কথায় বলে, বিজয়ের পিতা হাজারজন, কিন্তু পরাজয়ের কেউ নেই, সে এতিম। অর্থাৎ জয়ের দাবি সবাই করলেও পরাজয়ের দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না।
সম্প্রতি পরমাণু শক্তিধর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ক্ষণস্থায়ী তীব্র সংঘাতের পর দু’পক্ষ যেভাবে সাফল্য জাহির আর ক্ষতি আড়াল করছে, তাতে আবারও মনে হতে বাধ্য, জয়ের অভিভাবক থাকলেও পরাজয় আসলেই অভিভাবকহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার মিনিটখানেক পরেই ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এই শিরোনাম- ‘পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করেছে’।
একই সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহতের ঘটনার জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চালানো ‘অপারেশন সিঁদুর’ সন্ত্রাসীদের কঠোর বার্তা দিয়েছে।
অন্যদিকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর ইসলামাবাদে হাজার হাজার মানুষ বিজয় উদযাপনে রাজপথে নেমে পড়ে। পোড়ানো হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল।
ভারতের সঙ্গে মোকাবেলায় পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেন, ‘আমাদের সাহসী সশস্ত্র বাহিনী দুর্দান্তভাবে সামরিক ইতিহাস রচনা করেছে।
“ভারতের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের যুদ্ধবিমান যেভাবে তাদের বন্দুকের আওয়াজ থামিয়ে দিয়েছে, ইতিহাস সহজে তা ভুলবে না।”
পাকিস্তান তার বিমানবাহিনীর সাফল্যকে জোরালোভাবে প্রচার করে দাবি করেছে, তাদের পাইলটরা আকাশযুদ্ধে ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। তার মধ্যে তিনটি ফরাসি নির্মিত রাফাল।
ইসলামাবাদ যখন ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করে, ঠিক সেসময় ভারতের দুটি রাজ্যে দেশটির দুটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের খবর দেয় সিএনএন।
এছাড়া ফরাসি গোয়েন্দা সূত্র সংবাদমাধ্যমটিকে জানায়, পাকিস্তান অন্তত একটি ভারতীয় রাফাল ভূপাতিত করেছে।
এই ঘটনাকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর জন্য বড় রকমের অপমানজনক পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে; যদিও ভারতীয় কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত তাদের একটিও যুদ্ধবিমান হারানোর ঘটনা স্বীকার করেনি।
তবে তারা নতুন স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছে, যাতে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি রানওয়ে এবং রাডার স্টেশন দেখা গেছে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের দাবি, ছবিগুলো পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটির, যেগুলো ভারতের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা সংঘাতের ফলাফলকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করলেও দেশ দুটির সাম্প্রতিক এই সংঘাতে কোনও স্পষ্ট বিজয়ী নেই বলে মনে করছেন সিএনএনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রধান প্রতিবেদক ম্যাথিউ চান্স।
তাছাড়া যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে মধ্যস্থতা করেছিল, তা নিয়ে দু’পক্ষকে দুরকম অবস্থান নিতে দেখা গেছে বলে জানান এই সাংবাদিক।
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতকালে নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দু’দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স।
যুক্তরাষ্ট্রের এই হস্তক্ষেপে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা পরে দেশটিকে কৃতজ্ঞতা জানালেও ভারতীয় নেতারা হোয়াইট হাউসের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তারা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি কথা বলে যুদ্ধে বিরতি দিয়েছে।
সিএনএন সাংবাদিক ম্যাথিউ চান্স মনে করেন, ভারতের নেতারা সম্ভবত আত্মাভিমানের জায়গা থেকে যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান স্বীকার করতে চাইছেন না।
মূল বিষয় হচ্ছে, মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর নিয়ে বাইরের দেশের নাক গলানো পছন্দ করে না ভারত।
তারা মনে করে, কাশ্মীর ইস্যু ভারত-পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তারাই এটার ফয়সালা করবে। এই বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে বহির্বিশ্বের মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্বীকার করে নিতে তাই ভারতের বাধছে বলে মনে করেন ম্যাথিউ চান্স।
যুদ্ধ থামাতে ভূমিকা রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নয়া দিল্লি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেছে কি করেনি, তা নিয়ে অবশ্য ভাবছেন না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর পর দ্রুত তাতে সাড়া পাওয়ায় উৎসাহিত হয়ে কাশ্মীর নিয়ে ‘হাজার বছরের’ পুরনো বিরোধের স্থায়ী সমাধান খুঁজে পেতে দেশ দুটিকে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্পের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানাতে দেরি করেনি পাকিস্তান। অন্যদিকে কাশ্মীর নিয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাব শুনেও না শোনার ভান করছে ভারত।
সিএনএনের সাংবাদিক ম্যাথিউ চান্স মনে করেন, ট্রাম্পের প্রস্তাব একটি কঠিন বাস্তবতা সবাইকে মনে করিয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি কেবল তাৎক্ষণিক একটি সমাধান, অনেকটা কাটা ঘায়ে ব্যান্ড এইড লাগিয়ে সারানোর মতো।
মনে রাখা জরুরি, কাশ্মীরের ঘা দুুদিনের নয়, বরং বহু দশকের পুরনো। সামান্য ব্যান্ড এইডে তাতে দীর্ঘস্থায়ী কিছু হওয়ার নয়।
তথ্যসূত্র : সিএনএন