Beta
রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

টিভি ‘গিলে খাওয়ার পর’ এবার সিটকম যেভাবে ইউটিউবের টার্গেট

youtube 1
[publishpress_authors_box]

ইউটিউব গত দুই দশক ধরে বিজ্ঞাপনদাতাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে যে এটি ভবিষ্যতের বিনোদনের মাধ্যম। তাদের যুক্তি সবসময়ই ছিল সহজ—“তরুণ প্রজন্ম আর কেবল টিভি দেখে না; তারা ইউটিউব দেখে।” এই বার্তা বোঝাতে কোনও পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপনারও প্রয়োজন পড়ে না।

তবে ইউটিউবের এই দাবিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বরাবরই কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রথমত, সাইটে আপলোড হওয়া অধিকাংশ ভিডিওর মান চলচ্চিত্র নির্মাতা মার্টিন স্করসেজির কোনও ভিডিওর মানের ধারেকাছেও নয়। 

টাইম ওয়ার্নারের সাবেক নির্বাহী ডগ শাপিরো ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে লিখেছিলেন, “ক্রিয়েটর কনটেন্টের সবচেয়ে বড় সমালোচনাই হলো এর নিম্নমান—যেন জঞ্জাল, বাজে, অব্যবস্থাপূর্ণ কিছু।” 

তবে তিনি বলেন, অধিকাংশ মানুষ এই সব এলোমেলো ভিডিও দেখে না, তারা দেখে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘জঞ্জাল’। আর এখানেই ইউটিউবের দ্বিতীয় বড় সমস্যা—এই জনপ্রিয় চ্যানেলগুলো অনেক সময় বিজ্ঞাপনদাতাদের পক্ষে অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে।

হাই-প্রোফাইল কিছু উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। সুইডিশ ইউটিউবার ফেলিক্স কজেলবার্গ পিউডাইপাই নামে পরিচিত। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তিনি তার কিছু ভিডিওতে ইহুদি-বিদ্বেষী রসিকতা করেন। তাকে পরে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী বন্দুক হামলাগুলোর অনুপ্রেরণাদানকারী হিসেবেও অভিযুক্ত করা হয়। 

অন্যদিকে ইউটিউবার লোগান পল গেমিং ও প্র্যাঙ্ক ভিডিওর মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেন এবং পরে কুস্তিগির-ইনফ্লুয়েন্সারে রূপান্তরিত হন। তিনি ২০১৭ সালে জাপানের এক ‘সুইসাইড ফরেস্ট’-এ একটি আত্মহত্যার দেহ নিয়ে ভিডিও ধারণ করেন। 

২০২০ সালে জেস্টেশন নামে পরিচিত কানাডিয়ান ইউটিউবার জেসন এথিয়ার ‘রানিং ফ্রম দ্য কপস’ বা ‘২৪ আওয়ার ওভারনাইট চ্যালেঞ্জ ইন জেইল’ এর মতো ভিডিওর জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি শুধু ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য তার ইউটিউব চ্যানেলে মিথ্যা দাবি করেন যে তার প্রেমিকা অ্যালেক্সিয়া মারানো মদ্যপ চালকের গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। 

এই ধরনের বিষয়াদি নিয়ে এনবিসি বা অন্য টিভি চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপনদাতাদের সাধারণত ভাবতে হয় না। (ওই তিন ইউটিউবারই পরে দুঃখ প্রকাশ করেন। ইউটিউব পরে জেস্টেশনের চ্যানেলটি তাদের নীতিমালা লঙ্ঘনের কারণে মুছে দেয়। মারানো এক ভিডিওতে জানান, তিনি এই প্রতারণায় রাজি ছিলেন না। বিষয়টি তাকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল।)

এমন প্রেক্ষাপটে, বিজ্ঞাপনদাতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ইউটিউব চেষ্টা করে ভিডিওর মান উন্নয়নে। ২০১১ সালে তারা ঘোষণা দেয় যে, তারা ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে মূলধারার মৌলিক কনটেন্ট তৈরিতে। 

এই অর্থ দিয়ে পপ কালচার বিশ্লেষক ফিলিপ ডি ফ্রাঙ্কো ও অভিনেত্রী ফেলিসিয়া ডে’র মতো জনপ্রিয় নির্মাতাদের চ্যানেলগুলোতে বিনিয়োগ করা হয়। ফ্রাঙ্কোর চ্যানেলের ফলোয়ার সংখ্যা এখন ৬৬ লাখের বেশি। আর ফেলিসিয়া ডে ‘দ্য গিল্ড’ নামের ওয়েব সিরিজের জন্য খ্যাত। এটি ছিল তার গেমার জীবন নিয়ে তৈরি।

চার বছর পর ইউটিউব সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক ভিডিও প্ল্যাটফর্ম ‘ইউটিউব রেড’ চালু করে। এই প্ল্যাটফর্মে দর্শক আকর্ষণের জন্য তারা সীমিতসংখ্যক মানসম্মত সিরিজ তৈরি করে। ইউটিউব তখন হলিউডের বর্ষীয়ান নির্বাহী সুজান ড্যানিয়েলসকে নিয়োগ দেয়। তিনি ‘ডসনস ক্রিক’ ও ‘বাফি দ্য ভ্যাম্পায়ার স্লেয়ার’  নির্মাণে যুক্ত ছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় ‘কোবরা কাই’। এটি ‘দ্য কারাটে কিড’ সিনেমার ঘটনার ৩০ বছর পরের কাহিনী নিয়ে নির্মিত।

২০১৭ সাল থেকে ইউটিউব বিজ্ঞাপনভিত্তিক মৌলিক সিরিজে বিনিয়োগ শুরু করে। তখন এটি বিনামূল্যে প্রদর্শন করা হতো। এর মধ্যে ছিল ‘কেভিন হার্ট: হোয়াট দ্য ফিট’। এতে কেভিন হার্ট বিভিন্ন সেলিব্রিটির সঙ্গে শরীরচর্চা করেন—যেমন কনান ও’ব্রায়েন, ডিজে খালেদ ও রেবেল উইলসন।

তবে ইউটিউবের মূল পরিকল্পনার বেশিরভাগই বৃহৎ দর্শকগোষ্ঠী আকর্ষণে ব্যর্থ হয়। ড্যানিয়েলসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ছিলেন তরুণ লেখক কিন্তা ব্রানসন। তিনি ‘ব্রোক’ নামে একটি কমেডি সিরিজ তৈরি করেন—তিন বন্ধুর ফিলাডেলফিয়া থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে পাড়ি জমানোর গল্প নিয়ে। 

ওই সিরিজটি এক মৌসুমেই বন্ধ হয়ে যায়। ব্রানসন পরে তৈরি করেন এবিসির জনপ্রিয় সিরিজ ‘অ্যাবট ইলেমেন্টারি’। ইউটিউব ধীরে ধীরে মূলধারার কনটেন্ট তৈরির উদ্যোগ বন্ধ করে দেয় এবং ‘কোবরা কাই’ সিরিজের ভবিষ্যতের মৌসুমের স্বত্ব বিক্রির অনুমতি দেয় সনি টেলিভিশন স্টুডিওকে। পরে এই সিরিজটি নেটফ্লিক্সে প্রচারিত হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সুজান ড্যানিয়েলস ২০২২ সালে ইউটিউব ছেড়ে দেন।

অন্যদিকে ইউটিউব বিদ্যমান কনটেন্ট পরিষ্কার ও নিয়ন্ত্রিত করার মাধ্যমে বেশি সাফল্য পায়। তারা এমন তারকাদেরকে প্রমোট করতে থাকে, যাদের কাছ থেকে বিতর্কিত কনটেন্টের ঝুঁকি কম। 

জাপানের সুইসাইড ফরেস্টের মতো বিষয় শনাক্তে মনিটরিং টুল তৈরি করা হয়। এছাড়াও তারা বড় তারকাদের নিয়ে মার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালায়, যাতে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে তারা যেন সিনেমা তারকার মতো মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, লস অ্যাঞ্জেলেসের বিলবোর্ডে উঠে আসে হিউস্টনের অভিনেত্রী লাইজা কোশি কিংবা স্কেচ কমেডি গ্রুপ স্মশ-এর মুখ।

এছাড়া ইউটিউব এমন প্রোগ্রাম চালু করে, যেখানে কোম্পানিগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয় ১ শতাংশ ভিডিওতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের সুযোগ পায়। মিস্টারবিস্ট, গুড মিথিক্যাল মর্নিং ও ফার্স্ট উই ফিস্ট —যেখানে দেখা যায় জনপ্রিয় শো ‘হট ওয়ানস’—এর মতো চ্যানেলগুলো এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, অনেক বিজ্ঞাপনদাতা হয়তো ইউটিউবকে এখনও ‘প্রিমিয়াম’ মানেন না, কিন্তু দর্শকদের তাতে কিছু আসে যায় না। 

হরাইজন মিডিয়া ইনকরপোরেশনের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ক্যাম্পানেলি বলেন, “ইউটিউব এখন এতটাই প্রভাবশালী যে, বিজ্ঞাপনদাতাদের মিডিয়া পরিকল্পনা ও ভিডিও কৌশলের বড় একটি অংশ হয়ে উঠেছে।”

তবুও ইউটিউবের মূল কোম্পানি গুগলের অনেক নির্বাহী মনে করেন, ইউটিউবকে আরও বড় ব্র্যান্ডের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে হবে। কারণ এই বড় ব্র্যান্ডগুলোর বিজ্ঞাপন ব্যয় এখনও প্রধানত টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলোর দখলে। 

ইউটিউব এখনও তাদের আয়ের বড় অংশ পায় অপেক্ষাকৃত সস্তা, নির্দিষ্ট দর্শকের জন্য তৈরি বিজ্ঞাপন থেকে। অনেক বিজ্ঞাপনদাতা মনে করেন, তাদের বিজ্ঞাপনগুলো ইউটিউবের কমদামি, ছোট ছোট ভিডিওর পাশে প্রদর্শিত হলে সেগুলোর প্রভাব টেলিভিশনের তুলনায় অনেক কম হয়। অধিকাংশ ভিডিও আবার মোবাইল বা ল্যাপটপে দেখা হয়। ফলে এটি বড় পর্দার মতো প্রভাব তৈরি করতে পারে না।

গত কয়েক বছর ধরে ইউটিউব চেষ্টায় আছে যেন এটি বসার ঘরের মূল বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। এজন্য তারা বিভিন্ন টেলিভিশন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ফলে এখন টিভিতে ইউটিউব দেখা সহজ। ফোন বা ল্যাপটপে দেখা ঠিক ততটাই সহজ হয়েছে।

বর্তমানে টিভির পর্দায় ইউটিউব ভিডিওতে মন্তব্য করা যায়, চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করা যায় এবং কনটেন্ট নির্মাতারা ভিডিওগুলো এমনভাবে সাজাতে পারেন যেন সেগুলো টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পর্বের মতো হয়। ইউটিউব এখন ব্যবহারকারীদের স্মরণ করিয়ে দেয় তারা কোন পর্বে শেষ করেছিলেন এবং পরবর্তী পর্ব চালু করে দেয়। এটি আগের মতো আর এলগরিদম নির্ভর করে অন্য নির্মাতার একটি অনুরূপ ভিডিও চালু করে না।

টিভি দেখার অভিজ্ঞতা আরও ভালো করার জন্য ইউটিউব বিজ্ঞাপনের বিন্যাসে পরিবর্তন এনেছে। এখন বিজ্ঞাপন বিরতির মাঝে আরও বেশি সময়ের ফাঁক রাখা হয়। প্রতিষ্ঠানটি “পজ বিজ্ঞাপন” চালু করেছে। এটি তখনই দেখা যায় যখন কেউ ভিডিও বন্ধ রাখে।

ইউটিউব টিভি নামে একটি লাইভ-টিভি পরিষেবা চালু করেছে। এতে কেবল টিভির মতো বিভিন্ন চ্যানেল দেখা যায়—বিশেষ করে যেসব চ্যানেলে এনএফএল (ন্যাশনাল ফুটবল লিগ) সম্প্রচার হয়। এছাড়াও ইউটিউব একটি স্টোরফ্রন্ট চালু করেছে যেখানে ম্যাক্স ও প্যারামাউন্ট+ এর মতো পেইড স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলো পাওয়া যায়।

বর্তমানে সব বয়সের দর্শকের জন্য ইউটিউবই টিভি পরিষেবার প্রথম পছন্দ। ইউটিউবের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ এখন টেলিভিশনে ইউটিউব দেখার পেছনে ফোন বা কম্পিউটারের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছে। ইউটিউব টিভি বাদ দিয়ে শুধু ইউটিউবই এপ্রিল মাসে টেলিভিশন দেখার মোট সময়ের ১২ শতাংশের বেশি দখল করেছিল—যা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির সমস্ত টিভি নেটওয়ার্ক ও স্ট্রিমিং পরিষেবার সম্মিলিত অংশের চেয়েও বেশি। 

নিলসেনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউটিউব দর্শকদের প্রায় ৪০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে, যা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত গোষ্ঠী।

ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নীল মোহান বলেন, “মানুষ যখন টিভি চালায়, তারা ইউটিউব চালায়।” যেখানে প্রচলিত টিভির বিজ্ঞাপন বিক্রি স্থবির হয়ে গেছে, ইউটিউব সেখানে গত পাঁচ বছরে তার বিজ্ঞাপন আয় দ্বিগুণেরও বেশি করেছে। ২০১৯ সালে যেখানে আয় ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলার, ২০২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে। এখন ইউটিউব একাই চারটি বড় টেলিভিশন চ্যানেলের সম্মিলিত বিজ্ঞাপন আয়ের চেয়েও বেশি আয় করছে।

হলিউডের অনেক কর্তাব্যক্তি এখনও ইউটিউবকে তুচ্ছ করে দেখানোর চেষ্টা করেন। নেটফ্লিক্সের সহ-প্রধান নির্বাহী টেড সারানডোস সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেন, ইউটিউব এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ শুধু সময় নষ্ট করে, আর নেটফ্লিক্স এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ প্রকৃতভাবে সময় ব্যয় করে।

তবে এসব মন্তব্যে এখন আতঙ্কের গন্ধ পাওয়া যায়—আত্মবিশ্বাসের নয়। যেমনটা হলিউড আজকাল শ্রমিক আন্দোলন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা সিনেমা হলের পতন নিয়ে চিন্তিত। ইউটিউবের উত্থান তার চেয়েও বাস্তব ও তাৎক্ষণিক হুমকি।

ইউটিউব কীভাবে নিজেদের প্রাথমিক সময়ের অগোছালো মৌলিক প্রোগ্রামিং থেকে বেরিয়ে এসে নির্মাতা ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রথম পছন্দে পরিণত হয়েছে, তা বুঝতে জানতে হবে অ্যালান চিকিন চাও নামের এক ব্যক্তিকে।

বর্তমানে ইউটিউবের বড় নির্মাতারা ভিডিওর দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ বা তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন যাতে বড় পর্দায় দেখার উপযোগী হয়। অবশ্য দীর্ঘ ভিডিওতে বেশি বিজ্ঞাপন দেখানোও সম্ভব। কেউ কেউ শুধু দীর্ঘ পডকাস্ট রেকর্ড করছেন। তবে অ্যালান চিকিন চাওর মতো কিছু নির্মাতা ইউটিউব শর্টসের (তিন মিনিট বা তার কম) বদলে এখন পূর্ণদৈর্ঘ্য সিটকম নির্মাণ করছেন—যেমন ‘অ্যালান’স ইউনিভার্স’।

এই অনুষ্ঠানটি অনুপ্রাণিত হয়েছে আমেরিকার জনপ্রিয় টুইন সিরিজ বয় মিটস ওয়ার্ল্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুল-নাটক বয়েজ ওভার ফ্লাওয়ার্স ও জাপানি অ্যানিমে থেকে। ২০২৩ সালেই অনুষ্ঠানটি মিলিয়ন মিলিয়ন দর্শক পেতে শুরু করে।

চাও নিজেই এই অনুষ্ঠানের প্রধান লেখক ও মূল চরিত্র। তার কলেজ বন্ধু চেলসি সিক এতে অভিনয় করেন—প্রায়শই প্রেমের ভূমিকায় এবং কখনও কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। প্রতিটি পর্ব একই স্কুল এবং চরিত্রকে ঘিরে হলেও গল্পগুলো ধারাবাহিক নয়। 

চাও প্রথমে প্রতিটি পর্বের জন্য একটি শিরোনাম ঠিক করেন, যেমন “কেউ জানতো না আমি বিখ্যাত গায়ক।” যদি কোনও গল্পে ভালো সাড়া পাওয়া যায়, তিনি সেই গল্প আবার বলেন নতুন মোড়ে।

চাও বলেন, “আমরা খুব সচেতনভাবে এমন কনটেন্ট তৈরি করি যা এক বছর পরেও কেউ দেখে আগ্রহ হারাবে না।” উদাহরণস্বরূপ, জানুয়ারিতে তিনি আপলোড করেন “কেউ জানে না আমি বিখ্যাত পপ স্টার।” এই দুটি পর্ব এখন পর্যন্ত সম্মিলিতভাবে ৮২ মিলিয়নের বেশি বার দেখা হয়েছে। 

অন্য একটি পর্ব “ছেলে বনাম মেয়ে : স্কুলের নিয়ন্ত্রণ” এখন পর্যন্ত ৬২ মিলিয়নের বেশি ভিউ পেয়েছে এবং এটি সম্ভবত অনুষ্ঠানের সবচেয়ে দেখা পর্বে পরিণত হবে। শিরোনামের মতোই, ওই পর্বে চাও ও সিক প্রতিটি লিঙ্গের নেতা হিসেবে স্কুলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। একের পর এক প্রকাশ্য ও গোপন ষড়যন্ত্রের পর, শেষ পর্যন্ত তারা প্রেমে পড়ে যান।

ডালাসে বেড়ে ওঠা চাও ছোটবেলা থেকেই নিজের সিটকম বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। তিনি প্রবাসী ক্যান্টনিজ পরিবারের সন্তান। “চিকিন” শব্দের অর্থ ক্যান্টনিজ ভাষায় “জেদি”। ছোটবেলায় তিনি হান্নাহ মনটানা ও জর্জ লোপেজ দেখে বড় হয়েছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় পড়াশোনা করেছেন—মেজর করেছেন স্ক্রিনরাইটিং এবং বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে। অভিনয়ের মাধ্যমে হলিউডে যাত্রা শুরু করেন, গ্রে’স অ্যানাটমির মতো সিরিজে অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

তবে অন্যের কনটেন্টে অভিনয় করার চেয়ে নিজে কিছু তৈরি করার দিকেই তার আগ্রহ বেশি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রিচ নামের একটি ক্লাবের সদস্য হন। সেখানে শিক্ষার্থীরা সোশাল মিডিয়া কনটেন্ট নির্মাতা হওয়ার জন্য কাজ করত। এরপর ২০১৯ সাল থেকে তিনি টিকটক ও ইউটিউবে ভিডিও আপলোড শুরু করেন।

২০২৩ সালের শুরুতে অ্যালান চিকিন চাও এক গভীর আত্মসঙ্কটের মধ্য দিয়ে যান। তখন পর্যন্ত তিনি ইউটিউব শর্টসের সবচেয়ে জনপ্রিয় নির্মাতা হয়ে উঠেছিলেন। মজার সব কৌতুকনির্ভর ছোট ভিডিওর মাধ্যমে তিনি কোটির ওপর অনুসারী সংগ্রহ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, “কাপল গোলস গন ঠু ফার” নামের একটি ভিডিওতে (যার ভিউ ৬৬৪ মিলিয়নের বেশি) চাও নিজের প্রেমিকাকে খুশি করার জন্য হাস্যকর সব কাণ্ড করেন। 

ভিডিওতে দেখা যায়, প্রেমিকার পোশাক নষ্ট হয়ে গেলে চাও নিজের হুডি খুলে দিয়ে তার স্পোর্টস ব্রা পরে নেন। এমনকি, এক অচেনা লোক যখন তার প্রেমিকার পেছনে চাপড় দেয় তখন চাও নিজেই ওই লোককে নিজের পশ্চাৎদেশে স্পর্শ করতে বলেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে বিকৃত করা “মাই হার্ট উইল গো অন” গানটি। এটি টাইটানিক ছবির বিখ্যাত সাউন্ডট্র্যাক। 

আরেকটি ভিডিও “জোম্বি ফানফিকস বি লাইক” (যার ভিউ ৫৫৪ মিলিয়নের বেশি), যেখানে চাও একজন জোম্বি শিকারি এবং প্রেমে পড়ে যান এক জোম্বি নারীর সঙ্গে, যার আগ্রহ থাকে মানুষের বাহু খাওয়ার প্রতি। শেষ পর্যন্ত, তাকে খুশি রাখতে চাও তাকে একটি মুখোশ কিনে দেন।

তবে এসব ভিডিওর বাইরে চাও চেয়েছিলেন এমন কিছু গল্প বলার, যেগুলো শিশু-কিশোরদের মনে দাগ কাটবে, যেমনটা তার বেলায় সিটকমগুলো করেছিল। ইউটিউব চ্যানেল চালু করার চার বছর পর তিনি সেটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন “অ্যালান’স ইউনিভার্স” এবং এটিকে নিজের নতুন চিত্রনাট্যভিত্তিক নাটকের প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করেন।

২০২৩ সালের জুলাইয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার বারব্যাঙ্ক শহরের একটি সাধারণ অফিস ঘরকে “অ্যালান’স ইউনিভার্স” স্টুডিওতে রূপ দেন চাও। মেকআপ রুমটি একটি পুরনো অফিস ঘর, যার পাশেই একটি লকার রুম। নিচতলায় রয়েছে একজন টিনএজারের জীবনের কয়েকটি প্রধান দৃশ্যপট—শোবার ঘর, স্কুল ক্যাফেটেরিয়া এবং একটি ছোট জায়গা, যেটিকে প্রয়োজনে নানা সেটে রূপান্তর করা যায়, যেমন: নাচ প্রতিযোগিতার জন্য ক্যাটওয়াক। প্রতিটি রুমের মধ্য দিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে আছে তার-কেবল, যেগুলোর ওপর হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা সবসময় থাকে। একটি সাক্ষাৎকারে চাও বলেন, “এখানে সবকিছুই আপনি যেমন চাইবেন, তেমনই হয়ে যাবে।”

চাও একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি স্ক্রিপ্টেড কনটেন্টের মাধ্যমে কিশোরদের মাঝে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। ধর মান নামের আরেকজন ইউটিউবার আড়াই কোটির বেশি সাবস্ক্রাইবার নিয়ে তার চ্যানেলে নিয়মিত ইতিবাচক ও মূল্যবোধসম্পন্ন গল্প প্রকাশ করেন। তার ভিডিওগুলোর বেশিরভাগই বুলিং বা হেনস্তা নিয়ে। তার ২৮ মিনিটের এক ভিডিওতে দেখা যায় গ্রেটা নামের এক আমিশ মেয়ে তার স্বাধীনতা উপভোগ করতে গিয়ে স্কুলে বঞ্চনার শিকার হয়। সে কম্পিউটার চালাতে না পারা এবং ভেন্ডিং মেশিনের সঙ্গে কথা বলার কারণে উপহাসের পাত্র হয়। কিন্তু শেষে এক বুলির মনোভাব বদলায় এবং গ্রেটাকে থেকে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। এরপর সে একটি ব্যান্ড গড়ে ও একজন প্রেমিক খুঁজে পায়।

ধর মান স্টুডিও প্রতি সপ্তাহে চার থেকে পাঁচটি ৩০ মিনিটের মূলধারার ভিডিও প্রকাশ করে। তাদের লক্ষ্য দর্শক ১৩ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা। ধর মান শুরু করেছিলেন ফেসবুকে অনুপ্রেরণামূলক বার্তা দিয়ে, যখন তিনি তার স্ত্রীর বিউটি ব্যবসায় সহায়তা করছিলেন। এখন তিনি ইউটিউবের অন্যতম বড় স্ক্রিপ্টেড কনটেন্ট নির্মাতা। তার বারব্যাঙ্কের তিনটি সাউন্ড স্টেজে রয়েছে মল, অ্যাপার্টমেন্ট, স্কুল ও একাধিক দোকানের সেট। বছরে কয়েক কোটি ডলার আয় করেন তিনি বিজ্ঞাপন থেকে। তার কর্মী সংখ্যা এখন প্রায় ২০০। ধর মান বলেন, “বিশ্বে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে—এমন কনটেন্টই সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হয়।”

ইউটিউব চাইছে দর্শকরা সেখানে শর্টস, পডকাস্ট, নার্সারি রাইম, এনএফএল, স্ট্রিমিং সার্ভিস ও ৩০ মিনিটের মূলধারার শো সব এক জায়গায় পায়। এখন পর্যন্ত স্ক্রিপ্টেড সিরিজগুলো সেই অফুরন্ত ভিডিও ভাণ্ডারের একটি মাত্র বিভাগ। 

ইউটিউবের সাম্প্রতিক বার্ষিক বিজ্ঞাপন উপস্থাপনাতে চাও ও ধর মান উপস্থিত থাকলেও, তারা মঞ্চে ওঠেননি। সেই জায়গায় ছিলেন মিস্টারবিস্ট, হট ওয়ানস এর উপস্থাপক শন এভানস, এনএফএল কমিশনার রজার গুডেল ও লেডি গাগা। তবে চাও ও মানের সাফল্য দেখায়, ইউটিউব ও হলিউডের মধ্যে পার্থক্য দিন দিন মুছে যাচ্ছে।

স্ক্রিপ্টেড কনটেন্টে পা দিয়ে চাও ও মান সাফল্য পেয়েছেন, যেখানে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। “ফ্রেড” ও “রেড বনাম ব্লু” ছাড়া খুব কম ওয়েব সিরিজই সফল হয়েছে ইউটিউবে। কারণ বেশিরভাগ দর্শক নির্দিষ্ট কোনও চ্যানেল দেখতে ইউটিউব খোলেন না। তারা আগের ভিউ দেখেই নতুন ভিডিওর সাজেশন পান বা অনলাইনে লিঙ্ক খুঁজে পান। তাদের জন্য একটি ভিডিওর শিরোনাম ও থাম্বনেইলই গুরুত্বপূর্ণ হয়। 

তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খরচ। স্ক্রিপ্টেড ভিডিও তৈরি করা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ব্যয়বহুল। “গেম অব থ্রোনস” বা “সেভারেন্স”-এর মতো সিরিজের একটি পর্বে খরচ হয় প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার। মিস্টারবিস্ট প্রতি ভিডিওতে ৩০ থেকে ৪০ লাখ ডলার খরচ করেন। বেশিরভাগ ইউটিউব চ্যানেল এত আয়ের ব্যবস্থা করতে পারে না।

“অ্যালানস ইউনিভার্সের” বাজেট প্রতি পর্বে প্রায় ১ দশমিক ২ লাখ ডলার। তা সত্ত্বেও, মিডিয়া নির্বাহী শন অ্যাটকিন্সের মতে, অদূর ভবিষ্যতেই স্ক্রিপ্টেড শো বড় হবে। তিনি বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে এমন ভিডিও বানানো আরও সহজ ও সাশ্রয়ী হবে, যা প্রাপ্তবয়স্কদের মন জয় করতে সক্ষম হবে।

গুণমানও একটি সমস্যা। ইউটিউব এখন আর বিজ্ঞাপনদাতাদের আশ্বস্ত করতে হয় না যে এটি একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম। তবে হলিউড ও বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোকে এখনও বোঝাতে হয় যে আগের ‘ঘোলাটে কনটেন্ট’-এর যুগ শেষ। যদিও এখনকার প্রযোজনা মান অনেকটা স্টুডিওর মতো এবং বাজেট ১ লাখ ডলারের বেশি, তবুও চাও ও মানের ভিডিওগুলোকে টিভি সিটকমের তুলনায় কম মূল্য দেওয়া হয়। ধর মান প্রতি দর্শকপ্রতি যে অর্থ পান, তা টিভি শো-এর ২৫ শতাংশ মাত্র। পাশাপাশি ইউটিউব তার আয়ের ৪৫ শতাংশ ভাগ রেখে দেয়, যদিও এটি অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের তুলনায় ভালো চুক্তি।

হলিউড স্টুডিও এবং অন্যান্য বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোও ইউটিউব চ্যানেলগুলো কিনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ডুড পারফেক্ট গ্রুপ হাইমাউন্ট ক্যাপিটাল থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ সংগ্রহ করেছে এবং টেক্সাসের ফ্রিসকোতে একটি ৮০,০০০ বর্গফুটের স্টুডিও খুলেছে। 

তারা এখন আরও বেশি ভিডিও তৈরি করছে যেখানে তারা নিজেরা থাকেন না এবং “ট্রিক শট”-এর বাইরে নতুন কনটেন্ট তৈরি করছেন। মিস্টারবিস্টের ব্যবসা থেকে বছরে আয় হয় ২০০ মিলিয়ন ডলার এবং তার ফিস্টেবলস চকলেট ব্যবসা ২০২৪ সালে আয় করেছে ২৫০ মিলিয়ন ডলার। তিনি আলফা ওয়েভ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের মূল্যায়নে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছেন। ধর মান এখন হলিউডের বৃহৎ প্রতিভা সংস্থা সিএএ-এর অধীনস্থ একটি বিনিয়োগ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছেন।

এই বিনিয়োগ কেবল বাড়তেই থাকবে কারণ অর্থ সেখানে যায়, যেখানে দর্শক আছে। নেলসনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রতি মুহূর্তে ৭ মিলিয়নের বেশি মানুষ টিভিতে ইউটিউব দেখছে। সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকা দর্শকগোষ্ঠী হলো ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বের মানুষ। 

ইউটিউব এখন বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিজ্ঞাপন থেকে এবং ২০ বিলিয়ন ডলার সাবস্ক্রিপশন থেকে আয় করছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান মোফেট ন্যাথালসন অনুসারে, ইউটিউব খুব শিগগিরই ডিজনির মিডিয়া ব্যবসাকে রাজস্বে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তারা ইউটিউবকে আখ্যা দিয়েছে “দ্য নিউ কিং অব অল মিডিয়া” হিসেবে।

তবুও ইউটিউব এখনও সংবেদনশীল এ বিষয়ে যে, এখানকার কনটেন্ট নেটফ্লিক্স বা এবিসি-তে নির্মিত কনটেন্টের চেয়ে নিম্নমানের। এজন্য তারা “হট ওয়ানস”-এর মতো শো’কে এমি পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতায় আনতে কোটি কোটি ডলার বিজ্ঞাপন খরচ করছে। যদিও এখনও কোনও এমি পুরস্কার জেতা হয়নি। 

ইউটিউব সিইও নীল মোহন বলেন, “কোনও শোয়ের জন্য খরচ করা অর্থ মানেই গুণমান নয়। এটি হতে পারে পুরনো ধারার প্রোডাকশন ভ্যালুর ধারণা। আমি আমাদের নির্মাতা-নেতৃত্বাধীন স্টুডিও কনটেন্টকে আগের প্রচলিত টিভি কনটেন্টের পাশে রাখার সাহস রাখি।” যদিও বিজ্ঞাপনদাতা ও হলিউড কর্মকর্তারা এখনও একমত না, তবে মনে হচ্ছে, সেই দিন আর দূরে নয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত