Beta
মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫

শিক্ষকদের শিক্ষক অধ্যাপক টি এ চৌধুরী

“জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে,

চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন নদে?”

স্যারের মৃত্যু খবর শুনলাম, সেই থেকে মনটা ভালো নেই। যেন বার বার স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছি। না-ফেরার দেশে চলে গেলেন, আমাদের পিতাসম শিক্ষক, দীক্ষাগুরু, আমার মতো অসংখ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসাবিদ্যার হাতেখড়ি যে মেন্টরের হাতে, বাংলাদেশের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা শাস্ত্রের প্রবাদ পুরুষ, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত গুণীজন, পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ডা. তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী।

অধ্যাপক এ এইচ এম তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী নামটি। দেশের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিষয়ের কিংবদন্তিতুল্য এই চিকিৎসক দীর্ঘ ছয় দশক নারীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন।

সাধারণ মানুষ তো বটেই, আমাদের কাছেও স্যার পরিচিত ছিলেন এই নামেই, এই নামেই মানুষ তাকে চিনেছে, তার এ নামের পেছনে যেন হারিয়ে গিয়েছিল তার আসল নামটাও।

স্যারের মৃত্যুর খবরে সারদিন অফিস আর চেম্বারের ফাঁকে নিজেকে খুব অসহায় লেগেছে। মনে হয়েছে মাথার উপর থেকে একটি ছায়া চলে গেল। আর আমার মতো অসংখ্য চিকিৎসক সন্তান পিতাহীন পৃথিবীর রুক্ষ রোদে ক্ষর হৃদয়ে উপনীত হলাম।

ডা. টি এ চৌধুরীর সঙ্গে ডা. গীতা গাইন

আজ স্মৃতির পাতায় অজস্র কথা ভেসে উঠছে।

সব যে মনে আছে, সেটাও না। অনেক দিন আগের সব।  

স্মৃতি মাঝে মাঝে প্রতারণাও করে, অনেক কিছু মুছে যায়। মহা-শ্রদ্ধার যে সকল শিক্ষককে অন্তরের অন্তঃস্থলে রেখেছি শ্রদ্ধার আসনে, সেখান থেকে তাদের নিয়ে কিছু বলা আরও বেশি দুরূহ। আর স্মৃতির সাথে আবেগের কলহ থাকলে স্মৃতিরোমন্থন আরও কষ্টের হয়ে ওঠে। আমার আমার পরম পূজ্য মেন্টর অধ্যাপক ডা. টি এ চৌধুরী স্যারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই কথাটি আরও স্পষ্ট হচ্ছে।

আমার সরাসরি শিক্ষক হিসেবে টিএ চৌধুরী স্যারকে পাই ২০১০ সালে। তিনি আমাদের বিশেষজ্ঞ গাইনেকোলজিস্ট তৈরির নন-রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে ক্লাস নিতেন। সে বছরই আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার ডিপ্লোমা কোর্সে সুযোগ পাই।

আমার মনে আছে, প্রথম ক্লাসেই স্যারকে দেখে মনে হয়েছিলো, উনি গোটা মানুষটাই একটা ‘কম্পিউটার’। গাইনি বিষয়ের সকল কিছু কম্পিউটারের মতোই ওনার নখদর্পনে! কোনও রকম বিরতি ছাড়াই উনি এক একটি টপিক পড়িয়ে যেতেন। কখনও ওনাকে বই বা নোট খুলতে দেখিনি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ তখন স্যারের কারণে গাইনি অ্যান্ড অবস প্রশিক্ষণের এক অতুলনীয় আতুরঘর। সেখানে চান্স পেয়ে প্রশিক্ষণ ও অধ্যয়নের সুযোগ সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতোই। আমি এমবিবিএস শেষ করেছি বরিশালের শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে। এসবিএমসির অষ্টাদশ প্রজন্মের শিক্ষার্থী আমি। গাইনি বিষয়ের প্রতি অদম্য ইচ্ছা থেকেই এই ডিসিপ্লিনে বিশেষজ্ঞ হবার ইচ্ছে ছিলো। সে সময় গাইনি বিভাগে আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ডা. শাহ আলম স্যার।

যাই হোক, সুযোগ মিলল ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডিপ্লোমা কোর্সে অধ্যয়নের। শিক্ষক হিসেবে পেলাম প্রফেসর টি এ চৌধুরী স্যারকে। তখন অবশ্য এফসিপিএস, ডিজিও, এমএস সবার ক্লাসই একসাথে হতো। মজা হলো, স্যারের ক্লাস করার জন্য লাইন লেগে যেত। ঢাকা মেডিকেল কলেজের লেকচার গ্যালারিতে বসার জায়গা পাওয়াই কষ্টকর হতো।

অথচ এই মানুষটিকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিটনেস পরীক্ষায় আনফিট ঘোষণা করা হয়েছিল।

 আমার মনে আছে, প্রথম ক্লাসেই স্যারকে দেখে মনে হয়েছিলো, উনি গোটা মানুষটাই একটা ‘কম্পিউটার’। গাইনি বিষয়ের সকল কিছু কম্পিউটারের মতোই ওনার নখদর্পনে! কোনও রকম বিরতি ছাড়াই উনি এক একটি টপিক পড়িয়ে যেতেন। কখনও ওনাকে বই বা নোট খুলতে দেখিনি।

অথচ এই মানুষটিকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিটনেস পরীক্ষায় আনফিট ঘোষণা করা হয়েছিল।

পরীক্ষায় তার হৃদযন্ত্রে এক জন্মগত ত্রুটির জন্য তাকে আনফিট ঘোষণা করে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এই বোর্ডে কোনও বিশেষজ্ঞ ছিলেন না।

পরে শুনেছি, তার নাকি জেদ চেপে যায়। কলেজের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি।

আপিলের কারণে একজন হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া হলো। যিনি রায় দিলেন টি এ চৌধুরীর পক্ষে। ভর্তি হলেন তিনি। ১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকেই এমবিবিএস পাস করলেন অসামান্য রেজাল্ট করে; স্যার পেলেন স্বর্ণপদক। এরপর তো একে একে সাফল্যের মুকুটে যোগ হতে থাকে পালক।

দেশের বাইরে লেখাপড়া শেষ করে তিনি ফেরেন দেশে। যোগ দেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বদলি হলেন ১৯৭১ সালে। সেখানেই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলেন।

স্বাধীনতার পরপর ঢাকার শাহবাগ হোটেলকে চিকিৎসাশিক্ষার উচ্চতর প্রতিষ্ঠান আইপিজিএমআরে (ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল রিসার্চ) পরিণত করা হলো। জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কারিগর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এত অল্পসংখ্যক চিকিৎসককে উন্নত প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে বিপুল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে না। তার চেয়ে দেশেই উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আইপিজিএমআরে যোগ দেওয়ার জন্য টি এ চৌধুরীকে ডেকে পাঠালেন তিনি। কিন্তু এখানেও শুরু হলো নানা চক্রান্ত। শেষ পর্যন্ত সব বাধা সরিয়ে টি এ চৌধুরী আইপিজিএমআরে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগে যোগ দিলেন।

মানুষ হিসেবে মোটেই কোন অহংকার ছিলো না স্যারের। অমায়িক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কথা বলতেন খুব নরম সুরে। আমি কখনো দেখিনি উনি কারো সাথে উঁচু স্বরে কথা বলেছেন। আর কথাও বলতেন বেশ সুন্দর করে। ওনার ধীর-স্থির মানবীয় প্রকৃতি ওনাকে শিক্ষকদের মধ্যে সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিলো।

পরবর্তী ২০ বছর এখানেই নবীন ও তরুণ সব গাইনি চিকিৎসককে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকতায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন তিনি। ক্লাসে কখনোই রোলকল করতেন না। কারণ, তিনি জানতেন যে তার ক্লাসে কেউ অনুপস্থিত থাকে না। এমনকি তার যেদিন পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের ক্লাস থাকত, সেদিন ঢাকার বাইরে থেকে শিক্ষার্থীরা ভোরে ক্লাস করতে চলে আসত। গতানুগতিকতার বাইরে পড়াতে পছন্দ করতেন। এ দেশে স্ত্রীরোগ বিষয়ে নতুন নতুন ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন তিনিই শুরু করেছিলেন। যেমন ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি, মাইক্রোসার্জারি, গাইনি অনকোলজি, ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার পথিকৃৎ তিনি। এখন প্রসূতি বিষয় বহুধাবিভক্ত হয়েছে, নানা বিশেষায়িত বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর ডিগ্রি চালু হয়েছে। এ দেশের নারীরা নানা আধুনিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। ভুলে গেলে চলবে না, এর শুরুটা তাদের মতো মানুষদের হাতেই।

সেই থেকেই স্যার আমাদের মতো অসংখ্য শিক্ষকেরও শিক্ষক।

অথচ মানুষ হিসেবে মোটেই কোন অহংকার ছিলো না স্যারের। অমায়িক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কথা বলতেন খুব নরম সুরে। আমি কখনো দেখিনি উনি কারো সাথে উঁচু স্বরে কথা বলেছেন। আর কথাও বলতেন বেশ সুন্দর করে। ওনার ধীর-স্থির মানবীয় প্রকৃতি ওনাকে শিক্ষকদের মধ্যে সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিলো।

লন্ডন থেকে ফেরার এক বছর পর ১৯৬৬ সালে টি এ চৌধুরীর বিয়ে হয় ফরিদা খাতুনের সঙ্গে। ফরিদা খাতুন ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা তার জুনিয়র চিকিৎসক। চাকরি করতেন প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগে। তারপর মিটফোর্ড হাসপাতালে কাজ করার সময় ভাবলেন, নিজে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। চাকরি ছেড়ে শান্তিনগরে গড়ে তুললেন দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ক্লিনিক। নিজের নামেই ক্লিনিকের নাম—ফরিদা ক্লিনিক।

ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত নারীরা স্বল্প ব্যয়ে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে গাইনিবিষয়ক সেবার জন্য আসতে শুরু করলেন এই ক্লিনিকে। স্বামী-স্ত্রী দুজন বসতেন ক্লিনিকে—রোগী দেখতেন, অপারেশন বা ডেলিভারি করতেন। ক্লিনিকের নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

ষাটের দশকের শেষে ঢাকায় স্ত্রীরোগবিষয়ক এ রকম ক্লিনিক বা বেসরকারি হাসপাতাল হাতে গোনা ছিল। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই ক্লিনিকেই কাজ করছেন দুজন।

পেশাগত জীবনে স্যারের সাথে আমার আবার দেখা হয় ২০১৫ সালে। সেবার নেপালে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে এক দল গাইনি বিশেষজ্ঞের সাথে স্যারও গিয়েছিলেন সেখানে। সেখানে স্যারের সাহচর্যে বেশ কিছুক্ষণ সময় আমরা ছিলাম। স্যার তার স্বভাবসুলভ নরম সুরে অনেক গল্প করলেন আমাদের সাথে। আমার মেয়ে ডা. নিশাকে আদর করলেন অনেক। আমাদের সাথে ছবিও তুললেন।

স্যারকে নিয়ে গাইনি বিভাগের চিকিৎসকদের স্মৃতি বলে হয়তো শেষ করা যাবে না। সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ ছিলেন তিনি। গবেষণা, চিকিৎসা ও শিক্ষকতায় অসামান্য নৈপুণ্য ছিলো তার। স্যারের হাতে গড়া অনেক শিক্ষককে আমরা পেয়েছি যারা বাংলাদেশকে আরও অনেক দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন। স্যার ছিলেন ‘টিচার অব দ্যা টিচারস’, আমাদের শিক্ষকদের শিক্ষক। তিনি এমন শিক্ষক ছিলেন যে, তার ক্লাস করার জন্য আমরা ব্যাকুল হয়ে থাকতাম।

স্যার চলে গেলেন। বাংলাদেশ এর বুক থেকে একটি কালজয়ী অধ্যায় সমাপ্ত হলো। স্যারের এই চলে যাওয়া অপূরণীয়। কিন্তু স্যার তার পুরো জীবন ধরে যে কাজ করে রেখে গেছেন, বাংলাদেশের লক্ষ কোটি মা-বোন-নারী তার উপকার পাবেন। এভাবেই স্যার অমর হয়ে রইবেন আমাদের মাঝে।

আর অনেক কিছুই লিখতে ইছে করছে, লিখতে পারছি না।

চিকিৎসা জগতের এক মহীরুহের জীবনাবসান! একটি নক্ষত্রের মৃত্যু, একজন কিংবদন্তির বিদায়।

পরম শ্রদ্ধেয় আমাদের শিক্ষকদের শিক্ষক। ওপারে ভালো থাকবেন স্যার।

স্যার, আপনার প্রতি অসামান্য কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনার পরলোকগত আত্নার শান্তি কামনা করি। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।

লেখক : সিনিয়র কনসালটেন্ট ( স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ), ভিজিটিং কনসালটেন্ট, সাউদার্ন জেনারেল হাসপাতাল, ফরিদপুর

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত