রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে অবশেষে কমল সোনার দর। এক ধাক্কায় সবচেয়ে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) সোনার দাম ভরিতে ৮ হাজার ৩৮৬ টাকা কমেছে; নেমেছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৯৫ টাকায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই একবারে সোনার দাম এতটা কমেনি। অন্যান্য মানের সোনার দরও প্রায় একই হারে কমানো হয়েছে।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের বাজারেও সোনার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২২ ক্যারেট মানের মূল্যবান এই ধাতুর দর ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকায় উঠেছিল।
আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতনে বুধবার (২২ অক্টোবর) দেশের বাজারেও সোনার দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)।
তিন দিন আগে ১৯ অক্টোবর ২২ ক্যারেট সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ৫০ টাকা বাড়িয়েছিল বাজুস; আর তাতেই ইতিহাস গড়ে ভরি ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকায় উঠেছিল।
এর আগে কখনোই সোনার দর এত উচ্চতায় ওঠেনি। চলতি অক্টোবর মাসেই সাত দফায় সোনার দাম ভরিতে ২২ হাজার টাকা বাড়ে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও সোনার দাম বাড়ানো হচ্ছিল। আগস্টের মাঝমাঝি সময় থেকে বিশ্ববাজারে সোনার দাম বাড়া শুরু হয়। তার সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারেও দাম বাড়িয়ে চলে বাজুস।
আগস্ট-সেপ্টেম্বর এই দুই মাসে দু-এক বার ছাড়া প্রতিবারই দাম বাড়িয়েছে বাজুস। সবশেষ সোনার দাম কমানো হয় ২৭ সেপ্টেম্বর; সেদিন ২২ ক্যারেট মানের সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ৮৯০ টাকা কমানো হয়।
১৯ অক্টোবরের আগে ১৪ অক্টোবর ২২ ক্যারেট মানের সোনার দর ভরিতে ২ হাজার ৬১৩ টাকা বাড়ায় বাজুস; ভরি ওঠে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকায়। ১৫ অক্টোব সারা দেশে এই দরে বিক্রি হয় সোনা।
তার একদিন আগে ১৩ অক্টোবর ৪ হাজার ৬১৯ টাকা বাড়ানো হয়; ভরি উঠেছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ৭১৯ টাকায়। ১৪ অক্টোবর ওই দরে বিক্রি হয় সোনার গহনা বা অলঙ্কার।
তার পাঁচ দিন আগে ৮ অক্টোবর ৬ হাজার ৯০৫ টাকা বাড়ানো হয়; ভরি উঠেছিল ২ লাখ ৯ হাজার ১০০ টাকায়। তার একদিন আগে ৭ অক্টোবর ১ হাজার ৪৭০ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাজুস। ৮ অক্টোবর ২ লাখ ২ হাজার ১৯৫ টাকা ভরিতে বিক্রি হয়।
৬ অক্টোবর ২২ ক্যারেট সোনার দাম ভরিতে ৩ হাজার ১৪৯ টাকা বাড়ানো হয়। ভরি ২ লাখ টাকার মাইলফলক ছাড়িয়ে ২ লাখ ৭২৬ টাকায় ওঠে।
তার দুই দিন আগে ৪ অক্টোবর বাড়ানো হয় ভরিতে ২ হাজার ১৯৩ টাকা বাড়ানো হয়; ভরি ওঠে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৭৬ টাকায়।
২৯ সেপ্টেম্বর বাড়ানো হয় ২ হাজার ৪১৪ টাকা; ভরি ওঠে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৪ টাকায়।
তার আগে কয়েক দফা বাড়ানোয় দেশের বাজারে সোনার ভরি রেকর্ড গড়ার পর ২৭ সেপ্টেম্বর ভরিতে ১ হাজার ৮৯০ টাকা কমানোর ঘোষণা দেয় বাজুস। এতে ভরি নামে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৬৯ টাকায়।
২৩ সেপ্টেম্বর এই মানের সোনার দাম ভরিতে ৩ হাজার ৬৬২ টাকা বাড়ানো হয়েছিল।
তার আগে টানা আট দফায় সবচেয়ে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) সোনার ভরি ১৮ হাজার টাকার বেশি বাড়ানোর পর ১৭ সেপ্টেম্বর ১ হাজার ৪৭০ টাকা কমিয়েছিল বাজুস।
১৮ সেপ্টেম্বর থেকে এই মানের সোনা ১ লাখ ৮৮ হাজার ১৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। দুই দিন না যেতেই ২০ সেপ্টেম্বর সোনার দাম ফের বাড়ানো হয়; ভরিতে বাড়ে ১ হাজার ১৫০ টাকা।
২১ সেপ্টেম্বর ২২ ক্যারেটের প্রতিভরি সোনা ১ লাখ ৮৯ হাজার ৩০৭ টাকায় বিক্রি হয়। একদিন পর ২২ সেপ্টেম্বর আরও ১ হাজার ৮৯০ টাকা বাড়ানো হয়।
১ সেপ্টেম্বর ২২ ক্যারেট সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ৪৭০ টাকা বাড়ানো হয়। ৩ সেপ্টেম্বর বাড়ানো হয় ৩ হাজার ৪৪ টাকা।
তার আগে গত ৩০ আগস্ট ভরিতে ১ হাজার ৬৬৮ টাকা বাড়ানো হয়। ২৬ আগস্ট বাড়ানো হয়েছিল ১ হাজার ৫০ টাকা।
এর আগে প্রায় এক মাস দেশের বাজারে মূল্যবান এই ধাতুর দাম একই জায়গায় স্থির ছিল।
বাজুসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে অস্থির ছিল দেশের সোনার বাজার। পুরো মাসে মোট ১২ বার দাম সমন্বয় করেছে বাজুস। এর মধ্যে ১০ বারই বেড়েছে দাম, কমেছে মাত্র দুইবার।
সেপ্টেম্বর মাসে ২২ ক্যারেট মানের প্রতিভরি সোনার দাম বেড়েছে ২১ হাজার ৬৬ টাকা।
সেই উল্লম্ফন অক্টোবর মাসেও চলছে। এই মাসে সাত দফায় ২২ ক্যারেট মানের সোনর দাম ভরিতে ২১ হাজার ৯৯৭ টাকা বেড়েছে।
চলতি বছর (২০২৫ সাল) এখন পর্যন্ত মোট ৬৭ বার সোনার দাম সমন্বয় করেছে বাজুস। এর মধ্যে ৪৮ বারই বেড়েছে, আর কমেছে মাত্র ১৯ বার।
গত বছর (২০২৪ সাল) পুরো সময়ে দাম সমন্বয় হয়েছিল ৬২ বার।
গত ২০ আগস্ট থেকে বিশ্ববাজারে সোনার দাম টানা বাড়ছিল। সেই দামের সঙ্গে সমন্বয় করে বাজুসও দেশের বাজারে এই ধাতুর দাম বাড়িয়ে চলেছে। মাঝে দুই দিন নিম্মমুখী হওয়ায় দেশের বাজারেও কিছুটা কমানো হয়।
বাজুস সাধারণত রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার দিকে সোনার দাম বাড়ানো-কমানোর ঘোষণা দিয়ে থাকে। পরের দিন থেকে সারা দেশে সেই দরে সোনা বিক্রি হয়।
তবে মাঝে-মধ্যে দিনে দুই বারও সোনার দাম বাড়ানো-কমানোর ঘোষণা দিয়ে থাকে সংগঠনটি।
বুধবার রাত ৯টার দিকে সোনার দাম কমানোর ঘোষণা দেয় বাজুস। দাম কমানোর ব্যাখ্যায় সংগঠনটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের (পিওর গোল্ড) মূল্য হ্রাস পেয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজুসের নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার থেকে দেশের বাজারে হলমার্ক করা এক গ্রাম ২২ ক্যারেট মানের সোনা ১৭ হাজার ৯১৮ টাকায় বিক্রি হবে। ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রামে এক ভরি হিসাবে প্রতিভরি বিক্রি হবে ২ লাখ ১৮ হাজার ৯৯৫ টাকায়। ২১ ক্যারেটের এক ভরি কিনতে লাগবে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৫০১ টাকা।
১৮ ক্যারেটের ১ লাখ ৭০ হাজার ৯৯৪ টাকায় এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতিভরি সোনা ১ লাখ ৪২ হাজার ২১৯ টাকায় বিক্রি হবে।
বুধবার পর্যন্ত দেশের বাজারে ২২ ক্যারেট মানের প্রতিভরি সোনা ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকায় বিক্রি হয়। ২১ ক্যারেটের বিক্রি হয় ২ লাখ ৭ হাজার ৫০২ টাকায়।
এছাড়া ১৮ ক্যারেটের ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৫৩ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতিভরি সোনা ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪ টাকায় বিক্রি হয়।
হিসাব বলছে, তিন দিনের ব্যবধানে প্রতিভরি ২২ ক্যারেটের সোনার দাম কমছে ৮ হাজার ৩৮৬ টাকা। ২১ ক্যারেটের কমছে ৮ হাজার ১ টাকা।
এছাড়া ১৮ ক্যারেটে ৬ হাজার ৮৫৮ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতিভরি সোনার দাম কমছে ৫ হাজার ৮৫৫ টাকা।
বিশ্ববাজারেও দরপতন
বিশ্ববাজারেও সোনার দরে পতন হয়েছে; গত তিন দিন ধরেই নামছিল। রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে প্রতি আউন্সের (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) দাম ৪ হাজার ২৫০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৪ হাজার ৩৮ ডলার ৭৭ সেন্টে নেমে এসেছে। শতাংশ হিসাবে কমেছে ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
গত ১৯ অক্টোবর রাতে বাজুস যখন দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় তখন প্রতিআউন্স সোনার দাম ছিল ৪ হাজার ২৪৯ ডলার ৯৪ সেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করার পর সোনার দাম হু হু করে বাড়ছিল। ২২ এপ্রিল প্রতি আউন্স সোনার দাম ৩ হাজার ৫০০ ডলার ছাড়ায়।
এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দর ৩ হাজার ৫০০ ডলারের নিচে লেনদেন হচ্ছিল। আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে বাড়তে থাকে মূল্যবান এই ধাতুর দর।
রূপার দরও কমেছে
সোনার সঙ্গে বাজারে রূপার দামও কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বাজুস। সংগঠনটি জানিয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে হলমার্ক করা প্রতিভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) ২২ ক্যারেট মানের রূপা ৫ হাজার ৪৭০ টাকায় বিক্রি হবে।
বুধবার পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ২০৫ টাকায়। যা ছিল এতদিন রেকর্ড।
এ হিসাবে ২২ ক্যারেট মানের রূপার দাম ভরিতে ৭৩৫ টাকা কমেছে।
অন্যান্য মানের সোনার দরও প্রায় একই হারে কমিয়েছে বাজুস।