“বাতাসে তোর সুর ছিল না, ছিল তাপে ভরা/ পিপাসাতে বুক-ফাটা তোর শুষ্ক কঠিন ধরা”- বৈশাখকে রবিঠাকুর দেখেছিলেন এভাবে। শুধু তিনিই নয়, বাংলার বহু কবি বৈশাখকে নিজ নিজ মনন থেকে চিত্রিত করেছেন নানান শব্দে, বয়ানে।
চৈত্রের খরতাপ শেষে প্রতি বছর বৈশাখের প্রথম দিন বাঙালি বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে ব্যাপক সমারোহে। নানা আনন্দ আয়োজন আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।
আবহমান কাল ধরে বাঙালির জীবনে বৈশাখ নব আনন্দে জাগার বারতা নিয়ে এলেও এর সামাজিক উদযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই ভূখণ্ডের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস।
বাঙালির আত্মপরিচয়ের শেকড় অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় গত শতকের ষাটের দশকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সংগ্রামের অস্ত্র।
তৎকালীন পাকিস্তানে আইয়ুব খান সরকারের আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদে ১৯৬৫ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে রমনার বটমূলে সেই যে বর্ষবরণের আয়োজন শুরু হয়েছিল, তা এখন নগরে বৈশাখী উৎসবের প্রাণকেন্দ্র হয়ে রয়েছে।
এর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাও এখন নগরে বর্ষবরণের অন্যতম অনুসঙ্গ। এর শুরুটাও হয়েছিল রাজনৈতিক সংগ্রামকে ধারণ করে।
দেশে এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলনের মধ্যে ১৯৮৯ সালে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল।
তারপর সময় যত গড়িয়েছে, ছায়ানটের অনুষ্ঠান যতবার হয়েছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা যতবার বেরিয়েছে, প্রতিবারই একেকটি স্লোগান এসেছে সময়ের দাবি মিটিয়ে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি, কখনওবা বৈশ্বিক দৃশ্যপটও ধারণ করেছে এই দুই আয়োজনের স্লোগান।
গত এক দশকে চারুকলা ও ছায়ানট তাদের বর্ষবরণ উৎসবে যেসব প্রতিপাদ্য বা স্লোগান ব্যবহার করেছে, তা বিশ্লেষণ করলে না বলা অনেক কথা জানা যায়। কবি যেমন তার অব্যক্ত কথা শব্দের অন্তরালে বলে যান, তেমনি এসব স্লোগানেও থাকে সেই অব্যক্ত বয়ান।
এবার বঙ্গাব্দ ১৪৩১ বরণে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে- ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। কবি জীবনানন্দ দাশের ‘তিমির হননের গান’ কবিতার পঙক্তি থেকে নেওয়া হয়েছে প্রতিপাদ্যটি। তিমির মানে অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে বিনাশ যারা করবে বা করার ক্ষমতা যারা রাখে, তাদের উদ্দেশ করেই এবারের আহ্বান।
অন্যদিকে ছায়ানটের এবারের বর্ষবরণের স্লোগান হলো – ‘দূর করো আত্মকেন্দ্রিকতা, আপনি জ্বালো এই তো আলো’। এর মধ্যদিয়ে ভোগবাদ নয়, স্বার্থপরতা নয়, মনুষ্যত্বকে কাছে পাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে অর্ধ শতক পেরিয়ে আসা সংগঠনটি।
গত বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। আর ছায়ানটের স্লোগান ছিল ‘ধর নির্ভয় গান’। অতীতের সব আবর্জনা দূর করে সত্য ও সুন্দরের পথে চলার আহ্বান জানানো হয় স্লোগানটিতে।
২০২২ সালে কোভিড মহামারির ধাক্কা সামলে উঠে অনেকটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেবারের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘নির্মল করো মঙ্গল করো মলিন মর্ম মুছায়ে’। মহামারিকালে যা কিছু স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ছন্দকে ব্যাহত ও মলিন করেছে, সেগুলো মুছে গিয়ে জীবন নির্মল ও মঙ্গলময় হয়ে উঠুক, এই আহ্বানই ধ্বনিত হয়েছিল সেই স্লোগানে। সেবছর ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নব আনন্দে জাগো’। তাও ছিল মহামারির দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আহ্বান।
২০২১ সালে কোভিড মহামারির কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন অতটা জমকালো হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত পরিসরে হয়েছিল মিছিল। সেবার প্রতিপাদ্য ছিল ‘কাল ভয়ংকরে বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর’। প্রতিপাদ্যেই বোঝা যাচ্ছে আগ্রাসী করোনাভাইরাসের সমাপ্তি সুন্দরের ভেতর দিয়ে হোক, সেই প্রার্থনাই করা হয়েছে। ওই বছর ছায়ানটের স্লোগানও ছিল ‘আলো আসবেই’।
কোভিড মহামারির কারণে ২০২০ সালে বর্ষবরণে কোনও আয়োজনই করা যায়নি। শুধু পোস্টার প্রকাশ করেছিল চারুকলা। সেবারের প্রতিপাদ্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ‘আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’। অনলাইনে প্রকাশ করা পোস্টারটিতে আরও লেখা ছিল আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই অমর বাণী- ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু মানুষ পরাজিত হয় না’।
আর মহামারিতে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনাবসান ও জীবনশঙ্কার লগ্নে ছায়ানট প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছিল ‘উৎসব নয়, সময় এখন দুর্যোগ প্রতিরোধের’। সেবার রমনার বটমূলে কোনও অনুষ্ঠান করেনি ছায়ানট। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ও ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে ঘরোয়া পরিসরে আয়োজিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়েছিল।
২০১৯ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৈবেদ্য কবিতা থেকে নেওয়া ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’। আর ছায়ানটের স্লোগান ছিল ‘অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ’। ওই বছর ফেনীর সোনাগাজীতে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে। এরপর দেশজুড়ে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। এই প্রতিবাদের ঢেউ লেগেছিল ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজনে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয় স্লোগানে।
২০১৮ সালে শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ধরা হয়েছিল লালনের পদ ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’ আর ছায়ানটের ছিল ‘বিশ্বায়নের বাস্তবতায় শিকড়ের সন্ধান’।
২০১৭ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান ছিল ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। এর সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছিল একটা বড় সূর্যের প্রতিকৃতি। একই রকম ছোট ছোট অনেক সূর্য দেওয়া হয় শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের হাতে হাতে। সূর্যের পেছনের অংশে ছিল কালো রং।
মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনে প্রতিবারই সম্পৃক্ত থাকা চারুকলার অধ্যাপক নিসার হোসেনের ভাষ্যে, পেছনের কালো রংটা দিয়ে জঙ্গিবাদকে বোঝানো হয়েছিল। জঙ্গিবাদ যে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চায়, তার থেকে আলোর দিকে মুখ ঘোরাতে বলাটাই ছিল সেবারের মূল আহ্বান।
আর ওই বছর ছায়ানটের স্লোগান ছিল ‘আনন্দ, বাঙালির আত্মপরিচয় সন্ধান ও মানবতা’।
২০১৬ সালে শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল রবীন্দ্রনাখ ঠাকুরের ‘অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে…’। শিশু নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনার রেশ ধরেই প্রতিপাদ্যটি ঠিক করা হয়েছিল তখন। ওই বছরেই ইউনেস্কো পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বসংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষণা করে।
সেবার ছায়ানটের বর্ষবরণের স্লোগান ছিল ‘মানবতা’। তখন ছায়ানটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও শুভচেতনা, মানবিকতাবোধ আর কল্যাণ মানসিকতার চরম অবমাননা ও বিনাশের চিত্র সর্বত্র। হিংসা, হানাহানি আর নারী নির্যাতন হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের ঘটনা। এমনই পরিস্থিতিতে নতুন বছর আসছে বাঙালি জাতির নতুন করে জেগে ওঠার তাগিদ নিয়ে।
২০১৫ সালে একাধিক সহিংস ঘটনার প্রভাব পড়েছিল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্যে। সেবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে’। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনটিকেই সেবার প্রতিপাদ্য করার প্রেক্ষাপট ছিল, উগ্রপন্থীদের হাতে লেখক অভিজিৎ রায় ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান খুন হওয়ার ঘটনা।
সেবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রধান প্রতীকটি ছিল প্রায় ২০ ফুট লম্বা মুষ্টিবদ্ধ হাত, যার আঙুলে রয়েছে লাল রং। আর এই বিশাল হাত গলা টিপে ধরেছে সাধারণ মানুষের কণ্ঠকে।
আর ছায়ানটও একই কারণে স্লোগান দিয়েছিল ‘শান্তি মানবতা ও মানুষের অধিকার’।
২০১৪ সালে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল ‘উদ্যত কর, জাগ্রত কর, নির্ভয় কর হে’। শিল্পী অধ্যাপক আবুল বারক্ আলভী বলেছিলেন, সারাবিশ্বের মানুষের কাছে বাঙালি জাতির ঐতিহ্য তুলে ধরা হলো আমাদের মূল লক্ষ্য। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের শত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শোভাযাত্রাটা মূলত তাকে স্মরণ করেই করা হয়।
আর ছায়ানট দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্লোগান ঠিক করেছিল, ‘সম্প্রীতি ও স্বদেশ।’
২০১৩ সালের বর্ষবরণের স্লোগানে এসেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রতিক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধের ডাক। ছায়ানটের অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ছিল অনেক সরাসরি- ‘এই বৈশাখের অঙ্গীকার, রুখে দেব রাজাকার’। মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগানও ছিল- ‘রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ অনিঃশেষ’।