Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

‘যেটি ছায়া পাচ্চি, সেটিই বসে পড়িচ্চি’

দপ্ত দুপুরে কোথায় একটু ছায়া দেখলেই বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
দপ্ত দুপুরে কোথায় একটু ছায়া দেখলেই বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of সাজ্জাদ হোসেন

সাজ্জাদ হোসেন

যথারীতি এবারও কাঠফাটা রোদ, তীব্র গরম আর হুটহাট কালবৈশাখী নিয়ে এসেছে বৈশাখ। গত দুদিনের আবহাওয়া এমন যে দিনের শুরুটা হয় ভ্যাপসা গরম দিয়ে। মনে হয় গাছের পাতারাও বুঝি নড়াচড়া করতে ভুলে গিয়েছে।

বিকাল গড়াতেই আকাশ কালো হতে শুরু করে, হু হু করে বয় বাতাস, শুরু হয় ঝড় আর অবধারিতভাবে তারপর নামে বৃষ্টি।

তবে দিনের প্রথম ভাগে গরমের মাত্রা এত তীব্র থাকে যে, সেসময় বাড়ির বাইরে বের হওয়ায় দায় হয়ে পড়ে।

কিন্তু জীবিকার জন্য যাদের পথে নামতে হয়, রোদ-বৃষ্টি কোনোকিছুই তাদের বাধা হতে পারে না।

দুপুরে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেওয়ার সময় কথা হলো রিকশাচালক মো. কোব্বাতের সঙ্গে।

তিনি বললেন, “রোদ থাক আর বৃষ্টি, হামার কিছু আসপে যাবে না। হামাক রিকশা চালানিই লাগবে। কিন্তু আইজকা যে রোদ রিশকা টানাই যাচ্চে না। একটা ভাড়া মারার পর শরীল আর চলে না। যেটি (যেখানে) ছায়া পাচ্চি সেটিই (সেখানেই) বসে পড়িচ্চি।”

কোব্বাতের বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলায়। থাকেন ঢাকার ৬০ ফিট ভাঙাব্রিজ এলাকার একটি রিকশার গ্যারেজে।

সকাল ৭টায় রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন জানিয়ে বলেন, “দুপুর ২টা পর্যন্ত মাত্র ৪৫০ টাকার ভাড়া মারছি। গরমে ঠিকমতো রিকশাও চালাইতে পারিচ্চি না, যাত্রীও বেশি নাই।”

গরমের তীব্রতার মধ্যে একটু সুস্থ থাকতে রিকশাচালকদের পান করতে হচ্ছে পানি বা স্যালাইন। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
গরমের তীব্রতার মধ্যে একটু সুস্থ থাকতে রিকশাচালকদের পান করতে হচ্ছে পানি বা স্যালাইন। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

পাশেই বসে স্যালাইন পান করছিলেন আরেক রিকশাচালক ফোরকান মিয়া। তিনি অনেকটা স্বগতোক্তির ভঙ্গিতেই বললেন, “গরমে জীবনডা শ্যাষ। রিকশা চালানোর সময় জ্যামে পড়লে পিঠে যেন আগুনের ছ্যাঁকা লাগে। রিকশায় ১০ টাকার ভাড়া মারলে ২০ টাকার পানি-স্যালাইন খাওয়া লাগতেছে।”

কেবল রিকশাচালকরাই নন, তীব্র গরমে ঢাকার প্রায় সব মানুষেরই জীবন অতিষ্ঠ। যদিও সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন কোব্বাত বা ফোরকানের মতো খেটে খাওয়া মানুষ।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে দেশের রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু জায়গায় বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। দ্রুতই এই তাপ প্রবাহের তেমন কোনও পরিবর্তন হবে না। বরং ২০ এপ্রিলের পর আরও বাড়তে পারে গরমের তীব্রতা।

গরমের কারণে সিগন্যালে বাদামের বিক্রি কমেছে বলে জানালেন মো. হালিম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের বাসিন্দা হালিম পরিবার নিয়ে থাকেন আগারগাঁওয়ের বিএনপি বাজারে।

সিগন্যালে ঘুরে বাদাম বিক্রি করেই সংসার চালান তিনি। দুপুরে ফুটপাতের পাশের একটি গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করছিলেন।

বললেন, “এমনিতে ছুটির কারণে ঢাকায় মানুষজন কম। তার ওপর তীব্র গরমের কারণে কয়েকদিন ধরে বেচাবিক্রি কমে গেছে। সকাল থেকে ২০০ টাকারও বাদাম বিক্রি করতে পারিনি। এভাবে চললে না খেয়ে থাকা লাগবে।”

মোহাম্মাদপুরে ফুটপাতের পাশে চা বিক্রি করেন পঞ্চাশোর্ধ বয়সী রুবিনা বেগম। মাথার ওপরে টেবিল ফ্যান ঘুরলেও দরদর করে ঘামছিলেন তিনি।

রুবিনা বলেন, “যে রোদ পড়ছে তাতে দোকানের ছাউনির তেরপল (ত্রিপল) আগুনের মতো গরম হয়া যাইতেছে। তাই ফ্যানের বাতাসেও গরম কমতেছে না। আর এই গরমে চা বেচাও কইমা গেছে।” 

দুপুরের প্রখর রোদে কল্যাণপুরে বরফ মেশানো আখের রসে গলা ভেজাতে দেখা গেল অটোরিকশাচালক মুকুল হোসেনকে।

ঢাকায় এখনও মানুষ কম থাকায় যাত্রী পাচ্ছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, “গরমের কারণে অটোরিকশার মধ্যেও বসে থাকা যাচ্ছে না। ঘেমে শরীর ভিজে যাচ্ছে। এভাবে গরম পড়লে গরীব মানুষ বাঁচবো ক্যামনে! গরমের কারণে তাদেরতো আর ঘরে বসে থাকার উপায় নাই। ঘরে বসে থাকলে না খায়া মরতে হইবো, আর রাস্তায় বাইর হইলে রোদে জীবন শেষ।”

আখের রস বিক্রেতা সাহাবউদ্দীন জানালেন, গত চার বছর ধরে এটাই তার ব্যবসা। মূলত রিকশা ও অটোরিকশার চালকরাই তার প্রধান ক্রেতা।

তিনি বলেন, “অন্য সময় গরম পড়লে আমার বেচা-বিক্রি বাইড়া যায়। কিন্তু এখন একবারে কম। কারণ যারা আখের রস খায় তারাইতো সবাই ঢাকায় আসে নাই।”   

আখের রসের মিষ্টি বাড়াতে বাড়তি চিনি বা স্যাকারিন জাতীয় কিছু মেশানো হয় কিনা জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বলেন, “এখনকার আখে কিছু মেশাইতে হয় না।  বর্ষাকালে যে আখগুলো পাওয়া যায় সেগুলো মিষ্টি কম হয়, সেজন্য অনেকে স্যাকারিন মেশায়। কিন্তু আমি কখনোই স্যাকারিন মিশাই না। আমার পানি আর বরফও ভালো। বরফ আনি ঢাকা উদ্যানের একটি কারখানা থেকে, আর পানি আশপাশের বাসাবাড়ি থেকে।”

গরমের কারণে বেড়েছে আখের রসের দোকানে ভীড়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
গরমের কারণে বেড়েছে আখের রসের দোকানে ভিড়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সাহাবউদ্দীনের মতো মহাখালীর আমতলী মোড়ে আখের রস বিক্রি করছিল ১২ বছরের কিশোর রাজীব। তার দোকানে ক্রেতাদের দীর্ঘ সারি ছিল। প্রতি গ্লাস রস ২০ টাকা করে বিক্রি করে সে।

জানাল, ক্রেতাদের বেশিরভাগই দূরপাল্লার বাসের যাত্রী। বাস থেকে নেমেই তারা ভিড় করেন রাজিবের দোকানে।

একটু তাড়াতাড়ি রস পেতে ঠেলাঠেলিও করতে দেখা গেল তাদের। গরমের কারণে রস বিক্রি বেশি হচ্ছে জানিয়ে রাজিব বলে, “গরম বেশি পড়ছে তো, তাই এমন ভিড় লাইগ্যা গেছে।”

এক গ্লাস ঠান্ডা আখের রসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. মফিজুল ইসলাম। সঙ্গে স্ত্রীসহ দুই শিশু সন্তান।

পেশায় পোশাক শ্রমিক মফিজুল বলেন, ঈদের ছুটি শেষে শেরপুরের নালিতাবাড়ী থেকে সকাল ৮ টায় বাসে উঠেছিলেন। ঢাকায় পৌঁছতেই আড়াইটা বেজে গেছে। তাদের যেতে হবে নারায়ণগেঞ্জ। অনেকক্ষণ বাসে থাকার কারণে সবারই গরমে কাহিল অবস্থা। নামার পরেও এমন রোদের মধ্যে পড়েছেন যে সন্তানদের একটু আরাম দিতে আখের রস কিনতে এসেছেন।

তীব্র গরমের কারণে শিশুদের নিয়ে ভ্রমণের ভোগান্তির কথাও বললেন তিনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত