Beta
রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

‘মঙ্গল’ নির্বাসনে, বৈশাখে এবার ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’

২০২৪ সালের মঙ্গল শোভাযাত্রা, যার স্লোগান ছিল- ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’।
২০২৪ সালের মঙ্গল শোভাযাত্রা, যার স্লোগান ছিল- ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’।
[publishpress_authors_box]

তিন যুগ ধরে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির বর্ষবরণের অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছিল, রাজনৈতিক পালাবদলের পর তার নাম গেল বদলে।

এবার পহেলা বৈশাখে যে শোভাযাত্রা বের হবে, তার নাম ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ঠিক হওয়ার কথা জানানো হয়েছে শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে এক সংবাদ সম্মেলনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনেই পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন হয়ে আসছে। ১৯৮৯ সাল থেকে চলে আসা এই শোভাযাত্রা ২০১৬ সালে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান, বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উদযাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সদস্যসচিব ও চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ, শোভাযাত্রার উপকমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক এ এ এম কাওসার হাসান, প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছরের শোভাযাত্রা হবে বড়, বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ। শোভাযাত্রায় বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন জাতিসত্তার অংশগ্রহণ থাকবে।

বাংলা বছরের প্রথম দিনকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত সময় কাটছে সেখানে। ছবি : হারুন-অর-রশীদ
বৈশাখের শোভাযাত্রার জন্য এবারও চারুকলার শিক্ষার্থীরা বানাচ্ছেন বিভিন্ন রকম মুখোশ। ছবি : হারুন-অর-রশীদ

গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নাম পরিবর্তনের যে হিড়িক চলছে, তাতে এখন যুক্ত হলো পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রার নাম।

জুলাই অভ্যুত্থানে যুক্ত অনেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিবাদী শাসন’ জারি রাখার হাতিয়ার হিসাবে দেখে আসছে। তাই তারা এই নাম বদলের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আসছিল।

অধ্যাপক নিয়াজ বলেন, “এই শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্যে দুটো মেসেজ আছে। একটি হচ্ছে, একটি নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান। রাজনৈতিক ও সামাজিক নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, সেই বিষয়টি তুলে ধরা। কিছু মোটিফ সেই কাজটি করছে। আর দ্বিতীয় যে অংশটি আছে, সেটি হচ্ছে মূলত ঐক্যের ডাক, সম্প্রীতির ডাক।”

এক দশক আগে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউনেস্কো এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিল।

ইউনেস্কো কমিটি বলেছিল, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মানুষের সাহস আর অশুভের বিরুদ্ধে গর্বিত লড়াই আর ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী রূপ।

ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণকেও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয় ইউনেস্কো কমিটি।

হেফাজতের আশা পূরণ

ইসলামি সংগঠনগুলো দীর্ঘ দিন ধরেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘হিন্দুয়ানি’ আখ্যা দিয়ে এর আয়োজনের বিরোধিতা করে আসছিল। তবে পালাবদলের পর আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে শোভাযাত্রার বিরোধিতা না করে এর নাম বদলের পক্ষে মত দেয়।

হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজেদুর রহমান সম্প্রতি এক বিবৃতিতে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ রাখার প্রস্তাব করেছিলেন। তাদের ইচ্ছাই পূরণ হলো।

বিবৃতিতে তারা বলেছিলেন, “পহেলা বৈশাখ উদযাপনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মাচারকে তথাকথিত ‘সর্বজনীনতা’র নামে সবার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে ফ্যাসিবাদী সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। মূলত আমাদের জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য থেকে মুসলিম সংস্কৃতি ও ভাবধারাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে এই সেক্যুলার সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কায়েম করা হয়েছে।”

২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে ইউনেস্কোর তালিকায় স্থান পাওয়ার পর মঙ্গল শোভযাত্রা জেলায় জেলায় আয়োজনের নির্দেশনা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের।

২০২৩ সালে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পহেলা বৈশাখ উদযাপন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ভিন্ন রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রোজার মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের পথ থেকে সরে এসেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।  

২০১৯ সালের মঙ্গল শোভাযাত্রা।
২০১৯ সালের মঙ্গল শোভাযাত্রা।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বরাবরের মতোই মঙ্গল শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল; পরের বছরও রোজার সময় ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’ স্লোগানে বেরিয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগকে ‘সেক্যুলার ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর’ আখ্যায়িত করে হেফজতের বিবৃতিতে বলা হয়, “১৯৮৯ সালের পহেলা বৈশাখে প্রথম পালিত আনন্দ শোভাযাত্রাকে পরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপ দেওয়াকে আমরা ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখি। ঢাবির চারুকলা সবসময় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করলেও পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৬ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কো পহেলা বৈশাখের বানোয়াট মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।”

ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পুনর্বিবেচনা ও ভুল সংশোধনের জন্য সংস্থাটিকে চিঠি দেওয়ার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান হেফাজত নেতারা।

শোভাযাত্রা থেকে ‘মঙ্গল’ শব্দ বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে হেফাজত নেতারা বলেন, “প্রাথমিক সমাধান হিসাবে মঙ্গল শব্দ পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখের আদি ও আসল আনন্দ শোভাযাত্রা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখতে পারে সরকার।”

শোভাযাত্রার উপাদান নিয়েও সরকারের উদ্দেশে হেফাজত নেতারা বলেন, “সেক্যুলারদের বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের বিভিন্ন দেবতা ও ধর্মীয় পশু-পাখির মূর্তি ও প্রতিকৃতিতে সয়লাব থাকে। অথচ সেক্যুলার হয়েও তাদের এতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু নানাভাবে ইসলামবিদ্বেষ প্রকাশে ঠিকই তারা তৎপর। হাজার বছরের সংস্কৃতির মিথ্যা দাবিতে তারা সবসময় মঙ্গল শোভাযাত্রার দালালি করেছে।

“জাতীয় উৎসব উদযাপনে যেকোনো ধরনের মূর্তিবাদী সংস্কৃতির আমরা বিরোধিতা করি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে জাতীয় কোনও উৎসবে ইসলামের তৌহিদি চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন কোনও চিহ্ন রাখা যাবে না।”

শোভাযাত্রা : আনন্দ থেকে যেভাবে মঙ্গল

মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে, তারা একে নিছক একটি আনন্দ আয়োজন হিসাবে দেখেন না। বরং একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবেই দেখেন।

গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করেছিল, বাঙালির আত্মপরিচয় মেলে ধরতে তখন রমনায় ছায়ানটের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠান।

ঠিক ওই সময় বৈশাখ নিয়েও একটি শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল। মঙ্গল শোভাযাত্রার ঠিকুজি তালাশ দিয়ে গত বছর সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছিলেন চারুকলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন।

ওই শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই সময়কার ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর জিএস মতিয়া চৌধুরী (বর্তমানে প্রয়াত)।

নিসার হোসেন বলেন, “৬০ দশকের মাঝামাঝি সময় মতিয়া চৌধুরী প্রথম একটি শোভাযাত্রা করে। সেখানেও শিল্পীদের আঁকা নানান ছবি ব্যানার নিয়ে শোভাযাত্রাটি হয়। শোভাযাত্রার মূল ব্যানারে লেখা ছিল- এসো হে বৈশাখ।”

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় শিল্পী জয়নুল আবেদিনও নববর্ষ উদযাপনে কর্মসূচি নিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

“গণঅভ্যুত্থানের সময় জয়নুল আবেদিন স্যার শিল্পীদের একত্রিত করছিলেন। সে সময় নবান্ন উৎসবসহ নানা ধরনের আয়োজন হচ্ছিল। তখন আমাদের শোনা, নববর্ষ পালনেও কর্মসূচি করা হয়েছিল।”

এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে গত শতকের ৮০ এর দশকে এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনামলে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রেরণা হিসাবে কাজ করে যশোরের এমনই এক আয়োজন।

১৯৮৫ সালে যশোরে চারুপীঠ নামের একটি সংগঠন এ ধরনের একটি শোভাযাত্রা শুরু করে পহেলা বৈশাখে। তার নাম ছিল বৈশাখী শোভাযাত্রা।

এরপর ১৯৮৮ সালের বন্যায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান ডুবে যায়। তখন চারুকলার শিক্ষার্থীরা কেরানীগঞ্জ এলাকার বন্যাদুর্গত মানুষদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিয়ে কাজ করে। সেই থেকে একসঙ্গে মিলে কাজ করার অনুপ্রেরণা এই শিক্ষার্থীরা পায়। সেই বছরই ২৯ ডিসেম্বর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন উপলক্ষে চারুকলার শিক্ষার্থীরা একটি শোভাযাত্রা করে।

১৯৮৯ সালে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে প্রথম শোভাযাত্রা বের হয়েছিল আনন্দ শোভাযাত্রা নামে।

এরপর ১৯৮৯ সালে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে বেরিয়েছিল শোভাযাত্রা। তার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। পরে তা মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম নেয়।

তখনকার তরুণ শিক্ষক নিসার বলেন, “তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছিল। তার বিপরীতে সব ধর্মের মানুষের জন্য বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারাই মূলত এই আয়োজনটি করেছিল। এই শোভাযাত্রা তখন থেকেই স্বৈরাচারবিরোধী এবং মৌলবাদবিরোধী।”

ওয়াহিদুল হক, শিল্পী ইমদাদ হোসেন, রফিকুন নবী ছায়ানটের আন্দোলনের কথা স্মরণ করে মঙ্গল শোভাযাত্রাকেও একটি রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তাদের কথায় উজ্জীবিত হয়েই মঙ্গল শোভাযাত্রার যাত্রা শুরু হয় বলে জানান অধ্যাপক নিসার।

আনন্দ শোভাযাত্রা নামে শুরু হয়ে কীভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম পেল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, নামটা মঙ্গল শোভাযাত্রাই দেওয়ার ইচ্ছা ছিল তাদের। কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে এর ভুল ব্যখ্যা হতে পারে, এই আশঙ্কায় আনুষ্ঠানিকভাবে নামটি দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে তা মঙ্গল শোভাযাত্রা নামেই পরিচিতি পায়।

সময়কে ধারণ করে স্লোগান

ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের মতো মঙ্গল শোভাযাত্রা যতবার বেরিয়েছে, প্রতিবারই একেকটি স্লোগান এসেছে সময়ের দাবি মিটিয়ে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি, কখনওবা বৈশ্বিক দৃশ্যপটও ধারণ করেছে সেই স্লোগান।

গত বছর বঙ্গাব্দ ১৪৩১ বরণে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল- ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। কবি জীবনানন্দ দাশের ‘তিমির হননের গান’ কবিতার পঙক্তি থেকে নেওয়া হয় প্রতিপাদ্যটি। তিমির মানে অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে বিনাশ যারা করবে বা করার ক্ষমতা যারা রাখে, তাদের উদ্দেশ করেই ছিল সেবারের আহ্বান।

তার আগের বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। অতীতের সব আবর্জনা দূর করে সত্য ও সুন্দরের পথে চলার আহ্বান জানানো হয় স্লোগানটিতে।

২০২২ সালে কোভিড মহামারির ধাক্কা সামলে উঠে অনেকটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেবারের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘নির্মল করো মঙ্গল করো মলিন মর্ম মুছায়ে’। মহামারিকালে যা কিছু স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ছন্দকে ব্যাহত ও মলিন করেছে, সেগুলো মুছে গিয়ে জীবন নির্মল ও মঙ্গলময় হয়ে উঠুক, এই আহ্বানই ধ্বনিত হয়েছিল সেই স্লোগানে।

২০২১ সালে কোভিড মহামারির কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন অতটা জমকালো হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত পরিসরে হয়েছিল মিছিল। সেবার প্রতিপাদ্য ছিল ‘কাল ভয়ংকরে বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর’। প্রতিপাদ্যেই বোঝা যাচ্ছে আগ্রাসী করোনাভাইরাসের সমাপ্তি সুন্দরের ভেতর দিয়ে হোক, সেই প্রার্থনাই করা হয়েছে।

কোভিড মহামারির কারণে ২০২০ সালে বর্ষবরণে কোনও আয়োজনই করা যায়নি। শুধু পোস্টার প্রকাশ করেছিল চারুকলা। সেবারের প্রতিপাদ্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ‘আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’। অনলাইনে প্রকাশ করা পোস্টারটিতে আরও লেখা ছিল আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই অমর বাণী- ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু মানুষ পরাজিত হয় না।’

যুদ্ধাপরাধী, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে প্রতিরোধের ডাক ২০১৩ সালে আসে মঙ্গল শোভাযাত্রায়।

২০১৯ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৈবেদ্য কবিতা থেকে নেওয়া ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’। ২০১৮ সালে শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ছিল লালনের পদ ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’।

২০১৭ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান ছিল ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। এর সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছিল একটা বড় সূর্যের প্রতিকৃতি। একই রকম ছোট ছোট অনেক সূর্য দেওয়া হয় শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের হাতে হাতে। সূর্যের পেছনের অংশে ছিল কালো রং।

২০১৬ সালে শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল রবীন্দ্রনাখ ঠাকুরের ‘অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে‘।  শিশু নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনার রেশ ধরেই প্রতিপাদ্যটি ঠিক করা হয়েছিল তখন।

ওই বছরেই ইউনেস্কো পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বসংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষণা করে।

২০১৫ সালে একাধিক সহিংস ঘটনার প্রভাব পড়েছিল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্যে। সেবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে’।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনটিকেই সেবার প্রতিপাদ্য করার প্রেক্ষাপট ছিল, উগ্রপন্থীদের হাতে লেখক অভিজিৎ রায় ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান খুন হওয়ার ঘটনা।

২০১৪ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল ‘উদ্যত কর, জাগ্রত কর, নির্ভয় কর হে’।

২০১৩ সালের বর্ষবরণে এসেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিক্রিয়া দেখানো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধের ডাক। মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান ছিল- ‘রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ অনিঃশেষ’।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত