Beta
সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৫

বেসরকারি ঋণে প্রবৃদ্ধি তলানিতে, সেপ্টেম্বরে নামল ৬.২৯ শতাংশে

ss-Private-sector-credit-growth-051212
[publishpress_authors_box]

কমতে কমতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমেছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ গত বছরের একই মাসের চেয়ে মাত্র ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বনিম্ন।

দ্বিতীয় মাস আগস্টে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ গত বছরের একই মাসের চেয়ে মাত্র ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রবৃদ্ধি ইতিহাসের সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গত ২২ বছরের যে তথ্য রয়েছে, তাতে দেখা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে একবার প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমেছিল। এর আগে বাংলাদেশে কখনোই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নামেনি। এমনকি করোনা মহামারীর মধ্যেও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে ছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক রবিবার বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, গত ১ জুলাইয়ে শুরু হওয়া ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরের চেয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়েছে।

আগের মাস অর্থাৎ অর্থ বছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ; প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।

গত অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। এপ্রিলে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। মার্চে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাস শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৫৬ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৫২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা।

এ হিসাবেই সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। আর এই খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। প্রায় এক বছর ধরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের কম থাকার কোনও তথ্য বাংলাদেশে নেই।

অথচ বেশি দিন আগে নয়- তিন বছর আগে ২০২২ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বর্তমানের চেয়ে দিগুণেরও বেশি ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ উঠেছিল।

এর অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি খাত এখন ব্যাংকঋণ নিচ্ছে কম, বিনিয়োগও করছে কম। অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগও কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে।

গত বছরের আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বেনামি-জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কমে আসায় এবং দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ও পর্ষদে পরিবর্তন হয়েছে এমন ১১টি ব্যাংকের নতুন ঋণ প্রদান বন্ধ থাকায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।

এই ব্যাংকগুলো এখন আমানতকারীদের টাকার চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে।

এদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে আসায় অনেক ব্যাংক সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। এতে ঋণের চেয়ে বেশি মুনাফা মিলছে। কারণ, ঋণ দিলে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি থাকে আর বিল ও বন্ডে মুনাফা নিশ্চিত হয়।

মুদ্রানীতিতে লক্ষ্য ৮ শতাংশ

গত ৩১ জুলাই ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে নীতি সুদহার (রেপো রেট) ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত রেখে দেশে বিনিয়োগ খরার মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। আর আগামী বছরের জুনে অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের শেষ মাসে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনও মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির এতো কম লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়নি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরা আছে, সেপ্টেম্বরে তার থেকে দশমিক ৯১ শতাংশীয় পয়েন্ট কম অর্জিত হয়েছে।

২০২২ সালের নভেম্বর থেকে নিম্নমুখী

বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের নিম্নমুখী ধারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০২২ সালের নভেম্বরে শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে তা আরও কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, কমতে কমতে গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে আসে। তার আগে মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। এপ্রিলে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ; মার্চে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। তার আগে নভেম্বরে ৭ দশমিক ৬৬, অক্টোবরে ৮ দশমিক ৩০, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ২০, আগস্টে ৯ দশমিক ৮৬, জুলাইয়ে ১০ দশমিক ১৩ এবং জুনে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

বিনিয়োগ মানেই অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য, বিনিয়োগ মানেই নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে দেয় স্বস্তি। এই সূত্রে বাংলাদেশ এখন আছে বেশ অস্বস্তিতে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, তিন বছর ধরে নিম্মমুখী অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। ২০২২ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।

২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

করোনা মহামারীর ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।

বিদেশি বিনিয়োগেও একই হাল

রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরেই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) মন্দাভাব চলছিল। গত বছরের (২০২৪ সাল) শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) তা ৭১ শতাংশ কমে যায়।

তবে চলতি বছরের (২০২৫ সাল) প্রথম তিন মাসে (প্রথম প্রান্তিক, জানুয়ারি-মার্চ) এফডিআই আসার হার বেড়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে মোট ১৪৯ কোটি ৭৯ লাখ (১.৫০ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল। এর মধ্যে ৭০ কোটি ৯৯ লাখ ডলার ফেরত নিয়ে গিয়েছিলেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

সে হিসাবে, গত জানুয়ারি-মার্চ সময়ে নিট এফডিআইর পরিমাণ ছিল ৭৮ কোটি ৮১ লাখ ডলার।

কিন্তু পরের তিন মাসের (দ্বিতীয় প্রান্তিক, এপ্রিল-জুন) চিত্র ঠিক উল্টো। এই তিন মাসে দেশে মোট ১০১ কোটি ৬৮ লাখ (১.০১ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে ৭১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার ফেরত নিয়ে গেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

সে হিসাবে, গত এপ্রিল-জুন সময়ে নিট এফডিআইর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, যা জানুয়ারি-মার্চ সময়ের চেয়ে ৬১ দশমিক ৫২ শতাংশ কম।

এডিপি বাস্তবায়নেও করুণ দশা

গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৬৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যা দুই দশক বা ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে (প্রথম প্রান্তিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর) এডিপি বাস্তবায়নের হার গত অর্থ বছরের মতোই হতাশাজনক; মাত্র ৫ দশমিক শূন্য নয়শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে বাস্তবায়নের হার ছিল ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার অর্থ হলো বিনিয়োগ থমকে যাওয়া। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে না। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

আগের চেয়ে বিনিয়োগ এখন অনেক বেশি দামি হয়ে গেছে। একদিকে বেড়েছে ডলারের দাম, অন্যদিকে ব্যাংক সুদহারও চড়া। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ করতে গেলে আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে।

আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বাজারে পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের জন্য এ সময়টাকে মোটেই অনুকূল মনে করছেন না ব্যবসায়ীরা।

গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ব্যবসার পরিবেশে অনিশ্চয়তা আর ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহারের প্রভাবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়িয়েই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; উঠেছে ১০ শতাংশে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের এক বছর দুই মাস হতে চলেছে। এখনও দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি। উল্টো দিন দিন অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

মূল্যস্ফীতি ফের ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। টানা চার মাস কমে জুনে এই হার ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছিল।

অর্থ বছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমে এসেছিল। সেপ্টেম্বরে তা আবার বেড়ে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে উঠেছে।

অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মানে হলো ব্যবসা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাবে। সেই সঙ্গে কমবে নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণের গতি। অবধারিতভাবে তার প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। অর্থনীতিতে দেখা দেবে মন্দা।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শুরু থেকেই অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশ উত্তাল হতে শুরু করে। একপর্যায়ে ছাত্রদের আন্দোলনে সহিংস ঘটনায় দেশে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতার পালাবদলের পর সেই অস্থিরতা আরও বাড়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। সেই পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।

জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে নতুন নতুন জটিলতা ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে দেশে। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ- সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে।

অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের উদ্বেগ

দেশের বিনিয়োগ ও বেসরকারি খাতে ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে সঙ্কোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করছে। ফলে সব ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে।

এক্ষেত্রে ক্ষমতার পটপরিবর্তনেরও একটা প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন এবিবির সাবেক সভাপতি।

মাহবুবুর রহমান বলেন, “যেকোনো দেশের বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হচ্ছে বিনিয়োগ সহায়ক অনুকূল পরিবেশ। বর্তমানে দেশে স্থিতিশীলতা নেই; অনিশ্চয়তা আছে। আগামী দিনগুলো কী হবে, নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। এমন অবস্থায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছেন, যার প্রভাবে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সংঘাত-নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে।

“এমন পরিস্থিতিতে ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী- কেউই ঠিকমতো ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছেন না। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করেই চলেছে। এর অংশ হিসেবে নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। সব মিলিয়েই বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।”

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই। এ অবস্থায় বিনিয়োগ করবে কে? ঋণ নেবে কে?”

তিনি বলেন, “করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দর বৃদ্ধি, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ- একের পর এক ধাক্কায় বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর লেগেছে আরেক ধাক্কা। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।”

“সবাই নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার আসার আগ পর্যন্ত দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না,” যোগ করেন আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংলাপেও দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

‘অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক ওই সংলাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা এলেও রাজনৈতিক খাতে আসেনি। নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল নয়। সবকিছু মিলিয়ে এখনই কেউ বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এমন প্রত্যাশা কাল্পনিক।”

গভর্নর বলেন, “সরকারের দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল। একটি হলো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আর সংস্কারের এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক, তারা যেন এটাকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আরও সুদৃঢ়ভাবে আর্থিক খাতকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।”

সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। প্রবন্ধে তিনি বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত, কর-জিডিপি অনুপাত কমেছে। মূল্যস্ফীতি এখনও উচ্চ পর্যায়ে। খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

তিনি বলেন, “গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতে সংস্কারসহ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ রপ্তানি খাতকে ভালো অবস্থায় রেখেছে এবং বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। কিন্তু বিনিয়োগ হচ্ছে না। কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না। রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। এগুলো উদ্বেগের বিষয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত