্রেই সত্য।”
আলাস্কা বৈঠকে পুতিনই জিতেছেন বলে বিশ্লেষকদের মন্তব্য। হোয়াইট হাউসের বৈঠককে ইউক্রেনের জন্য ‘সতর্কতামিশ্রিত সাফল্য’ বলছেন কিয়েভভিত্তিক ‘সেন্টার ফর আর্মি, কনভার্সন অ্যান্ড ডিসআর্মামেন্ট স্টাডিজ’র বিশ্লেষক ইউরি পোয়েতা।
তিনি বলেন, এর ইতিবাচক পরিবেশ এবং কিয়েভের কাছে গ্রহণযোগ্য শর্তে সংঘাত সমাধানের জন্য ট্রাম্পের আপাত ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে।
“কিয়েভের পূর্বে দাবি করা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা যুক্তরাষ্ট্রে বিরক্তি সৃষ্টি করেছিল, আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে পক্ষগুলো এই নিরাপত্তা নিশ্চয়তার রূপরেখা এবং একটি বৃহত্তর নিরাপত্তা কাঠামোর উপর কাজ শুরু করেছে।”
তবেজটিল বিষয়গুলো এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যদি রাশিয়া যথেষ্ট চাপ অনুভব না করে, তারা শান্তির আহ্বানকে উপেক্ষা করবে বা ইউক্রেনের জন্য অগ্রহণযোগ্য শর্ত চাপিয়ে দেবে।
“সবচেয়ে গুরুতবপূর্ণ প্রশ্নগুলো হলো- ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তার সুনির্দিষ্ট উপাদান কী, পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর আর্টিকেল ৫ এর মতো কিছু থাকবে কি? নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য পশ্চিমা সামরিক দলগুলোকে কি ইউক্রেনে মোতায়েন করা হবে?”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, সিএনএন, বিবিসি, তাস