Beta
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫

চীনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবদান

চীনের খুদে ক্রিকেটারদের খেলাটা শেখাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ছবি : সংগৃহীত
চীনের খুদে ক্রিকেটারদের খেলাটা শেখাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ছবি : সংগৃহীত
[publishpress_authors_box]

১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ও চীন আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। বেইজিংয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সেই সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন হলো আজ (১৯ অক্টোবর)। ক্রীড়াঙ্গনে অনেক এগিয়ে থাকা চীনের ক্রিকেটে এই সময়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। তেমনি ব্যক্তি উদ্যোগে চীনের টেনিস উন্নয়নে কাজ করছেন বাংলাদেশি কোচরা। এ নিয়ে সকাল সন্ধ্যার দুই পর্বের আয়োজন। আজ প্রথম পর্বে থাকছে ক্রিকেট। লিখেছেন রাহেনুর ইসলাম

১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেবিল টেনিস দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশ্ব কূটনীতির ইতিহাসে ‘পিং পং কূটনীতি’র সূচনা করেছিল চীন। সেই ধারাতেই এ বছরের ১ মে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ওয়াও ওয়েন।

চীনের রাষ্ট্রদূত ওয়াও ওয়েন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রীতি ম্যাচ খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। ছবি : সংগৃহীত

দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে প্রীতি ম্যাচ খেলতে চীনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। চীনের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের অবদানও স্বীকার করেছিলেন ওয়াও ওয়েন। এ নিয়ে আসিফ মাহমুদের এডমিন ফেসবুকে লিখেছিল, ‘‘চীনের রাষ্ট্রদূত ওয়াও ওয়েন জানিয়েছেন, বন্ধুত্ব আরও গভীর করতে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে চীনে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে আমন্ত্রণ জানানো হবে। চীন বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণে সহায়তা করতে আগ্রহী বলেও জানান তিনি। এটি দুই দেশের ক্রীড়া কূটনীতির নতুন এক সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করেছে।’’

চীনের ক্রিকেটে আর্মস্ট্রং বুলবুল

ক্রিকেটকে বিশ্বজনীন রূপ দেওয়ার চিন্তা আইসিসির মাথায় আসে নব্বইয়ের দশকে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় তারা। এসিসির সহায়তায় আইসিসির চীন প্রকল্প গ্রহণ করে ২০০৫ সালে। সেখানে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করা ও বিসিবির বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল যুক্ত হন ২০০৭ সালে।

চীনের ভাষা শিখতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন মাসের একটা কোর্স করেছিলেন আমিনুল ইসলাম। এরপর এসিসিতে চাকরি পান ক্রিকেট উন্নয়ন কর্মকর্তার। চ্যালেঞ্জিং চাকরিটা নিয়ে আমিনুল শুরু করেন এক রোমাঞ্চকর ভ্রমণ।

অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল, ফুটবল, বেসবলের দেশ চীনে ক্রিকেটকে দেখা হত ঔপনিবেশিক খেলা হিসেবে। আমিনুল সেই ধারণাটা ভেঙেছেন প্রথমে। বুঝিয়েছেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে পেছনে ফেলতে ক্রিকেট শেখা জরুরি। এর পরই চীনাদের মনে ধরেছে এই খেলা।

রাজধানী বেইজিং দিয়ে শুরু করে চীনের প্রত্যন্ত গ্রামে ছুটে গিয়েছিলেন বুলবুল। খেলাটা বুঝিয়েছেন স্কুলে স্কুলে গিয়ে। শিখিয়েছেন মাঠে নেমে। তারপর প্রতিভা অনুসন্ধান। ১০০ জন ছেলে-মেয়েকে বাছাই করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নামিয়েছিলেন মাঠে। এরপর ধীরে ধীরে খেলাটা ছড়িয়ে পড়ে চীনে। দেশটিতে তাকে তুলনা করা হয় চাঁদে প্রথম পা রাখা নীল আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে!

এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) গেম ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে ২০১১ সালে চীনে কোচিংও শিখিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ছবি : সংগৃহীত

এ নিয়ে আমিনুল ইসলাম বুলবুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, ‘‘শুধু চীন নয় এসিসি বা আইসিসিতেও অনেকে আমাকে চীনের ক্রিকেটে নীল আর্মস্ট্রং বলে ডাকেন। শুরুটা খুব কঠিন ছিল। অলিম্পিকে সোনা জেতাই লক্ষ্য থাকে ওদের। অথচ ক্রিকেট অলিম্পিকে ছিল না (এখন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে)। জাভেদ মিয়াঁদাদকে একবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম চীনে। ওরা মিয়াঁদাদকে দেখে জানতে চাইছিল. ‘তিনি কয়টা অলিম্পিক সোনা জিতেছেন’! সেখান থেকে চীন যে একটা পর্যায়ে আসতে পেরেছে, এটা ভাবতেই ভালো লাগে।’’

বুলবুলের পর মঞ্জুরুল

চীনে আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে ডাকা হতো আমিন সিয়েন সাং নামে! চীনা ভাষায় সিয়েন সাং অর্থ সাহেব। অর্থাৎ বুলবুল হয়ে যান আমিন সাহেব। ১০০ জন ছেলে-মেয়ে নিয়ে শুরু করেছিলেন আমিনুল ইসলাম। সেই চীনে এখন রয়েছে ১২ লাখের বেশি ক্রিকেটার। ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত চীনের পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর পর এসিসির সদর দপ্তর থেকে প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করেছিলেন বুলবুল।

 এরপর চীনে সরাসরি উন্নয়ন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বাংলাদেশেরই আরেক টেস্ট ক্রিকেটার মঞ্জুরুল ইসলাম। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে লেভেল-৪ কোচিং কোর্স করা মঞ্জুরুল কাজ করেছেন চীনের ‍তৃণমূল ক্রিকেটে। এখন তিনি চীন নারী জাতীয় দলের কোচ। আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে মঞ্জুরুলের হাত ধরে চীন টি-টোয়েন্টিতে উঠে এসেছে ৪৩ নম্বরে। ছেলেদের টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে চীন আছে ৯০ নম্বরে।

মঞ্জুরুল ইসলাম এখন চীন নারী জাতীয় দলের কোচ। ছবি : সংগৃহীত

চীনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবদান নিয়ে মঞ্জুরুল বললেন, ‘‘চীনে ক্রিকেটের নাম বানছো। বান মানে ব্যাট আর ছো মানে বল। এই বানছোর উন্নয়নে বুলবুল ভাইয়ের অবদান ওরা কখনও ভুলবে না। আমিও চেষ্টা করছি মেয়েদের দলটাকে শক্তিশালী করার, যেন আমিও থাকি ওদের উন্নয়নের ইতিহাসে।’’

এশিয়ান গেমসের মাঠ তৈরিতে বাংলাদেশি কিউরেটর

ক্রিকেটের পরাশক্তি তিন দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা। তিনটি দেশই জিতেছে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তবে এশিয়ান গেমসে মাঠ তৈরিতে আয়োজকরা বেছে নিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। ২০১০ গুয়াংজুর পর ২০২২ (অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৩-এ) হাংজু এশিয়ান গেমসেও চীনে ক্রিকেটের মাঠ ও উইকেট প্রস্তুত করেছিলেন বাংলাদেশের কিউরেটররা। চীনের অনুরোধে বিসিবিই পাঠিয়েছিল তাদের।

হাংজু এশিয়ান গেমসে পাহাড়ের কোল ঘোষে জিজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তৈরি করা হয়েছিল ছোট্ট একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এর তত্ত্বাবধানে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও বাংলাদেশি কিউরেটর জসিমউদ্দিন। ২০১০ গুয়াংজু এশিয়ান গেমসের উইকেটও তৈরি করেছিলেন জসিমউদ্দিন।

জিজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তৈরি করা হয়েছিল ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ছবি : প্রতিবেদক

হাংজুতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছিল জসিমউদ্দিনের। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘ করোনার সময় আমি ছিলাম হংকংয়ে। তখন বিসিবি, এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল ও চীন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে সময় চীনে যাওয়াটা কঠিন ছিল। তবে আমি দু’জন কিউরেটরকে নিয়ে একাধিকবার গিয়েছি। এক বছর সময় লেগেছিল এই স্টেডিয়াম তৈরিতে। গামিনি ডি সিলভাকেও পাঠিয়েছিল বিসিবি। তিনি পিচ, আউটফিল্ড তত্ত্বাবধান করার পাশাপাশি স্থানীয়দের রক্ষণাবেক্ষণের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। সবমিলিয়ে চীনে এশিয়ান গেমস ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবদান মনে রাখবে চীন।’’

এশিয়ান গেমসে একমাত্র সোনাটি বাংলাদেশ ২০১০ সালে জিতেছিল ছেলেদের ক্রিকেটেই। সেটাও বাংলাদেশি কিউরেটারের তৈরি গুয়াংজু ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মাঠে। ক্রিকেটের উন্নয়নে চীন যেমন ভুলবে না বাংলাদেশকে, তেমনি এশিয়ান গেমসের সাফল্যে বাংলাদেশও ভুলবে না চীনকে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত