Beta
বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৫

ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে মোহ ধরিয়ে দিয়েছিলেন মুন্না

শুধু এপার বাংলা নয়, ওপার বাংলার ফুটবলেও নক্ষত্র হয়ে আছেন মোনেম মুন্না। ছবি: ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ফেইসবুক
শুধু এপার বাংলা নয়, ওপার বাংলার ফুটবলেও নক্ষত্র হয়ে আছেন মোনেম মুন্না। ছবি: ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ফেইসবুক
[publishpress_authors_box]

আজ (১২ ফেব্রুয়ারি) সুপারস্টার মোনেম মুন্নার ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ক্রীড়া সাংবাদিক পার্থ রুদ্র’র প্রয়াণেরও দুই বছরের বেশি হয়ে গেল। কলকাতার আজকাল পত্রিকার এই সাংবাদিকের প্রথম মুন্না-দর্শনের গল্পটা খুব মনে পড়ছে। বাংলাদেশে ক্রিকেট কাভার করতে এসে তিনি মুন্নার নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে যেতে খুবই আগ্রহী। এমন মরিয়া হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, “তাকে দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। আমার সব ধারণা পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি।”

চমকে দেওয়ার গল্পটা অন্যরকম, “মুন্না দা সবে এসেছেন ইস্টবেঙ্গলে। ঢাকার এই ফুটবলারকে নিয়ে সবার বেশ আগ্রহ। একরাতে তার আড্ডায় যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ক্লাবের দু-একজন কর্মকর্তাও ছিলেন তখন। ফুটবলের নানা গল্প, সঙ্গে খানা-পিনা চলছিল। সেই করতে করতে প্রায় ভোর! আমি বুঝে নিয়েছিলাম, পরদিন বিগ ম্যাচে এই ফুটবলারের কী অবস্থা হবে। নিজে পরিকল্পনা করে ফেলি দল হারলে, তিনি খারাপ খেললে, সারা রাতের আড্ডার বিবরণ দিয়ে দারুণ এক কপি করে ফেলবো।”

মানে রিপোর্ট তৈরি করবেন। কিন্তু পরদিন মুন্নার পারফরম্যান্স ও ইস্টবেঙ্গলের জয় দেখে পার্থ বিস্ময়ে বিমুঢ়, “আমি যত প্রশংসা করব মুন্না দা’র, তা-ও কম হয়ে যাবে। ওই ম্যাচের প্রতিটি মুভে, প্রতিটি ট্যাকেলেই দেখি তিনি। এককথায়, ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় তিনি। সারা রাত গল্প-গুজব করে একজন ফুটবলার কীভাবে এমন খেলতে পারে, সেটা কোনও হিসাবেই মেলে না। সেদিন থেকেই তাকে গুরু মানছি! দুই বাংলা মিলিয়ে এমন ফুটবলার হবে কিনা, জানি না।”

মোনেম মুন্না কেমন ফুটবলার? এই ডিফেন্ডার খেলতেন স্টপার পজিশনে। ১৯৮৭ সালে ব্রাদার্স থেকে আবাহনীতে যাওয়ার পর তার জীবনটা আকাশী-নীলে একাকার হয়ে যায়। ক্লাবটাকে এমন ভালোবেসেছিলেন ওই সময়ে ব্রাদার্সের ৩০ লাখ টাকার অফারও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এই ডিফেন্ডার। দলের সব তারকা ১৯৯৪ সালে যখন মুক্তিযোদ্ধায় চলে যায় তখন মুন্না তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে একাই লড়ে গেছেন এবং শিরোপা উপহার দেন আবাহনীকে।

সাফল্যের সঙ্গে প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডদের ট্যাকলের পাশাপাশি তিনি মাঠে ও মাঠের বাইরে ছিলেন দুর্দান্ত এক নেতা। কিডনি প্রতিস্থাপনের পরও মাস্ক পরে তিনি আবাহনীর ম্যানেজারের দায়িত্ব সামলেছেন। তরুণদের মন জিতেছেন। তার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠে অনেকে বড় ফুটবলার হয়ে খেলেছেন জাতীয় দলে। মুন্নার আবাহনীময় জীবন বৈচিত্র্যে ভরা। তার অধিনায়কত্বে ১৯৯৬ সালে লাল-সবুজের ফুটবল প্রথম শিরোপা শোভিত হয় মিয়ানমারে চারজাতি ফুটবল টুর্নামেন্ট জিতে। এই হলো এপার বাংলায় এক দেশসেরা ডিফেন্ডারের মহাতারকা হয়ে ওঠার গল্প।

ওপার বাংলায় সেই গল্প আরও রসোত্তীর্ণ হয়। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্য তমাল গুহ বলছেন লাল-হলুদে মুন্নার রাঙিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা, “ওই সময় মুন্না ছাড়া আসলাম ও রুমি এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গলে খেলতে। কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়ে মুন্না হয়ে গেলেন অসাধারণ। আমাদের ক্লাবের ঘরের ছেলে। আমি নিয়মিত মাঠে গিয়ে খেলা দেখার মানুষ। এই ৫৮ বছর বয়সেও খেলা দেখতে যাই। প্রথম ম্যাচ থেকেই মুন্না অন্যরকম মোহ ধরিয়ে দিয়েছিল গ্যালারিতে। মাঠে অদ্ভুত তার দাপট, সেটাই হয়তো তার দর্শক-সমর্থকদের মন জয় করে নেওয়ার অন্যতম কারণ।”

ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক ছিল আবাহনীর সংগঠক হারুনুর রশিদের। দুই পক্ষের সম্পর্কের সুবাদেই ১৯৯১ সালে মোনেম মুন্না কলকাতা যান ইস্টবেঙ্গলে খেলতে। এরপর আরও দুই দফায় ১৯৯৩-৯৪ ও ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমেও খেলেছেন তিনি। তবে প্রথম প্রণয়ের স্মৃতিটাই অনন্য হয়ে আছে তমাল গুহ’র মনে, “১৯৯১ সালে ইস্টবেঙ্গল দল তেমন ভালো খেলছিল না লিগে। কিন্তু মুন্না যোগ হওয়ার পর দলের কৌশলটাই বদলে ফেলেন কোচ নাঈমুদ্দিন। মুন্না ডিফেন্ডার হলেও তাকে খেলালেন সুইপার পজিশনে। এই পজিশনে তিনি এত ভালো খেলেছেন, বিশেষ করে দারুণ বল ডিস্ট্রিবিউশন দিয়ে তিনি সবার নজর কাড়েন। সুব্রত ভট্টাচার্য ভালো ডিফেন্ডার হলেও এই গুণ তার ছিল না। নতুন পজিশনে মুন্না এত ভালো খেলেছেন তাতে পুরো দলের খেলাটাই বদলে গেছে এবং ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়।”

সেই থেকে মুন্নার কলকাতা জয়। এপারের মতো ওপার বাংলায়ও আশি-নব্বইয়ের দশকে ফুটবলের জন-জোয়ার ছিল। বড় বড় বাঙালি ফুটবলারের আধিপত্যে চলতো ভারতীয় ফুটবল। তাই নতুন ফুটবল তারকা হিসেবে মোনেম মুন্নার বিশেষ ভক্তকূল তৈরি হয় কলকাতায়। সেটা এমনই ভালোবাসার জায়গায় পৌঁছে ছিল যে, কলকাতায় পুজো মণ্ডপ উদ্বোধনেও ডাক পড়ছিল তার। খ্যাতির চূড়োয় ওঠে তিনি কলকাতায় বাংলাদেশ ফুটবলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে উঠেছিলেন।

কিন্তু ফুটবল বেশিরভাগ সময় বিশেষভাবে মনে রেখেছে স্ট্রাইকারদের। গোলের কৃতিত্বটাকেই বড় করে দেখেছে। সুবাদে তুমুল তারকাখ্যাতি মেসি-রোনালদোর মতো ফুটবলারদের। একজন ডিফেন্ডারের পক্ষে সেই খ্যাতির চূড়ায় ওঠা বড় কঠিন। তমাল মনে করেন, “মাঠের খেলা ও মাঠের বাইরের মুন্নার মধ্যেই এক ধরনের আকর্ষণ ছিল। সেটাই তাকে আলাদা করে দিয়েছে।”

তাই ইস্টবেঙ্গলের হল অব ফেমে ঢুকে গেছে মোনেম মুন্নার ছবি। একই সঙ্গে পরম যত্নে থাকবেন ওপার বাংলার ফুটবলানুরাগীদের হৃদয়েও।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত