Beta
সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫

হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের রোষানলে ভারতীয় সিনেমা, ঘোষণা এল পরিবর্তনের

l2-empuran
[publishpress_authors_box]

হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর সমালোচনার পর ভারতের মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ড্রাস্টির সুপারস্টার মোহনলাল এক ফেইসবুক পোস্টে নিজের নতুন সিনেমা থেকে কিছু দৃশ্য বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন।

বৃহস্পতিবার মালায়ালাম ভাষার সিনেমা ‘এল২: এম্পুরান’  মুক্তি পাওয়ার পরপরই বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করতে শুরু করে।

কিন্তু, গুজরাট রাজ্যে ২০০২ সালের মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার মতো কিছু দৃশ্য থাকার কারণে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-এর সদস্যসহ হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে এটি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

মোহনলাল ফেইসবুকে লিখেছেন, “একজন শিল্পী হিসেবে, আমার দায়িত্ব যে আমার কোনো সিনেমা যেন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন, আদর্শ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন না হয় সেটি নিশ্চিত করা।”

কেরালা রাজ্যের (যেখানে মালায়ালাম চলচ্চিত্র শিল্পের আবাসস্থল) ঘরে ঘরে পরিচিত মোহনলাল আরও যোগ করেন, “এম্পুরান- এর দল এবং আমি আন্তরিকভাবে আমার প্রিয়জনদের কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত, এবং চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত সকলের ওপর এর দায়ভার বর্তায়। এই উপলব্ধি থেকে আমরা একসাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিনেমা থেকে এই ধরনের বিষয়গুলো সরিয়ে দেওয়ার।”

এই ঘটনায় শিল্পের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ভারতে। বিরোধী কংগ্রেস এবং বাম দলগুলো বিজেপিকে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ওপর চাপ সৃষ্টির অভিযোগ করেছে।

তবে, বিজেপি নেতারা বলেছেন যে, দলটি সিনেমার বিরুদ্ধে কোনো প্রকাশ্য প্রচার চালায়নি এবং সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশের অধিকার মানুষের আছে।

একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিয়ে ইতিমধ্যেই নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নায়ক মোহনলাল।

সিনেমাটি কী নিয়ে?

‘এল২: এম্পুরান’ ২০১৯ সালের মালায়ালাম রাজনৈতিক থ্রিলার ‘লুসিফার’- এর সিক্যুয়েল, যেখানে মোহনলাল স্টিফেন নেদুমপল্লী নামে এক রহস্যময় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সিনেমার একটি পর্যায়ে স্টিফেন নেদুমপল্লী চরিত্রটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

মালায়ালাম তারকা পৃথ্বীরাজ পরিচালিত সিনেমাটি বক্স অফিসে দারুণ ব্যবসা করে এবং চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও সমালোচকদেরও ইতিবাচক পর্যালোচনা পেয়েছে।

তাই ‘এল২: এম্পুরান’- এর প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। সিক্যুয়েল সিনেমাটি কেরালার রাজনীতি যখন দুর্নীতি আর অশুভ শক্তির হাতে বন্দি, তখন একজন ত্রাতা হিসেবে মোহনলালের চরিত্রের পুনরাগমন ঘটে। এই সিনেমার মূল কাহিনী আবর্তিত হয় কেরালাকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করার প্রয়াসকে কেন্দ্র করে।

মুক্তির আগেই সিনেমাটি এর বাজেট (তুলনামূলকভাবে স্বল্পভাষী মালায়ালাম চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য বিশাল) এবং তারকা-খচিত প্রচারের জন্য সংবাদের শিরোনাম হয়। ‘এল২: এম্পুরান’ ভারতে এবং এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মুক্তির দিন ভারতের প্রেক্ষাগৃহগুলো ছিল হাউজফুল।  

চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ ট্র্যাকার স্যাকনিল্কের মতে, সিনেমাটি উদ্বোধনী সপ্তাহান্তে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন রুপি (১৭.৫ মিলিয়ন ডলার; ১৩.৫ মিলিয়ন পাউন্ড) আয় করেছে।

কিন্তু সিনেমাটি সমালোচকদের কাছ থেকে মিশ্র পর্যালোচনা পেয়েছে।

হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা এটিকে ‘একটি পরিচয় সংকটের, অতিরিক্ত দীর্ঘ সময় এবং একটি বিভ্রান্তিকর স্ক্রিপ্টের গোলকধাঁধায় আটকে থাকা সিনেমা’ বলে অভিহিত করেছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলেছে, “লুসিফার-এ যে আবেগগত গভীরতা এবং নাটকীয় ওজন ছিল, তা এম্পুরান-এ প্রায় অনুপস্থিত কিন্তু ‘মোহনলালের শক্তিশালী অভিনয়’ এবং সিনেমার অন্যান্য কিছু দিক প্রশংসিত হয়েছে।”

ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে?

‘এল২: এম্পুরান’ সিনেমাটি জায়েদ মাসুদ (পরিচালক পৃথ্বীরাজ অভিনীত) নামক একটি চরিত্রের পেছনের গল্প দিয়ে শুরু হয়, যিনি ভারতের একটি স্থানের দাঙ্গায় এতিম হয়েছিল। এর কিছু বিবরণ ২০০২ সালে মোদী যখন গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন সংঘটিত ধর্মীয় সহিংসতার মতো ছিল। দীর্ঘ ফ্ল্যাশব্যাকে সহিংসতার সময় হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক অপরাধ করার কিছু গ্রাফিক দৃশ্য দেখানো হয়েছে। সিনেমায় আরও দেখানো হয় যে- কীভাবে সহিংসতার অপরাধীদের মধ্যে একজন বছরের পর বছর ধরে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং কেরালার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ সুরক্ষিত করতে চায়। এই দৃশ্যগুলোই ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাজীব চন্দ্রশেখর মুক্তির আগে সিনেমার দলকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। পরে তিনি বলেন যে, তিনি এখন বুঝতে পেরেছেন যে ‘সিনেমায় এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা মোহনলালের ভক্ত এবং অন্যান্য দর্শকদের বিরক্ত করেছে’।

তিনি বলেন, “একটি সিনেমাকে সিনেমা হিসেবে দেখা উচিত। এটিকে ইতিহাস হিসেবে দেখা যায় না। এছাড়াও, যে কোনো সিনেমা সত্যকে বিকৃত করে গল্প তৈরির চেষ্টা করে, তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।”

তিনি সিনেমাটি দেখবেন না বলেও জানান। কিছু রাজ্য বিজেপি নেতা এটিকে সমর্থন করলেও, অন্যরা নির্মাতাদের সমালোচনা করে এবং সিনেমায় ’দেশবিরোধী থিম’ চিত্রিত করার অভিযোগ এনেছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) দ্বারা প্রকাশিত ‘দ্য অর্গানাইজার উইকলি’ পত্রিকা। বিজেপির আদর্শগত অভিভাবক হিসেবে পরিচিত এই সাপ্তাহিকটি সিনেমাটিকে ‘সিনেমা ছদ্মবেশে একটি বিরক্তিকর, বিভাজনমূলক গল্প’ বলে অভিহিত করেছে।

তাদের পর্যালোচনায় বলা হয়, “এম্পুরান শুধু একটি খারাপ সিনেমা নয়; এটি বিশ্বাস, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ এবং ভারসাম্যপূর্ণ গল্প বলার মূল আত্মার ওপর আক্রমণ।” কয়েককজন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী সিনেমাটি বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছে, তবে সিনেমার বিরুদ্ধে কোনো বড় আকারের অনলাইন প্রচার বা বড় প্রতিবাদ হয়নি।

সিনেমাটিতে কী পরিবর্তন আনা হবে?

সপ্তাহান্তে, সিনেমার প্রযোজকদের মধ্যে একজন গোকুলাম গোপালন জানান, তিনি পৃথ্বীরাজকে ‘যদি এম্পুরানের কোনো দৃশ্য বা সংলাপ কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকে’ সেটি পরিবর্তন করতে বলেছেন।

এরপরে রোববার মোহনলাল ফেইসবুক পোস্টে নিশ্চিত করেন যে সিনেমার কিছু দৃশ্য সরানো হবে। পৃথ্বীরাজ ফেইসবুকে পোস্টটি শেয়ার করেছেন, কিন্তু অতিরিক্ত কোনো মন্তব্য করেননি।

কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিনেমাটিতে ১৭টি পর্যন্ত দৃশ্য কমানো হবে। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে তিন মিনিটের একটি দীর্ঘ দৃশ্য সরানো হবে এবং কিছু সংলাপ নিঃশব্দ করা হবে।

নির্মাতারা এখনও কোনো পরিবর্তন নিশ্চিত করেননি। ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন (সেন্সর বোর্ড নামে পরিচিত) সিনেমাটি ছাড়পত্র দিয়েছিল। তবে নির্মাতাদের আরও কাটের জন্য এটি পুনরায় জমা দেওয়ার বিকল্প রয়েছে। এই বিতর্কের মধ্যে, ‘এল২: এম্পুরান’ কেরালার ক্ষমতায় থাকা ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী), সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস- এর সমর্থন পেয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, “এম্পুরান এবং এর নির্মাতাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ঘৃণামূলক প্রচার অত্যন্ত বিরক্তিকর।”

তিনি আরও যোগ করেন, “ভয় এবং হুমকির মাধ্যমে সৃজনশীল স্বাধীনতাকে দুর্বল করা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তির ওপর আঘাত হানে।”

কংগ্রেস নেতা ভিডি সাথীসান লিখেছেন, “সিনেমা শিল্পীদের একটি দলের কাজ। সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে হুমকি, অপমান ও লাঞ্ছিত করে একটি শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করা কোনও বিজয় নয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত