Beta
শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সঞ্চয়পত্র : মুনাফা কমলেও বিক্রি বাড়ছে

Savings Certificates
[publishpress_authors_box]

দেশের একটি বড় সংখ্যক মানুষ জমানো টাকার লাভজনক ও নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন সঞ্চয়পত্র। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আগের দুই অর্থ বছরের মতো গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরেও সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। ফলে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।

এর মানে হচ্ছে, গত অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনও ঋণ পায়নি সরকার; উল্টো ওই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধ করতে হয়েছে।

গত বছরের আগস্টে রাষ্ট্র ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর এক বছর এক মাস পার হয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হয়নি। মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতাও বাড়েনি; মূল্যস্ফীতিতে এখনও সবাই দিশেহারা।

সরকারি হিসাবেই দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।

এরই মধ্যে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমানো হয়েছে। নতুন হার অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার হচ্ছে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।

কিন্তু অবাক করা তথ্য হচ্ছে, মুনাফার হার কমানোর পরও সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ার মধ্য দিয়ে নতুন অর্থ বছর শুরু হয়েছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর গত রবিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৯৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মানে হচ্ছে, ওই মাসে মোট যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর ১ হাজার ২৯৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা ছিল। এই অর্থ সরকার ঋণ হিসেবে নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য কাজে খরচ করেছে।

অথচ টানা তিন অর্থ বছর সঞ্চয়পত্র থেকে কোনও ঋণ পায়নি সরকার। অর্থাৎ ওই তিন বছরে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার থেকে বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ গ্রাহকদের পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে নিট বা প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ঋণাত্মক বা নেগেটিভ (-)।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বা প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা ধনাত্মক (+)। অর্থাৎ ওই অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছিল সরকার।

২০২১-২২ অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছিল সরকার।

কিন্তু পরের অর্থ বছর থেকে এই খাত থেকে কোনও ঋণ পায়নি সরকার। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে নিট বিক্রির অঙ্ক ছিল ২১ হাজার ১২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)।

সবশেষ গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্রে নিট বা প্রকৃত বিক্রর পরিমাণ দাঁড়িয় ৬ হাজার ৬৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা নেগেটিভ বা ঋণাত্মক (-)।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থ বছরে সব মিলিয়ে ৬৮ হাজার ৪৩৯ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ এবং মেয়াদ পুর্তির আগেই ভাঙানো বাবদ ৭৪ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

এ হিসাবেই নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৭৮ হাজার ৮৪৮ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ এবং মেয়াদ পুর্তির আগেই ভাঙানো বাবদ পরিশোধ করা হয় ৯৯ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।

এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সঙ্কটের এই সময়ে মুনাফার হার কমানোর পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কেন বাড়ছে- জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ কথা ঠিক যে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের গড়পড়তা আয় কমে গেছে। ফলে আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছে না। তারপরও যে যতোটুকু সঞ্চয় করছে পুরোটাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। মূলত নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সঞ্চয়পত্র কিনছে।

“সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমলেও ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়া বেশ কিছু ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হওয়ায় এবং কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করার আলোচনার মধ্যে ব্যাংকে টাকা রাখলে ফেরত পাওয়া যাবে কি না- তা নিয়ে সংশয় আছে। সব কিছু মিলিয়ে সবাই সঞ্চয়পত্রের দিকেই এখন ঝুঁকছে।”

দেশের সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা রাখে ব্যাংকে। তারপর নিরাপত্তা ও অধিক মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ বলা হয়ে থাকে।

প্রতি বছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে জাতীয় বাজেট পাস করে সরকার। এ ঘাটতি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে মেটানো হয়। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে আছে ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র খাত।

গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বিক্রিতে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় সংশোধিত বাজেটে সেটি কমিয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে। এবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি গত অর্থ বছরের মূল বাজেটের চেয়ে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা কম। আর সংশোধিত বাজেটের চেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা কম।

এদিকে চলতি অর্থ বছরে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র দাখিলের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। আগে এই সীমা ছিল ৫ লাখ টাকা।

এছাড়া গত অর্থ বছরের মাঝামাঝিতে এসে প্রতিষ্ঠান ব্যতীত ব্যক্তিপর্যায়ের সব সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা চালু করা হয়। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবের পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা আবার চালু করা হয়। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা তিন মাসের পরিবর্তে প্রতি মাসে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এসব কারণেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়তে পারে বলে মনে করেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

কোন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এখন কতো

বিক্রি কমে যাওয়ায় চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ বা মুনাফার হার বাড়ানো হয়। মেয়াদ পূরণ সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্রের ধরন অনুসারে এ হার বেড়ে হয় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার।

কিন্তু ছয় মাস না যেতেই সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানো হয়। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয় ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।

নতুন হার অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্রে কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার তুলনামূলকভাবে বেশি। বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার কম। এ ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ পরিমাণ বা এর কম হলে সুদহার বেশি হবে। ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার কমে আসবে।

দেশে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের অধীন যত ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্র। এ সঞ্চয়পত্রে এত দিন সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ। ১ জুলাই থেকে তা কমিয়ে করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে এ মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সেটা কমিয়ে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ করা হয়েছে।

পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পঞ্চম বছর শেষে, অর্থাৎ মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফা ছিল ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এখন তা করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ; এখন তা ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও কমানো হয়েছে। এ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। এখন তা ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। তা কমিয়ে করা হয়েছে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এছাড়া তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলেও মুনাফা কমবে। এ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। তা হয়েছে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। সেটা কমিয়ে করা হয়েছে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

এর বাইরে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবেও মুনাফার হার কমিয়েছে সরকার। তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হলে এবং সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। এখন তা ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ হার ছিল ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। এখন তা ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত