Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

হালখাতা উৎসবে ভাটা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
Picture of সাজ্জাদ হোসেন

সাজ্জাদ হোসেন

কাগজের হাতি, ঘোড়া, ইলিশ, ঘুড়ি, ঢোল ঝুলছে দোকানে দোকানে। কোনও কোনও দোকানে ঝুলছে ফুলের মালাও। আর ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দেখা মিলল ফুলের বড় বড় তোড়া।

কাগজের হাতি-ঘোড়া আর ফুল দিয়ে দোকান সাজানোর পাশাপাশি রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। কোনও ক্রেতা এলেই তাকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন দোকানমালিক। কারণ আজ পহেলা বৈশাখ, আজ হালখাতা। পণ্য বিক্রি নয়, ক্রেতাকে খুশি করাই আজ ব্যবসায়ীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

বৈশাখের প্রথম দিন রবিবার সকালে এমন দৃশ্য চোখে পড়ল রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের বিভিন্ন দোকানে। এদিন ছিল গণেশ পূজাও। হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানে দোকানে ছিল গণেশ পূজার জমকালো আয়োজন। তাদের অনেকের দোকানের সামনেই ঢাক বাজিয়ে উৎসবের বার্তা দিচ্ছিলেন বাদকরা।

হালখাতা পুরান ঢাকার শত বছরের ঐতিহ্য। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে পুরোনো হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলেন তারা। তবে হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন এখন আর আগের মতো নেই। অতীতে হালখাতার এক দুই সপ্তাহ আগে থেকে দোকান সাজানো হতো। এখন খুব ক্ষুদ্র পরিসরে হয় হালখাতা। এবার ঈদের ছুটির কারণে সেই আয়োজনেও ভাটা পড়েছে।

হালখাতা অনুষ্ঠানের পাশপাশি গণেশ পূজার আয়োজন করেছিলেন তাঁতীবাজারের সোমনাথ গোল্ড কর্নার ও ভূমি গোল্ড হাউসের মালিক সুমন পোদ্দার। হালখাতার জন্য নিজের ছেলেকেও দোকানে নিয়ে এসেছেন তিনি।

সুমন পোদ্দার সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন, গণেশ দেবতাকে সাক্ষী রেখে এই অনুষ্ঠান। বছরের প্রথম দিনে তার পূজা করার পাশাপাশি হিসাবের নতুন খাতা খোলা হয়। তবে অন্যবারের তুলনায় এবার খুব সীমিত পরিসরে এই আয়োজন হচ্ছে। এবার ঈদের ছুটির কারণে লোকজন খুবই কম। অনেক দোকান তো খোলাও হয়নি।

“আমাদের এই ঐতিহ্য শত বছরের পুরাতন। আমার দাদা-বাবার সময়ও হালখাতার আয়োজন করা হতো। এখন আমি করছি। আশা করি, পরবর্তীতে আমার ছেলেও এই ঐতিহ্য ধরে রাখবে”, বলেন তিনি।

পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের এই দোকানে ছিল এমন সাজ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সুমন পোদ্দারের দোকানের সামনেই ঢাক বাজাচ্ছিলেন নগেন্দ্র দাস।

তিনি জানান, হালখাতার উৎসব আর গণেশ পূজা উপলক্ষে ডাক পড়েছে তার। গত ৪২ বছর ঢাক বাজিয়ে জীবন কাটানো নগেন্দ্রর বাড়ি নরসিংদীর ঘোড়াদিয়া। সেখান থেকে রবিবার সকালে পুরান ঢাকায় এসেছেন তিনি।

নগেন্দ্র দাস বলেন, “প্রতিবছরই এই দিনে তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজারে আসি। যারা গণেশ পূজা করেন তারা আমাদের ডেকে আনেন। বিভিন্ন দোকানে পূজার সময় ঢাক বাজাই আমি। এতে সারাদিনে ৩-৪ হাজার টাকা আয় হয়।”

পহেলা বৈশাখে গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে পুরান ঢাকা এসেছেন আরেক বাদক সঞ্জীবন।

আক্ষেপ করে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আগে সারা দিন ধরেই বিভিন্ন দোকানে উৎসব লেগে থাকত। সকাল থেকে সারাদিন একের পর এক দোকানে ঢাক বাজানোর ডাক আসত। আর আজ তেমন মানুষ নেই, তাই দুপুরের আগেই সব আয়োজন শেষ।”

হালখাতায় ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করানোর কারণ হিসেবে রঞ্জিতা গোল্ড হাউসের ম্যানেজার কৃষ্ণঘোষ বলেন, “সারা বছর ক্রেতারা দোকানে আসেন। আমরা তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করেই আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখি। সেজন্য কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বছরের এই দিনটিতে তাদের আপ্যায়ন করি আমরা। একইসঙ্গে নতুন হিসাবের খাতা খোলা হয়।”

হালখাতার সঙ্গে পহেলা বৈশাখ ও গণেশ পূজা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বলে জানান পুরান ঢাকার এই ব্যবসায়ী।

এদিন ছিল গণেশ পূজাও। হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানে দোকানে ছিল গণেশ পূজার জমকালো আয়োজন। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

শরীফ গোল্ড হাউসের কর্ণধার আজিজুর রহমান বলেন, “এখন আর সেভাবে হালখাতা উদযাপন করা হয় না। তবে আয়োজন থাকুক আর না থাকুক এই দিনে প্রতিটি দোকানেই হিসাবের নতুন খাতা খোলা হয়। সারা বছর অনেক ক্রেতা বাকিতে পণ্য নেন।

“তাদের অনেকই এই দিনে বাকির টাকা পুরোপুরি পরিশোধ করেন। অনেকেই কিছু টাকা পরিশোধ করে নতুন খাতায় তাদের হিসাব ওঠান। আবার এমনও হয়, কারও হয়তো ১০ টাকা বাকি পড়েছে সে ৯ টাকা দিয়ে বলে হিসাব শেষ করতে।” 

তাঁতীবাজারে বণিক সমিতির অধীনে ৫০০-৬০০ দোকান রয়েছে। আরও তিনটি সমিতি রয়েছে তাঁতীবাজারে।

সব মিলে পুরান ঢাকার এই বাজারে দেড় হাজারের বেশি দোকান আছে জানিয়ে তাঁতীবাজার বণিক সমিতির সভাপতি পবিত্র চন্দ্র বলেন, “ঈদের ছুটির কারণে বেশিরভাগই দোকান বন্ধ আছে। কিছু দোকানে সীমিত পরিসরে হালখাতা উপলক্ষে বিভিন্ন আয়োজন করা হয়েছে।

“বছরজুড়েই এখানে ব্যবসা চলে। কিন্তু পহেলা বৈশাখ এলেই আমরা হালখাতা করে থাকি। নতুন টালি খাতা খুলে পুরনো হিসাব বন্ধ করি। এই প্রথা যুগ যুগ ধরে চলছে।”

তবে হালখাতা উৎসব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, আক্ষেপ করে বললেন তিনি।

হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানে দোকানে এদিন ঢাক বাজাতে দেখা যায় বাদকদের। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

তাঁতীবাজার বণিক সমিতির সভাপতি পবিত্র চন্দ্র বলেন, “এখন ব্যবসায়ীরা সবাই ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে আয়-ব্যয়ের হিসাব করেন। তাই ধীরে ধীরে পহেলা বৈশাখে হালখাতা উৎসব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা এখন নিজের সুবিধামতো ক্রেতাদের কাছ থেকে বাকি টাকা আদায় করে থাকে।”

তাঁতীবাজারের মতো পহেলা বৈশাখে হালখাতার আয়োজন করেন পাশের শাঁখারীবাজারের ব্যবসায়ীরাও।

পুরান ঢাকায় হালখাতা উৎসবের সেই জৌলুশ আর নেই বলে জানালেন শাঁখারীবাজারের শ্রী ধর সোম শঙ্খ ভাণ্ডারের মালিক ভোলানাথ ধর।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এক সময় ঘটা করে হালখাতার আয়োজন করতাম আমরা। তবে বাংলা সনের প্রথম দিনের এই আমেজটা কালের বিবর্তনে অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। আগে নববর্ষের এক সপ্তাহ আগেই হালখাতার জন্য নিমন্ত্রণপত্র প্রস্তুত করতেন ব্যবসায়ীরা।

“সেই নিমন্ত্রণপত্রে মুসলিম ব্যবসায়ীদের জন্য থাকত মসজিদের মিনারের ছবি আর হিন্দু ব্যবসায়ীদের নিমন্ত্রণপত্রে গণেশের ছবি। এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। কিছু ব্যবসায়ী খুব সীমিত পরিসরে ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।”

হালখাতা মানে শুধু পুরনো হিসাব চুকানো আর নতুন খাতা খোলা- বিষয়টি এমন নয় বলে মনে করেন শাঁখারীবাজারের আরেক ব্যবসীয় লোকনাথ শঙ্খ ভাণ্ডারের মালিক বিশ্বনাথ।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এটি আমাদের কাছে একটি উৎসব। এবার ঈদের ছুটির কারণে সেই উৎসবে কিছুটা ভাটা পড়েছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত