বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
তাতে যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা এখন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসাবে পরিচিত হবেন।
বীরাঙ্গনা এবং মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থাকলেও বাদ পড়ছেন কণ্ঠসৈনিক এবং প্রবাসে থেকে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা। তারাও সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচিত হবেন।
২০২২ সালে প্রণীত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন (জামুকা) সংশোধন করে মঙ্গলবার রাতে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। গত ১৫ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আইন সংশোধনের প্রস্তাবটি অনুমোদন পেয়েছিল।
অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধসহ আরও কিছু বিষয়ে নতুন সংজ্ঞা যুক্ত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধার সহযোগীর সংজ্ঞাও নির্ধারণ করা হয়েছে নতুন করে।
আগের আইনের প্রস্তাবনায় থাকা ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বাদ দেওয়া হয়েছে অধ্যাদেশে।
মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা
সংশোধিত আইনে মুক্তিযুদ্ধ বলতে বোঝানো হয়েছে- “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ।”
নতুন সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধা কারা
সংশাধিত আইনে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মূলত সরাসরি অস্ত্র হাতে লড়াই করা ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- “যারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সকল বেসামরিক নাগরিক এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তি বাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও উক্ত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্যরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।”
নতুন সংজ্ঞায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীর মাধ্যমে নির্যাতিত সব নারী (বীরাঙ্গনা)দের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহকারীরারও হবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সহযোগী কারা
নতুন আইনে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর সংজ্ঞায় যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি, তাদের পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।
সহযোগীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- “বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে অবস্থান করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপটে যেসব বাংলাদেশের নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছেন।”
৫টি শ্রেণী
১. যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
২. যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগ করা চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
৩. মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ; যারা পরে গণপরিষদের সদস্য গণ্য হয়েছিলেন।
৪. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক।
৫. স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
নতুন আইনে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বলতে বোঝানো হবে কোনও মুক্তিযোদ্ধার স্বামী বা স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও বাবা-মাকে।
কী ছিল আগের সংজ্ঞায়
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের কাজটি শুরু হয়েছিল। সেই তালিকায় কেবল যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের নামই কেবল ছিল।
তবে মুক্তিযোদ্ধাদের এই তালিকা নিয়ে প্রতিটি সরকারের আমলেই বিতর্ক উঠেছিল।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০১৬ সালে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল।
সেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়েছিল- “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গণ্য হবেন।”
তারা কারা, তা সুনির্দিষ্ট করে তখন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল-
ক) যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং/প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত করেন।
খ) যে সব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং যে সব বাংলাদেশি বিশিষ্ট নাগরিক বিশ্বে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
গ) যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীনে কর্মকর্তা/কর্মচারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ঘ) সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনীর সদস্য যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছেন।
ঙ) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএগণ ও এনপিএগণ (গণপরিষদ সদস্য)।
চ) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিত নারীগণ (বীরাঙ্গনা)।
ছ) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীবৃদ্ধ এবং দেশ ও দেশের বাইরে দায়িত্বপালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিকগণ।
জ) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়বৃন্দ।
ঝ) মুক্তিযুদ্ধকালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা প্রদানকারী মেডিকেল টিমের ডাক্তার, নার্স, সহকারীবৃন্দ।