গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন চলছে। এই ঘটনা ফিলিস্তিনিদের জন্য একদিকে স্বস্তির, অন্যদিকে অস্বস্তিকর।
কারণ ফিলিস্তিনের মিত্র হিসেবে পরিচিত আরব দেশগুলোতে কিন্তু এমন কোনও আন্দোলন দেখা যাচ্ছে না। এনিয়ে ফিলিস্তিনিদের অনেকের মনেই অসন্তোষ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই আন্দোলন চলছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ ইসরায়েলপন্থী ও পুলিশকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কখনও কখনও এটা সংঘাত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
এদিকে আরব দেশগুলোতে কিছু প্রতিবাদ হলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের মতো অত বড় ও তীব্র ছিল না।
গাজার সর্বদক্ষিণের ছোট শহর রাফায় আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনি নাগরিক আহমেদ রেজিক। শহরটিতে গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে ১২ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছে।
রয়টার্সকে রেজিক বলেন, “আমরা প্রতিদিন সোশাল মিডিয়ায় বিক্ষোভের খবরাখবর নেই। এই ঘটনায় একই সঙ্গে আমরা প্রশংসা করি, আবার কষ্টও পাই। আমাদের কষ্ট হয়, কারণ আরব ও মুসলিম দেশগুলোতে এমন বিক্ষোভ হচ্ছে না।
“গাজার প্রতি সংহতি জানানো শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছেছে। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ।”
গাজা প্রশ্নে আরব দেশগুলো কেন নীরব, এর কারণ দেশগুলোর স্বৈরাচারী সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা। কারণ অনেক দেশই ইরান বিরোধীতার কারণে হামাসকে সমর্থন করতে চায় না। কারণ হামাস শুরু থেকেই ইরানের সমর্থন পেয়ে আসছে। আরব দেশগুলো মনে করে, তাদের দেশে গাজার প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ হলে তা হবে নিজেদের রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার বা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। তবে রাষ্ট্রীয় অনুমতি ছাড়া প্রতিবাদ করা আরব নাগরিকদের আরও কঠোর পরিণতি ভোগের শঙ্কার রয়েছে।
ইসরায়েলকে সমরাস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য দেশটির শিক্ষার্থীরা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনবিরোধী আন্দোলন করছে না। তারা প্রশাসনকে বলছে, ইসরায়েলকে অস্ত্র না দিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়।
অন্যদিকে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলে কূটনৈতিক সম্পর্কে কিন্তু কোনও ছেদ পড়েনি গাজার ঘটনায়। এমনকি ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র দেওয়া নিয়েও মুখ খোলেনি দেশগুলো।
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন প্রশ্নে মরক্কো ও ইরাক শুরু থেকেই সমালোচকের ভূমিকায়। দেশ দুইটি গাজার বাসিন্দাদের প্রতি সংহতিও জানিয়েছে। এছাড়া রোজার মাসটিও তারা অনাড়ম্বরভাবে কাটিয়েছে। কিন্তু যতটা করলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আওয়াজ তোলা যায়, দেশ দুইটি তা করছে না।
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা অবশ্য ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সানায় র্যালি করেছে। এমনকি তারা লোহিত সাগরে ইসরায়েল ও এর মিত্রদের জাহাজকে লক্ষ্যবস্তুও করেছে।
অন্য আরব দেশগুলোর বাসিন্দারা সোশাল মিডিয়ায় গাজার বাসিন্দাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে পোস্ট দিচ্ছে। তবে তারা রাস্তায় নামছে না।
এমন বাস্তবতার মধ্যে গাজার অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভ ও আরব দেশগুলোর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে একটি তুলনামূলক চিত্র তৈরির চেষ্টা করছেন।
উত্তর গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত সুহা আল কাফারনা বলেন, “আমি আরব শিক্ষার্থীদের আমেরিকার শিক্ষার্থীদের মতো বিক্ষোভ করতে বলি। তাদের উচিত আমেরিকানদের চেয়েও আমাদের জন্য বেশি কিছু করা।”
১৯৭৯ সাল থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে মিশর। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি তার দেশে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছে। কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ হলে তা পরবর্তীতে কায়রোর সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।
গত অক্টোবরের শুরুতে কায়রোতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার অনুমতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু দেখা যায়, সমাবেশে কয়েকজন বিক্ষোভকারী সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করে। এরপর তাদের গ্রেপ্তার ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে সরকার।
ইজিপশিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফর পার্সোনাল রাইটসের প্রধান হোস্সাম বাহগাত বলেন, “মিশরের রাস্তায় বড় ধরণের যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ ও জনমতের নিস্তব্ধতা পর্যবেক্ষণের সময় শুধু এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা ভুল হবে। এই নিরাপত্তাহীনতাকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত। সেখানে সব ধরনের জনসমাবেশ ও প্রতিবাদ নিষিদ্ধ।”
কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা কিছু বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু ওই শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন অ্যাক্টিভিস্ট নাম প্রকাশ না করে জানান, বিক্ষোভ করায় তাদের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।
তার মতে, “মিশরে গ্রেপ্তার হওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার হওয়া এক বিষয় নয়। সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে ভয়ে মানুষ রাস্তায় নামে না।”
লেবাননে বছরের পর বছর ধরে চলা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কারণে সেখানকার তরুণদের মধ্যে ক্যারিয়ার সংক্রান্ত ভাবনা অনেক বেশি সচল। এজন্য দেশটির প্রশাসন গাজাকে সমর্থন দিলেও তরুণরা রাস্তায় নামছে না।
তবে রয়টার্সকে লেবাননের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা বিক্ষোভ করতে ভয় পান। কারণ এতে তাদের উপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
লেবাননের কিছু মানুষ ১৯৭৫-৯০ সালের গৃহযুদ্ধের জন্য ফিলিস্তিনিদের দায়ি করেন। আবার অনেকে মনে করেন, তারা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভ করলে এর ফল ভোগ করবে ইরানপন্থী হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী।
বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মাকরাম রাবাহ বলেন, “কলাম্বিয়া বা ব্রাউন ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না আরব বিশ্ব। কারণ এমন বিক্ষোভ করার বিলাসিতা তাদের নেই। ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে বিক্ষোভ কতটা ফলদায়ক হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে আরবদের মনে।”
তিনি আরও বলেন, “ক্ষমতার গতিবিধি ও জনমত গঠনের ক্ষেত্রে আরব বিশ্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো বেশ কিছু ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে।”
তথ্যসূত্র : রয়টার্স।