Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

কলাম

‘ব্রিটিশ কবি ট্যাগোরের নোবেল প্রাইজ’

১৯১৩-তে প্রকাশিত হয় গীতাঞ্জলির ম্যাকমিলান সংস্করণ। বইটি রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেন রোদেনস্টাইনকে, উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লিখা ছিল ‘টু উইলিয়াম রোদেনস্টাইন’।

নোবেল প্রাইজ পাওয়ার টেকনিক
রবীন্দ্রনাথ এমনিতেই একটি সিরিয়াস বিষয়। সঙ্গে নোবেল পুরস্কার যুক্ত হওয়ায় সিরিয়াসনেস আরো বেড়েছে। কিন্তু রসিক রবীন্দ্রভক্তও তো রয়েছেন। ‘রবীন্দ্রনাথের পাগলা ফাইল’-এ এমন একজন ভক্তের একটি চিঠি রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছেন, পাননি অনেকেই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেমন করে পেলেন?

গুরুদেবকে লেখা সেই চিঠি:
‘‘সবিনয় নিবেদন আমার, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার টেকনিক অতি সত্বর জানান। তাহা হইলে আমি যদি প্রাইজ পাই মোট প্রাপ্য টাকার অধিকাংশ আপনাকে দিব।’’

রবীন্দ্রনাথ সাধারণত চিঠিপত্রের জবাব দিতেন এবং সেই জবাবের কপি রেখে দিতেন। কিন্তু এই পত্রলেখক নিশ্চয়ই কোনো জবাব পাননি। তাহলে তিনি কী ধরে নেবেন? রবীন্দ্রনাথ চাননি এদেশে আরো একজন নোবেল প্রাইজ বিজয়ী মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক। সে কারণেই প্রাইজমানির অধিকাংশ পেয়ে যাবার সম্ভাবনাকেও উপেক্ষা করেছেন!

রবীন্দ্রনাথের প্রকাশক ম্যাকমিলান সুইডিশ একাডেমির টেলিগ্রাম পেয়ে শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন। ক্ষিতিমোহন সেন, নেপাল রায় এবং কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডাকপিয়নের কাছ থেকে আগেভাগেই খবরটা পেয়ে যান। অধ্যাপকবৃন্দ এবং শিক্ষার্থীরা খবরটা পরে জানেন। রবীন্দ্রনাথ তখন ‘উত্তরায়ণ’-এ ধীরপদে বিচরণ করছেন।

অধ্যাপক ও শিক্ষার্থী সবাই ছুটেন কবির কাছে, তাদের সাথে ধীরগামী ক্ষিতিমোহন সেনও।

তাদের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠের সংবাদটি রবীন্দ্রনাথ শুনলেন। তারপর ক্ষিতিমোহন সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘ক্ষিতি যখন টলেছে, তখনই বুঝেছি একটা কিছু হয়েছে।’’

(ঠাকুরের প্রশংসনীয় রসবোধ দ্রষ্টব্য: ক্ষিতি মানে পৃথিবী)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ১৯১৩-তে প্রকাশিত গীতাঞ্জলির ম্যাকমিলান সংস্করণের প্রচ্ছদ।

একটি স্মরণীয় ডিনার
তৃতীয়বারের মতো বিদেশ সফরের জন্য রবীন্দ্রনাথ ২৭ মে ১৯১২ বোম্বাই বন্দর ছাড়েন। সঙ্গে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও এবং পুত্রবধু প্রতিমা দেবী। রবীন্দ্রনাথ ক’দিন ধরে নিজের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলেন। জাহাজে আরো কিছু কবিতার ইংরেজি করলেন। লন্ডনে পৌঁছলেন ১৬ জুন।

ঠাকুরের সম্মানে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি (দাদাভাই নওরোজি ১৮৬৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন) ১০ জুলাই ১৯১২ ট্রোকাডেরো রেস্তোরাঁয় একটি সম্বর্ধনা ও নৈশভোজের উদ্যোগ নেয়। পেছনে মূল সংগঠক হিসেবে কাজ করেন উইলিয়াম রোদেনস্টাইন। একটি মুদ্রিত লিফলেটও বিতরণ করা হয়। হার্ডড্রিঙ্ক বাদে প্রবেশমূল্য ধরা হয় ৫ শিলিং। হার্ডড্রিঙ্ক যার যার তার তার।

উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের (১৮৭২-১৯৪৫, ইহুদি বংশোদ্ভূত ইংরেজ চিত্রকর, রয়েল কলেজ অব আর্টস-এর প্রিন্সিপাল, লেখক) সাথে দেখা করে তার হাতে দিলেন একটি নোটবই, যাতে রয়েছে তার অনূদিত কবিতা। রোদেনস্টাইন লিখেছেন, তিনিই ঠাকুরের আরো কিছু কবিতা পড়তে চেয়েছিলেন। কবিতা পড়ে মুগ্ধ ও আবেগাপ্লুত রোদেনস্টাইন কবিতাগুলোর কয়েক সেট টাইপ করিয়ে একটি করে সেট ডব্লিউ বি ইয়েটস (১৩ জুন ১৮৬৫-২৮ জুন ১৯৩৯, পরবর্তীকালের নোবেল বিজয়ী কবি)  স্টপফোর্ড অগাস্টাস ব্রুক (১৮৩২-১৯১৬, আইরিশ যাজক ও প্রভাবশালী লেখক) এবং অ্যান্ড্রু ব্র্যাডলের কাছে পাঠালেন।

ঠাকুরের সম্মানে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি (দাদাভাই নওরোজি ১৮৬৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন) ১০ জুলাই ১৯১২ ট্রোকাডেরো রেস্তোরাঁয় একটি সম্বর্ধনা ও নৈশভোজের উদ্যোগ নেয়। পেছনে মূল সংগঠক হিসেবে কাজ করেন উইলিয়াম রোদেনস্টাইন। একটি মুদ্রিত লিফলেটও বিতরণ করা হয়। হার্ডড্রিঙ্ক বাদে প্রবেশমূল্য ধরা হয় ৫ শিলিং। হার্ডড্রিঙ্ক যার যার তার তার।

এই সেই রেস্তোরা

আইরিশ কবি ও নাট্যকার ডব্লিউ বি ইয়েটসকে সভাপতিত্ব করতে সম্মত করান রোদেনস্টাইন। জন গলসওয়ার্দি (১৯২৫ সালের নোবেল প্রাইজ বিজয়ী) এবং গোপালকৃষ্ণ গোখলে (১৮৬৫-১৯১৫, ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারক) সে সময় লন্ডন থাকবেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন।

সম্বর্ধনা ও ডিনারে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন: ১. আইরিশ কবি নাট্যকার ডব্লিউ বি ইয়েটস, ২. অক্সফোর্ডের কবিতার অধ্যাপক জে ডব্লিউ ম্যাককেইন (১৮৫৯-১৯৪৫), ৩. আইরিশ কবি ও নাট্যকার হার্বাট ট্রেঞ্চ (১৮৬৫-১৯২৩), ৪. স্কটিশ কথাশিল্পী ও ভ্রমণ-লেখক আর বি কানিংহাম গ্রাহাম (১৮৬৫-১৯২৩), ৫. ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিভিল লিবার্টিজের প্রেসিডেন্ট, সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার এইচ ডব্লিউ নেভিনসন (১৮৫৬-১৯৪১), ৬. ইংরেজ ঔপন্যাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী এইচ জি ওয়েলস (১৮৬৬-১৯৪৬), ৭. ইংরেজ সঙ্গীত গবেষক সিসিল শাপ (১৮৫৯-১৯২৪), ৮. ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য ও ক্যামব্রিজে বাংলার লেকচারার জে ডি অ্যান্ডারসন (১৮৫২-১৯২৪), ৯. কলকাতা আর্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল ও মাদ্রাজ স্কুল অব আর্ট-এর তত্ত্ববধায়ক ই বি হাভেল (১৮৬১-১৯৩৪), ১০. ইন্ডিয়া অফিসের ছাত্র বিষয়ক পরামর্শক টি ডব্লিউ আর্নল্ড (১৮৬৩-১৯৩০), ১১. রয়েল কলেজ অব মিউজিকের প্রফেসর ও সুরকার  আর ফন উইলিয়ামস (১৮৭২-১৯৫৮), ১২. আইরিশ লিটারেরি সোসাইটির প্রথম সেক্রেটারি ও ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয় রিভিউ-র সম্পাদক ডি ডব্লিউ রোলেস্টন (১৮৫৭-১৯২০), ১৩. চিত্রশিল্পী এবং রয়েল কলেজ অব আর্টসের প্রিন্সিপাল উইলিয়াম রোদেনস্টাইন (১৮৭২-১৯৪৫), ১৪. ইন্ডিয়া অফিসে ইন্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্য কে গুপ্ত (১৮৫১-১৯২৬), ১৫. ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও কবি মিস মে সিঙ্কলেয়ার (১৮৬৩-১৯৪৬), ১৬. ব্রিটিশ রিপাবলিকান বিপ্লবী, অভিনেত্রী এবং ডব্লিউ বি ইয়েটস-এর প্রেমিকা মাদাম মড গন (১৮৬৬-১৯৫৩), ১৭. মার্টিনেগ্রো সেসারেস্কো (পরিচিতি উদ্ধার করা যায় নি)। আরো কেউ কেউ ডিনারে ছিলেন বলে সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়। ছোট সংবাদ হলেও বিলেতি বুদ্ধিজীবী মহলে ও বাইরে ডিনারটি আলোচনায় চলে আসে।

এই ডিনারের আগে ৩০ জুন ১৯১২ রোদেনস্টাইন একটি পরিচিতি সভা ও গীতাঞ্জলি থেকে পাঠের আয়োজন করেন। ডব্লিউ বি ইয়েটস ইংরেজি অনুবাদে কয়েকটি নৈবেদ্য কবিতা পাঠ করে শোনান। সেদিনের অনুষ্ঠানে আরো ছিলেন মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড (১৮৮৫-১৯৭২), মে সিঙ্কলেয়ার, এভনিল আন্ডারহিল, আর্নেস্ট রাইস, এলিস মেয়নেল, হেনরি নেভিনসন, চার্লস ট্রাভেলিয়ান, আর্থার ফক্স-স্ট্র্যাংওয়েজ এবং সি এফ অ্যান্ড্রুজ।

ইংরেজিতে ১০৩টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘সঙ্ অফারিংস’, সাথে ডব্লিউ বি ইয়েটসের ভূমিকা। প্রকৃতপক্ষে গীতাঞ্জলির ৫৩টি, গীতিমাল্যের ১৬টি, নৈবেদ্যের ১৬টি, খেয়ার ১১টি, শিশুর তিনটি, কল্পনার একটি, স্মরণের একটি, চৈতালির একটি, উৎসর্গের একটি এবং অচলায়তনের একটি নিয়ে মোট ১০৪টি বাছাই করা হয়। নৈবেদ্যের ৮৯ এবং ৯০ নম্বর কবিতা একত্র করে গীতাঞ্জলির ৯৫ নম্বর কবিতা সৃষ্টি করা হলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৩টি। প্রথমটি ‘আমারে তুমি অশেষ করেছো’ এবং শেষটি ‘একটি নমস্কার প্রভু’।

ডিনারের পরপর রবীন্দ্রনাথ আরো বিশিষ্ট যাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন তাদের মধ্যে রয়েছেন জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, বাট্রান্ড রাসেল, জন গলসওয়ার্দি, রবার্ট ব্রিজেস, জন ম্যাসফিল্ড, টমাস স্টার্জ মুর, এবং ডব্লিও এইচ হাডসন।

সেই ডিনারেও ইয়েটস গীতাঞ্জলি থেকে রবীন্দ্রনাথের তিনটি গীতিকবিতা পড়ে শোনান। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কয়েকটি কবিতা পড়েন। ব্রিটিশ প্রেস পরদিন এই ডিনারের সংবাদ পরিবেশন করে।

ইংরেজিতে ১০৩টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘সঙ্ অফারিংস’, সাথে ডব্লিউ বি ইয়েটসের ভূমিকা। প্রকৃতপক্ষে গীতাঞ্জলির ৫৩টি, গীতিমাল্যের ১৬টি, নৈবেদ্যের ১৬টি, খেয়ার ১১টি, শিশুর তিনটি, কল্পনার একটি, স্মরণের একটি, চৈতালির একটি, উৎসর্গের একটি এবং অচলায়তনের একটি নিয়ে মোট ১০৪টি বাছাই করা হয়। নৈবেদ্যের ৮৯ এবং ৯০ নম্বর কবিতা একত্র করে গীতাঞ্জলির ৯৫ নম্বর কবিতা সৃষ্টি করা হলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৩টি। প্রথমটি ‘আমারে তুমি অশেষ করেছো’ এবং শেষটি ‘একটি নমস্কার প্রভু’।

প্রথম কবিতা:

আমারে তুমি অশেষ করেছ,  এমনি লীলা তব–
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ   জীবন নব নব।।
কত-যে গিরি কত-যে নদী-তীরে
বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
কাহারে তাহা কব।।
তোমারি ওই অমৃতপরশে     আমার হিয়াখানি
হারালো সীমা বিপুল হরষে,   উথলি উঠে বাণী।
আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী–
হল না সারা, কত-না যুগ ধরি
কেবলই আমি লব।।

গীতাঞ্জলীর শেষ কবিতাটি ছিল:

একটি নমস্কারে, প্রভু,
একটি নমস্কারে
সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক
তোমার এ সংসারে।
ঘন শ্রাবণ-মেঘের মতো
রসের ভারে নম্র নত
একটি নমস্কারে, প্রভু,
একটি নমস্কারে
সমস্ত মন পড়িয়া থাক্
তব ভবন-দ্বারে।
নানা সুরের আকুল ধারা
মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা
একটি নমস্কারে, প্রভু,
একটি নমস্কারে
সমস্ত গান সমাপ্ত হোক
নীরব পারাবারে।
হংস যেমন মানসযাত্রী,
তেমনি সারা দিবসরাত্রি
একটি নমস্কারে, প্রভু,
একটি নমস্কারে
সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক
মহামরণ-পারে।

১৯১২-তে ইন্ডিয়া সোসাইটি গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। ছাপা হয় চিজউইক প্রেসে। এতে কিছু কিছু পঙ্‌ক্তির পরিবর্তন ইয়েটসকে অসন্তুষ্ট করে এবং তিনি ৯ জানুয়ারি ১৯১৩ তা চিঠি লিখে রবীন্দ্রনাথকে জানান। জানা যায় পরিবর্তনগুলো করেন সি এফ অ্যান্ড্রুজ। ১৯১৩-তে প্রকাশিত ‘সঙ্ অফারিংস’-এর ম্যাকমিলান সংস্করণের আগে রবীন্দ্রনাথ নিজেই কিছু পরিবর্তন আনেন এবং চূড়ান্তভাবে দেখে দেওয়ার জন্য ইয়েটসকে অনুরোধ করেন।

১৯১৩-তে প্রকাশিত হয় গীতাঞ্জলির ম্যাকমিলান সংস্করণ। বইটি রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেন রোদেনস্টাইনকে, উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লিখা ছিল ‘টু উইলিয়াম রোদেনস্টাইন’।

রবীন্দ্রনাথ ব্রিটেনের বাইরেও আলোচিত হতে থাকেন।

রোদেনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ

নোবেলের পথে আরো একধাপ
ইয়েটসের মুখবন্ধ নোবেলের পথে রবীন্দ্রনাথকে আরো একধাপ এগিয়ে দিল। ইংরেজ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (জন্ম ১৩ জুন ১৮৬৫, মৃত্যু ২৮ জানুয়ারি ১৯৩৯) রবীন্দ্রনাথের চার বছর পর আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১০-এর দশকে কবি হিসেবে তিনি যথেষ্ট পরিচিত ও সমাদৃত। মূলত রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে খসড়া পাণ্ডুলিপি থেকে গীতাঞ্জলি পড়ে তিনি রবিমুগ্ধ ও গীতাঞ্জলিমুগ্ধ হয়ে পড়লেন। এই মুগ্ধতাই তাকে দিয়ে ‘সঙ অফারিংস’—অনূদিত ইংরেজি-গীতাঞ্জলির ভূমিকা লিখিয়ে নিল। অবাঙালি ইংরেজিভাষী-পাঠকের জন্য কী লিখেছেন ইয়েটস?

শুরুটা এমন:
কয়েকদিন আগে একজন বিশিষ্ট বাঙালি ডাক্তারকে বললাম আমি জার্মান ভাষা জানি না, তবু কোনো জার্মান কবির কবিতার অনুবাদ যদি আমাকে নাড়া দেয় আমি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে কিছু ইংরেজি বই খুঁজতাম, যা আমাকে সেই কবির জীবন ও চিন্তার ইতিহাস তুলে ধরতে সক্ষম হতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গদ্যানুবাদগুলো আমার রক্তে এমন নাড়া দিয়েছে, বহুবছর অন্য কিছু এমন নাড়া দিতে পারেনি। তার জীবন ও চিন্তার সঞ্চরণ সম্পর্কে আমি কিছুই জানতে পারতাম না যদি না কোনো একজন ভারতীয় পর্যটক তা আমাকে জানিয়ে যেতেন।

তার কবিতা যে আমাকে নাড়া দেবে এটাই তার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। কারণ, তিনি বললেন, ‘আমি প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথ পড়ি, তার একটি পঙ্ক্তি পাঠ করা মানে জগতের তাবৎ সমস্যা ভুলে যাওয়া।’

আমি বললাম দ্বিতীয় রিচার্ডের রাজত্বকালে লন্ডননিবাসী কোনো ইংরেজকে পেত্রার্ক কিংবা দান্তের অনুবাদ দেখিয়ে দেওয়া হলে তার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কোনো বই যেমন মিলত না— তাকে যেমন বরং ফ্লোরেন্সের কোনো বুদ্ধিজীবী কিংবা লোম্বার্ডের কোনো সওদাগরকে জিজ্ঞেস করতে হতো আমিও সে রকমই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। কারণ আমি যেটুকু জানি তা হচ্ছে কবিতাগুলো যত সরস ও প্রাচুর্যপূর্ণ; আর আপনাদের দেশে যে নতুন রেনেসাঁ সূচিত হয়েছে লোকমুখে শোনা ছাড়া তা আমার আর জানা হয়ে উঠত না।’ (নিবন্ধকারের অনুবাদ)

রবীন্দ্রনাথ ও ইয়েটসকে নিয়ে গ্রন্থ

ডব্লিউ বি ইয়েটসের এই প্রবন্ধসমান মুখবন্ধ পশ্চিমকে পূর্বের রবি সম্পর্কে আরো উৎসাহিত করে তোলে।

এমন নিষ্পাপ সারল্য সাহিত্যে অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। সেখানে পাখি ও পত্রপল্লব তার এত নিবিড় সান্নিধ্যের, যেন তা ঠিক শিশুদের নৈকট্যের; আর ঋতু পরিবর্তনের বড় ঘটনাগুলো আমাদের চিন্তা জাগ্রত হওয়ার আগে যেমন ছিল, সেভাবেই তাদের আর আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়েছে। কখনো আমার অবাক লাগে তিনি কি এই গুণ বাংলা সাহিত্য থেকে পেয়েছেন না ধর্ম থেকে।

উপসংহারে এসে ইয়েটস লিখেছেন:
‘‘এমন নিষ্পাপ সারল্য সাহিত্যে অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। সেখানে পাখি ও পত্রপল্লব তার এত নিবিড় সান্নিধ্যের, যেন তা ঠিক শিশুদের নৈকট্যের; আর ঋতু পরিবর্তনের বড় ঘটনাগুলো আমাদের চিন্তা জাগ্রত হওয়ার আগে যেমন ছিল, সেভাবেই তাদের আর আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়েছে। কখনো আমার অবাক লাগে তিনি কি এই গুণ বাংলা সাহিত্য থেকে পেয়েছেন না ধর্ম থেকে।’’

ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে উদ্ধৃত দিয়েছেন: ‘‘জীবনেরে এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়/ মৃত্যুরে এমনি ভালোবাসিব নিশ্চয়।’’

ইন্ডিয়া সোসাইটির গীতাঞ্জলি, ১৯১২

নোবেলের পথে আরো, আরো একধাপ
রবীন্দ্রনাথের প্রতি আকৃষ্ট হন কবি টমাস স্টার্জ মুর। তিনি ইংরেজ কবি, লেখক এবং চিত্রশিল্পী। ৪ মার্চ ১৮৭০ ইস্ট সাসেক্স-এর ওয়েলিংটন স্কোয়ারে তার জন্ম। তিনি ১৯০১ সালে ইয়েটস লরেন্স বিনিয়ন, চার্লস রিকেটস, ইথেল ও সিবিল পাইকে নিয়ে লিটারেরি থিয়েটার ক্লাব গড়ে তোলেন। ১৯৩০ সালে পোয়েট লরিয়েট নির্বাচনের সময় যাদের নাম বিবেচিত হয় তিনিও তাদের মধ্যে ছিলেন। ১৮ জুলাই ১৯৪৪ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের আনুগত্যের খেসারত তাকে দিতে হয়েছে। ইংল্যান্ডের সাহিত্যচক্রে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন।

স্টার্জ মুর আরো কিছু অনুবাদে রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেন। তিনি আরো কাজে বিশেষ করে রবীন্দ্রসাহিত্যের অনুবাদ, পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা, প্রুফ দেখা ইত্যাদিতে নিজেকে নিয়োজিত রাখার প্রস্তাব দেন। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি রবীন্দ্রনাথকে লিখেন, যেন তিনি মৃতবস্থা থেকে উত্থিত হয়েছেন, অন্য পৃথিবীর বার্তা নিয়ে এসেছেন।

রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, ‘‘ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হয়, ইয়েটস, পাউন্ড, ফক্স, স্ট্র্যাংওয়েজ প্রভৃতি রবীন্দ্রনাথের বন্ধুরা তার সাথে স্টার্জ মুরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করছিলেন না। কিন্তু স্টার্জ মুর চলেছেন তার নিজস্ব পথে। রবীন্দ্রনাথের রচনা তাকে কত গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল তাঁর পত্রাবলীতে তার অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে আছে।’’

ব্রিটেনে সাহিত্যের খবরদারি রয়েল সোসাইটি অব লিটারেচার অব দ্য ইউনাইটেড কিংডম-এর হাতে। এই সোসাইটির প্রস্তাবে ১৯০৭ সালের প্রথম ব্রিটিশ নোবেল বিজয়ী রুডিয়ার্ড কিপলিং।

ম্যাকমিলানের গীতাঞ্জলি ১৯১৩, টাইটেল পেজ

১৯১৩ সালের জন্য সোসাইটি রুডিয়ার্ডের চেয়েও খ্যাতিমান টমাস হার্ডির নাম সুইডিশ একাডেমির কাছে প্রস্তাব করেছে। সোসাইটি প্রায় নিশ্চিত তাদের প্রস্তাব উপেক্ষিত হবে না, হার্ডি নোবেল পেয়ে যাবেন। কিন্তু স্টার্জ মুর একই সোসাইটির ফেলো। তিনি আলাদাভাবে রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করলেন। সুইডিশ একাডেমির নথিপত্রে এই প্রস্তাবনার প্রমাণ রয়েছে:

No 17   Rabindranath Tegore
To The Secretary of The Nobel Committee Of Swedish Academy Stockholm
Sir,
As a fellow of the Royal Society of literature of the United Kingdom, I have the honour to propose the name of Rabindranath Tagore as a person qualified, in my opinion, to be awarded the Nobel Prize in literature.
T. Sturge Moor

তখন নোবেলের জন্য লড়াইতে খ্যাতিমান আরো কয়েকজন ছিলেন। টমাস হার্ডির জন্য রয়েল সোসাইটি অব লিটারেচারের ৯৭ জন সদস্য। ৭০০ স্বাক্ষরসহ প্রস্তাবিত স্পেনের বেনিতো পেরেজ গ্যাল্ডোস, সুইজারল্যান্ড থেকে প্রস্তাবিত কার্ল স্পিটেলার, ইতালি থেকে গ্রাজিয়া দেলেদ্দা, ফ্রান্স থেকে আনেস্ত লেভি এবং পিয়েরে লতি।

একটি মাত্র প্রস্তাব এবং প্রথমবারের প্রস্তাবেই পুরস্কৃত হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যারা তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তাদের মধ্যে দুজন কার্ল স্পিটেলার এবং গ্রাজিয়া দেলেদ্দা পরে নোবেল পুরস্কার পান, কিন্তু সবচেয়ে বেশি যিনি পরিচিত এবং পুরস্কারের অত্যন্ত ন্যায্য দাবিদার, সেই হার্ডির নাম আরো ক’বার প্রস্তাবিত হলেও শেষ পর্যন্ত নোবেল তার জোটেনি। ইংরেজরা স্টার্জ মুরকে ক্ষমা করতে পারেনি।

সাহিত্যে ১৪তম নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ
শুরুটাই খুব হতাশাব্যঞ্জক। সাহিত্য-বিশ্ব প্রায় নিশ্চিত সবচেয়ে দামি প্রথম সাহিত্য পুরস্কারটি পাচ্ছেন লেভ তলস্তয়। সুইডিশরা তাকে আগাম অভিনন্দন জানিয়েছে। তলস্তয় পুরস্কারের অর্থ ব্যয় করার একটি পরিকল্পনাও করে ফেলেছেন, রাশিয়ার সংখ্যালঘু ও নির্যাতিত দুখোবর সম্প্রদায়ের লোকদের কানাডা পাঠানোর জন্য একটি জাহাজ কিনে দেবেন। কিন্তু তলস্তয় নোবেল পুরস্কার পাননি। পুরস্কার পেলেন ফরাসি কবি সুলি প্রুধোম।

রবীন্দ্রনাথের আগে যে ১৩ জন সাহিত্যের নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন তারা হচ্ছেন, সুলি প্রুধোম (ফ্রান্স, ১৯০১), যিওডোর মোমসেন (জার্মানি, ১৯০২), ৩. বিয়র্নস্টার্ন বিয়র্নসন (নরওয়ে, ১৯০৩), ফ্রেডেরিক মিস্ত্রাল (ফ্রান্স, ১৯০৪), হোসে এশেগ্যারে (স্পেন, ১৯০৪), হেনরিস সিনকিউইজ (পোল্যান্ড, ১৯০৫), গিয়াসো কার্দুসি (ইতালি, ১৯০৬), রুডিয়ার্ড কিপলিং (ব্রিটেন, ১৯০৭), রুডএফ ইউকেশ (জার্মানি, ১৯০৮), সেলমা লেগারলফ (সুইডেন, ১৯০৯), পল ফন হেইসে (জার্মানি, ১৯১০), মারিস মেটারলিঙ্ক (বেলজিয়াম, ১৯১১), গেরহার্ত হাউপ্তম্যান (জার্মানি, ১৯১২)।

১৯১৩-র পুরস্কারটি ঘোষিত হয় ১৩ নভেম্বর। ম্যাকমিলান থেকে ১৪ নভেম্বর টেলিগ্রামটি আসে ৬ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন, জোড়াসাঁকোর ঠিকানায়। রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে। টেলিগ্রামের গন্তব্য বদলে যায়। টেলিগ্রামটি যেমন ছিল:

‘SWEDISH ACADEMY AWARDED YOU NOBEL PRICE LITERATURE PLEASE WIRE ACCEPTATION SWEDISH MINISTER.’

রবীন্দ্রনাথ বিদেশিদের কাছ থেকে টেলিগ্রামে অনেক অভিনন্দন পান। খুব মনে ধরার মতো একটি হচ্ছে: ‘‘রবিবাবু, আপনাকে দেবার মতো পৃথিবীর আর কিছু নেই। এখন আপনি আত্মহত্যা করতে পারেন।’’

নোবেল সম্মানের ভূত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকাশক ম্যাকমিলান সুইডিশ একাডেমির ১৪ নভেম্বর ১৯১৩-এর টেলিগ্রামের ওপর ভিত্তি করে কবিকে টেলিগ্রাম পাঠালো যে, তিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঈর্ষাপরায়ণ বাঙালির দীর্ঘদিনের ঈর্ষার শিকার। নোবেল সে ঈর্ষাকে আরো বাড়িয়ে দিল। নোবেল বাগাতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রের কত খরচ হলো সে গুঞ্জনও কলকাতায় শোনা গেল।

১ অগ্রহায়ণ ১৩২০ (পুরস্কারের খবর জানার দু’দিন পর) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীকে লিখলেন:

‘‘সম্মানের ভূতে আমাকে পাইয়াছে। আমি মনে মনে ওঝা ডাকিতেছি— আপনাদের আনন্দে আমি সম্পূর্ণ যোগ দিতে পারিতেছি না। আপনি হয়তো ভাবিবেন এটা আমার অত্যুক্তি হইল। কিন্তু জানেন আমার জীবন কীরূপ ভরাতুর হইয়া উঠিয়াছে।’’

২৩ ডিসেম্বর ১৯১৩ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা জানাতে পাঁচ শতাধিক বিশিষ্ট বাঙালি বিশেষ ট্রেন ভাড়া করে ব্যান্ড পার্টি সহযোগে বোলপুরে স্টেশনে এসে হাজির হন। সেখান থেকে অধিকাংশই পদব্রজে শান্তিনিকেতন আসেন।

এই আগমন সম্পর্কে শান্তিনিকেতন তথা রবীন্দ্রনাথ অবহিত। অতিথি আপ্যায়নের জন্য ১০০৫টি কমলাসহ বিভিন্ন খাবার যোগাড় করা হয়। জোড়াসাঁকো থেকে ঠাকুরবাড়ির কারিগর এখানে এসে অভ্যাগতদের জন্য মুখরোচক মিঠাই মণ্ডা তৈরি করে পরিবেশন করেছেন। নিশ্চয়ই দূরাগত এসব অতিথিপরায়ণ মিষ্টান্ন ও ফল তৃপ্তিসহ খাবেন।

সীতাদেবী শুনেছিলেন সম্বর্ধনার জবাবে রবীন্দ্রনাথ গান গেয়ে শোনাবেন, ‘‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’’। কিন্তু কবি সুর ধরলেন না। শান্তিনিকেতনে এই মহতী অনুষ্ঠানে সম্বর্ধনার জবাবে কী বলবেন রবীন্দ্রনাথ তাও আগাম তৈরি করে রেখেছিলেন। সেই সম্বর্ধনার জবাব থেকে কয়েকটি পঙ্‌ক্তি:

‘‘আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসঙ্কোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই।…

দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয়নি এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। এমন সময় কী জন্য যে বিদেশ হতে আমি সম্মান লাভ করলুম তা এখন পর্যন্ত আমি নিজেই ভালো করে উপলব্ধি করতে পারিনি।…

আজ ইউরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছে। তার যদি কোনো মূল্যও থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের, আমার দেশের সঙ্গে তার কোনো আন্তরিক সমন্ধ নেই।

অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে যে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করব?

এ সম্মান আমি কতদিনই বা রক্ষা করব? আমার আজকের এই দিন চিরদিন থাকবে না, আমার ভাটার বেলা আসবে—তখন পঞ্চতলের সমস্ত দৈন্য আবার তা ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে।…

আজ আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন তা আমি ওষ্ঠের কাছ পর্যন্ত ঠেকাব, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারব না। এর মত্ততা থেকে আমার চিত্তকে আমি দূরে রাখতে চাই।’’

কবির ভাষণের সময়ই গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। অভ্যাগতরা ক্ষুব্ধ ও অপমানিত বোধ করে জলযোগ না করেই দ্রুত বোলপুর স্টেশনের দিকে পা বাড়ান।

শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের প্রধান পুরোহিত তার দলবল নিয়ে অতিথিদের খাবার ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসেন। সীতাদেবীর যতদূর মনে পড়ে—‘‘খাদ্যদ্রব্যগুলোর সদগতিই হইয়াছিল।’’

পাদটীকা
আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকাটাই স্ত্রী তালাকের খেসারত হিসেবে মিলেভার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী তার নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির এক যুগ আগে ১৭ নভেম্বর ১৯০২ প্রয়াত হয়েছেন। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ৫৪ বছর। নোবেল প্রাইজের ৮,০০০ ডলার থেকে একটি সেন্টও তাকে কোনো নারীর জন্য ব্যয় করতে হয়নি। টাকাটা রেখেছিলেন পল্লী উন্নয়ন ব্যাংকে, মূলত দরিদ্রদের জীবিকা সহায়তার জন্য। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজের টাকাসহ ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায় আর রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া নোবেল মেডেলটিও বিশ্বভারতী থেকে চুরি হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ কেবল দিয়েই গেছেন। এমন কি গানেও: আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারিনি তোমারে নাথ।

‘‘আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারি নি তোমারে নাথ—
আমার লাজ ভয়, আমার মান অপমান, সুখ দুখ ভাবনা ॥
মাঝে রয়েছে আবরণ কত শত, কতমতো—
তাই কেঁদে ফিরি, তাই তোমারে না পাই,
মনে থেকে যায় তাই হে মনের বেদনা ॥
যাহা রেখেছি তাহে কী সুখ—
তাহে কেঁদে মরি, তাহে ভেবে মরি।
তাই দিয়ে যদি তোমারে পাই কেন তা দিতে পারি না?
আমার জগতের সব তোমারে দেব, দিয়ে তোমায় নেব— বাসনা ॥’’

নোবেল দলিলে ট্যাগোর ব্রিটিশ কবি। রবীন্দ্রনাথ তখন বাস্তবিকই ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ব্রিটিশ নাগরিক। ১৯৪১-এ তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতেই মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: momen98765@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত