Beta
বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৫

ট্রাম্প কেন ‘এপস্টিন’ ইস্যুতে মাগা সমর্থকদের চাপে

MAGA
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট জ্যাক পোসোবিয়েক গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটন ডিসির বিচার বিভাগের দপ্তরে যান। সেখানে তিনি জেফ্রি এপস্টিন সম্পর্কে কিছু সত্য তথ্য জানতে পারার আশা নিয়ে গিয়েছিলেন।

কিন্তু তিনি ও অন্যান্য মাগা (মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন) সমর্থকরা নতুন কোনও তথ্যের বদলে সেই পুরনো ও প্রকাশিত তথ্যই পান। ফলে জুলাইয়ে ওয়াশিংটন ডিসি এপস্টিন সংক্রান্ত কোনও তথ্য প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করলে তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়।

পোসোবিয়েক গত ৭ জুলাই সোশাল মিডিয়ায় লেখেন, “আমাদের সবাইকে বলা হয়েছিল আরও তথ্য আসছে। সত্যটি সেখানে আছে এবং তা প্রকাশ করা হবে। এটা অবিশ্বাস্য, কীভাবে এই এপস্টিন ইস্যুটিকে এতো খারাপভাবে পরিচালনা করা হয়েছে। অথচ এমনটা হতেই হতো না।”

ডোনাল্ড ট্রাম্প অব্শ্য এখন বুঝতে পারছেন, যেসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এক দশক আগে তাকে রিপাবলিকান রাজনীতিতে প্রবেশ করাতে সাহায্য করেছিল, সেগুলো এখন তার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

জ্যাক পোসোবিয়েক।

২০১৬ সালে পোসোবিয়েক গুজব ছড়ান যে ওয়াশিংটন ডিসির একটি রেস্তোরাঁয় শিশু নিপীড়ন চক্র পরিচালিত হচ্ছিল। পরে এটি ‘পিজাগেট’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তখনই মূলত তিনি মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এখন তিনি মাগা আন্দোলনের সেই সব উগ্র সমর্থকদের একজন, যারা বিশ্বাস করেন, সরকারি কর্মকর্তারা এপস্টিনের জীবন ও মৃত্যুর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করে রেখেছেন।

দণ্ডপ্রাপ্ত এই ধনকুবের ২০১৯ সালে নিউইয়র্কের একটি কারাগারে আত্মহত্যা করেন। সে সময় তার বিরুদ্ধে নারী পাচার সংক্রান্ত অভিযোগে বিচার চলছিল।

সম্প্রতি ব্রেইটবার্ট নিউজ সম্পাদক অ্যালেক্স মার্লোর একটি পডকাস্টে পোসোবিয়েক বলেন, মাগা সমর্থকদের কাছে এপস্টিন কেসটি একটি বড় প্রতীকে পরিণত হয়েছে, যা তথাকথিত ‘ডিপ স্টেটের’ পচনকে প্রতিফলিত করে।

তিনি বলেন, “তারা এপস্টিনকে নিয়ে চিন্তিত নয়। তারা চিন্তিত এ কারণে যে, এপস্টিন এমন একটি ছায়াময় সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যে সিস্টেমটি সরকার, প্রতিষ্ঠান, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে এবং আসলে তারাই আমাদের শাসন করে।”

বছরের পর বছর ধরে অনেকে দাবি করেছেন, সরকারের কাছে এমন গোপন নথি আছে, যেখানে এপস্টিনের অপরাধের আরও ভয়াবহ বিবরণ রয়েছে। যেমন, এমন একটি ‘ক্লায়েন্ট লিস্ট’ যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম থাকতে পারে, যারা এপস্টিনের অপরাধে জড়িত ছিলেন।

আগের নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প এইসব নথি প্রকাশের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এপস্টিন কেস সংক্রান্ত ফাইল প্রকাশ করতে তার ‘কোনও সমস্যা নেই’। এমনকি নির্বাচন পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি এগুলো প্রকাশ করব।”

ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তাভাবনা শুরু থেকেই ট্রাম্পের রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি অংশ। তিনি রিপাবলিকান রাজনীতিতে প্রবেশ করেন সেই সময়, যখন তিনি বারাক ওবামার জন্মসূত্রে আমেরিকান না হওয়ার ভুয়া তত্ত্ব ছড়িয়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো এখন ট্রাম্পের ওপরই চাপ সৃষ্টি করছে।

এপস্টিনের অপরাধ সত্য ও ভয়ংকর। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও তথ্য সামনে আসার সম্ভাবনা এখনও আছে।

তবে এই ঘটনাটি এখন এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে মিশে গেছে। যেমন, পিজাগেট ও পরে কিউএনন। কিউএনন এমন একটি জটিল ও ছায়াময় অনলাইন ভিত্তিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যা ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বলা হয়, সমাজের উঁচু স্তরের কিছু মানুষ একটি শিশু নিপীড়নকারী গোপন চক্র পরিচালনা করে। আর ট্রাম্প ও কিউ মিলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই তত্ত্বগুলো অনলাইনে ‘কিউ’ নামের একজন ছদ্মনামে বিভিন্ন গুপ্ত বার্তা প্রকাশ করে ছড়ানো হয়।

‘দ্য স্টর্ম ইজ আপন আস’ নামে কিউএনন ও ট্রাম্প যুগের ষড়যন্ত্র নিয়ে লেখা একটি বইয়ের লেখক মাইক রথশচাইল্ড বলেন, “২০১৭ সালের শেষদিক থেকেই এপস্টিনকে কিউ এর মেসেজগুলোতে উল্লেখ করা হচ্ছিল।”

তিনি আরও বলেন, “এপস্টিনকে দেখা হয় একটি বৈশ্বিক ‘শিশু পাচারকারী অভিজাত চক্রের’ প্রধান সদস্য হিসেবে। বিশ্বাস করা হয়, কিউ ও ট্রাম্পই এই চক্রের অবসান ঘটাবে।”

তবে গত ফেব্রুয়ারিতে বিচার মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকের পর থেকে সরকার ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা তরুণদের এই আশাগুলো ধীরে ধীরে স্তিমিত করে দিচ্ছেন। এদের মধ্যে আছেন এফবিআই পরিচালক কাশ প্যাটেল ও তার ডেপুটি ড্যান বংগিনো। তারা আগে এপস্টিন বিষয়ক গুজব ছড়িয়ে আসছিলেন।

এপস্টিনের কাধে হাত দেওয়া ট্রাম্প।

এরপর গত ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ও এফবিআই এক বিবৃতিতে জানায়, এপস্টিন আত্মহত্যা করেছেন এবং তার কোনও ‘ক্লায়েন্ট লিস্ট’-এর অস্তিত্ব নেই।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এরপর এই বিষয়টি নিয়ে আর ঘাঁটতে চাননি। তিনি বলেন, “এপস্টিন কেসটা অশ্লীল, কিন্তু একঘেয়ে।” পাশাপাশি তিনি ডেমোক্র্যাটদের দোষারোপ করেন এই বিষয়টি বারবার সামনে এনে রাজনীতি করার জন্য।

অনেক ট্রাম্প সমর্থকই তার এই মনোভাবকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।

তবে মাগা অনুসারী একটি বিশেষ অংশ এখনও জেফ্রি এপস্টিন ইস্যু নিয়ে তীব্রভাবে আগ্রহী ও আবেগপ্রবণ।

ফক্স নিউজের সাবেক সঞ্চালক টাকার কার্লসনসহ মাগা আন্দোলনের কয়েকজন পরিচিত মুখ দাবি করেছেন, জেফ্রি এপস্টিন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করতেন। এই ধরনের দাবি থেকে শুরু করে অনেক কট্টর মাগা সমর্থক এমন কিছু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার করছেন, যেগুলো মাঝে মাঝে স্পষ্টভাবেই ইহুদিবিদ্বেষমূলক হয়ে উঠছে।

তবে বিশ্লেষক মাইক রথশচাইল্ড বলেন, মাগা দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ মূলত আরও তথ্য জানতে আগ্রহী। বিশেষত বিল ক্লিনটনসহ অন্যান্য ডেমোক্র্যাট এবং ট্রাম্পের রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে এপস্টিনের সম্পর্ক নিয়ে যদি সত্যিই কিছু গোপন তথ্য থেকে থাকে। কারণ এপস্টিন শুধু একপক্ষের নয়, বরং দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাধর মানুষদের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

ফলে ট্রাম্প নিজেই তার আন্দোলনের ষড়যন্ত্রবাদী অনুসারীদের সন্তুষ্ট করতে হিমশিম খাচ্ছেন।

গত বৃহস্পতিবার রাতে এই বিতর্কে নতুন মোড় আসে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০০৩ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প এপস্টিনকে একটি “অশোভন জন্মদিন বার্তা” পাঠিয়েছিলেন। ট্রাম্প-এপস্টিন বন্ধুত্ব এক সময়ের সবারই জানা ছিল। তবে ট্রাম্প দাবি করছেন, বহু আগেই তিনি এপস্টিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।

ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মালিক, প্রতিষ্ঠানের মূল কোম্পানি ও দুইজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

এদিকে ট্রাম্প ষড়যন্ত্রবাদীদের সন্তুষ্ট করার জন্য কিছুটা আগ্রহও দেখিয়েছেন। নিজের সোশাল মিডিয়া ট্রুথ সোশালে তিনি লেখেন, “জেফ্রি এপস্টিনকে ঘিরে যে অযৌক্তিক মাত্রার প্রচার হচ্ছে, তা বিবেচনায় নিয়ে আমি অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে বলেছি, আদালতের অনুমোদনসাপেক্ষে, গ্র্যান্ড জুরি সংক্রান্ত সব প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রকাশ করতে।”

এই ধরনের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব অনেক ট্রাম্প সমর্থককে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে হওয়া হামলায় কিউএনন সমর্থকরাই সবচেয়ে দৃশ্যমান অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল।

গত নভেম্বরের নির্বাচনের ঠিক আগে করা পাবলিক রিলিজন রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের (পিআরআরআই) এক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ২০ শতাংশ আমেরিকান এমন বিবৃতি সমর্থন করেন, যা সরাসরি কিউএননের ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিশ্বাসটি হলো: “যুক্তরাষ্ট্র সরকার, গণমাধ্যম ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে শয়তান-উপাসক শিশুনিপীড়কদের একটি গোপন গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে, যারা বিশ্বব্যাপী শিশু পাচার চক্র চালায়।”

অনেকেই এপস্টিনের ঘটনাকে এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের সত্যতা হিসেবে দেখছেন। পিআরআরআই আরও জানায়, কিউএননে বিশ্বাসীদের বড় একটি অংশ ট্রাম্প সমর্থক। এই গোষ্ঠীর ৮০ শতাংশই ট্রাম্পের পক্ষে।

এই সমর্থন আবার প্রভাবও সৃষ্টি করেছে। ফেব্রুয়ারিতে বিচার মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে উপস্থিত থাকা পোসোবিয়েক সম্প্রতি প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথের সঙ্গে ইউরোপ সফরে যান বলে জানা গেছে।

তিনি আরও বিতর্কে জড়ান। কারণ তার নাৎসি মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু মানুষের সঙ্গে ছবি প্রকাশ পায়। যদিও তিনি নিজে কখনও শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী বলে স্বীকার করেননি।

এবিষয়ে বিবিসি তার মন্তব্য চেয়েও পায়নি।

তবে পোসোবিয়েক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এপস্টিন কেস আসলে আরও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত।

অ্যালেক্স মার্লোর পডকাস্টে তিনি বলেন, “এটা কোভিড, লকডাউন, ভ্যাকসিন—সব কিছুর সঙ্গে যুক্ত। এটা মানুষের ভেতরে জমে থাকা রাগের একাধিক স্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।”

এক সময়কার ট্রাম্প সমর্থক রিচ লজিস। তিনি মাগা আন্দোলন ত্যাগ করে লিভিং মাগা নামে একটি সংগঠন গড়েছেন। তিনি বলেন, এই অদ্ভুত সব ষড়যন্ত্রতত্ত্ব “মাগা সমর্থকদের মধ্যে একধরনের বন্ধনের কাজ করে”।

লজিস বলেন, ট্রাম্প এই সপ্তাহে এপস্টিন বিষয়ক উদ্বেগকে অগ্রাহ্য করে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তাতে তার কিছু সমর্থক “বিভ্রান্ত ও হতবাক” হয়েছেন। তারা আশা করেছিল ট্রাম্প কথা রাখবেন এবং যেসব ব্যক্তি এপস্টিনকে সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের পরিচয় প্রকাশ করবেন।

এপস্টিন ইস্যু ট্রাম্পের জন্য একটি রাজনৈতিক জটিলতা। এটি তার সমর্থকদের জন্যও সমস্যা হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যারা সোশাল মিডিয়ায় প্রভাবশালী মাগা মুখপাত্র। তারা বুঝে উঠতে পারছেন না এই ক্ষোভ কোথায় প্রকাশ করবেন। সরাসরি ট্রাম্পকে লক্ষ্যবস্তু বানালে নিজেদের অনুসারীদের ক্ষোভের মুখে পড়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত