ডাকসুতে ৩১ হাজার ভোট গুনতে সময় লেগেছিল ১৮ ঘণ্টা; জাকসুতে ৮ হাজার ভোট গোনা সেই সময়েও শেষ হয়নি। অবশ্য ডাকসুতে ভোট গোনা হয়েছিল যন্ত্রে, আর জাকসুতে হাতেই চলছে গণনা।
অব্যবস্খাপনা, অভিযোগ আর বর্জনের মধ্যে বৃহস্পতিবার জাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর গণনা চলার মধ্যেই শুক্রবার সকালে আকস্মিক অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন এক শিক্ষক।
গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং হল ছাত্র সংসদের নির্বাচন চলার মধ্যে অসুস্থ হয়ে এক সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছিল।
ডাকসুতে মোট ভোট ছিল ৩৯ হাজার। তার মধ্যে ৮০ শতাংশের মতো ভোট গ্রহণ হয়েছিল। সেই হিসাবে ভোট দিয়েছিল ৩১ হাজার শিক্ষার্থী।
তার দুদিন পর বৃহস্পতিবার ঢাকার সাভারে স্থাপিত আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরে ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়।
ভোটগ্রহণের শুরু থেকে অব্যবস্থাপনার নানা ত্রুটি বেরিয়ে আসতে থাকে। কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ দেরিতেও শুরু হয়। প্রার্থীদের নানা অভিযোগের মধ্যে ভোট গ্রহণ চলার পর একে একে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় ছাত্রদল, বাম সংগঠনগুলোসহ পাঁচটি প্যানেল।
ডাকসুতে জয়ী ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন বর্জনের এই মিছিলে যোগ দেয়নি। তবে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদেরও নানা অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে গণনার সময় রাতভর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ফটকগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি প্রশ্ন তৈরি করেছে শিক্ষার্থীদের মনে, যা নিয়ে তারা সোশাল মিডিয়ায় লিখছে।
৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত এবারের জাকসু নির্বাচনে ভোটার ছিল ১১ হাজার ৮৪৩ জন। তার মধ্যে ৬৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন ধারণা দিয়েছে। সেই হিসাবে গণনা করতে হচ্ছে ৮ হাজার ৫৩ ভোট।
ডাকসুর মতো ওএমআর মেশিনে জাকসুর ভোটও গণনার প্রস্তুতি ছিল জাহাঙ্গীরনগর কর্তৃপক্ষের। কিন্তু জামায়াত নেতার কোম্পানি থেকে ওই যন্ত্র আনার খবরে সমালোচনা ওঠায় ব্যালট পেপার হাতে গণনার সিদ্ধান্ত হয়। তাছাড়া কিছু ক্ষেত্রে সব প্রার্থীর নাম ব্যালটে না ওঠায় হাতে লিখেও ‘টিক’ দিতে হয়েছে ভোটারদের। ফলে সেগুলোও মেশিনে গণনা সম্ভবপর ছিল না।
২১টি হলে ভোটগ্রহণ শুক্রবারা বিকাল ৫টায় শেষ হওয়ার পর সব ব্যালট বাক্স সিনেট ভবনে নেওয়া হয়। তারপর রাত ১০টার দিকে শুরু হয় গণনা। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টায়ও গণনা চলছিল।
জাকসু নির্বাচনের নির্বাচনী কর্মকর্তা অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা সকালে জানিয়েছিলেন, হল সংসদের ভোট গণনা হচ্ছে, তারপর কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণনা শুরু হবে।
সকাল ৯টায় তিনি একথা বলার সময় আটটি হল সংসদের ভোট গণনা শেষ হয়েছিল। সোয়া ১২টা পর্যন্ত ১৭টি হলের ভোট গণনা শেষ হয়। বাকি চারটি হলের গণনার কাজ তখনও চলছিল।
ভোট গণনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারা ধারণা দিয়েছেন, ব্যালট গণনা শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে রাত হয়ে যেতে পারে।
ভোট গণনাস্থল সিনেট ভবন ঘিরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। পুরো ক্যাম্পাসজুড়েই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মূল ফটকগুলোতে বিজিবি সদস্যদেরও দেখা গেছে।
শুক্রবার সকালে ভোট গণনার সময় সিনেট ভবনে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতা। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
৩১ বছর বছর বয়সী জান্নাতুল ফেরদৌস প্রীতিলতা হলে পোলিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বৃহস্পতিবার ওই হলে ভোটগ্রহণ শেষে বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন।
চারুকলা বিভাগের সভাপতি শামীম রেজা সাংবাদিকদের বলেন, সকাল ৮টার দিকে ভোট গণনার জন্য তিনি আবার সিনেট ভবনে আসেন। ভোট গণনা কক্ষের দরজার সামনে হঠাৎ পড়ে যান।
ভোট গণনা চললেও এই শিক্ষকের মৃত্যুতে ক্যাম্পাসে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
জাকসুতে ২৫টি পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী। হল ছাত্র সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৪৫ জন।
৭ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ অর্থাৎ জাকসুতে ২৫ পদের জন্য লড়াইয়ে রয়েছে ১৭৭ জন। তার মধ্যে ভিপি পদে ৯ জন এবং জিএস পদে ৮ জন প্রার্থী। হল সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ৪৪৫ জন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সাতটি প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে; এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছে অনেক।
ছাত্রদলের প্যানেলে ভিপি প্রার্থী করা হয়েছে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রদলের সভাপতি মো. শেখ সাদী হাসানকে। জিএস প্রার্থী হয়েছেন ১৩ নম্বর ছাত্রী হল ছাত্রদলের সভাপতি তানজিলা হোসাইন বৈশাখী। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে মো. সাজ্জাদুল ইসলাম এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে আঞ্জুমান আরা ইকরা ছাত্রদলের প্যানেলে লড়বেন।
ডাকসুতে ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলে জয়ী ইসলামী ছাত্রশিবির জাকসুতে লড়ছে ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলে। তাদের ভিপি প্রার্থী আরিফ উল্লাহ, জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে লড়বেন ফেরদৌস আল হাসান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে লড়বেন আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা।
অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল এনসিপির ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল, জিএস প্রার্থী আবু তৌহিদ মো. সিয়াম। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে জিয়া উদ্দিন আয়ান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে মালিহা নামলাহ লড়ছেন।
ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতি সংগঠন মিলে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেল ঘোষণা করে। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায় থাকলেও তিনি লড়াই থেকে বাদ পড়ায় এখন জিএস প্রার্থী থাকছেন জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি শরণ এহসান।
১১ জন নারী, ৭ জন আদিবাসী, ৬ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী, ৩ জন বৌদ্ধ ও ২ জন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীকে নিয়ে সাজানো এই প্যানেলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে প্রার্থী নুর এ তামীম স্রোত এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে প্রার্থী ফারিয়া জামান নিকি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী জিতুর সঙ্গে জিএস প্রার্থী রয়েছেন শাকিল আলী। এই প্যানেলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে প্রার্থী রয়েছেন তৌহিদুল ইসলাম নিবির ভূঁঞা।
ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ নামে একটি আংশিক প্যানেল দিয়েছে। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী নেই, জিএস পদে লড়ছেন জাহিদুল ইসলাম ইমন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে প্রার্থী হয়েছেন সোহাগী সামিয়া জান্নাতুল ফেরদৌস।
জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশের মুখপাত্র মাহফুজ ইসলাম মেঘের নেতৃত্বে আট সদস্যের ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ নামে আরেকটি আংশিক প্যানেল ভোটের লড়াইয়ে রয়েছে। মাহফুজ এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী, জিএস প্রার্থী তানবীর হোসেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে এই প্যানেলের প্রার্থী নাজমুল ইসলাম।