Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

কেন ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া চালাচ্ছে রাশিয়া

russia_tactical
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে নন-স্ট্র্যাটেজিক বা ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে সামরিক মহড়া চালানোর ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইউক্রেনের আশপাশে অবস্থানরত রুশ নৌবাহিনীর সদস্য ও অন্য সেনারা এ মহড়ায় অংশ নেবে।

সম্প্রতি শীর্ষ ইউরোপীয় নেতারা ইউক্রেনের জন্য জোরদার সামরিক সহায়তার কথা বলার কয়েকদিন পরই রাশিয়া এই মহড়ার ঘোষণা দিল। মস্কোর দাবি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির কারণেই তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার কৌশলগত পারমাণবিক বাহিনী নিয়মিতই এই ধরনের মহড়া চালায় বা অনুশীলন করে। তবে গত সোমবার প্রথমবারের মতো দেশটি এই ধরনের মহড়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করল। মস্কোর এই পদক্ষেপ নতুন করে পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা বৃদ্ধিরই লক্ষণ প্রকাশ করছে।

সোমবার রুশ প্রেসিডেন্টের দপ্তর ক্রেমলিন থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর নেতাদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই মহড়ার আদেশ দিয়েছেন।

রাশিয়া দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে যুদ্ধ করছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গত সপ্তাহে বলেছিলেন, কিয়েভ অনুরোধ জানালে তার দেশ ইউক্রেনে স্থল সেনা পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে। তার একদিন পরই যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও বলেন, ইউক্রেন চাইলে রাশিয়ার ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলায় ব্রিটিশ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।

রাশিয়ার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় প্লেসেতস্ক থেকে উৎক্ষেপণ করা হচ্ছে একটি সারমাত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। ফাইল ছবি

রাশিয়া তাদের উভয়ের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে পাল্টা জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। মস্কো দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছে যে, ন্যাটো সামরিক জোটের ইউরোপীয় সদস্যরা ইউক্রেনে যুদ্ধ করার জন্য সেনা পাঠালে রাশিয়া সেসব দেশেও হামলা চালাবে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রতিবেশী ইউক্রেন হামলা শুরু করার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাশিয়া বারবার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিও দিচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রও বলেছিল, রাশিয়ার এই হুমকি গুরুত্ব সহকারেই নিতে হবে; যদিও দেশটির কর্মকর্তারা বলেন, তারা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডে এখনও বড় কোনও পরিবর্তন দেখেননি।

রাশিয়া বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা ইউক্রেনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে বিশ্বকে পারমাণবিক শক্তিগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্র রুশ ভূখণ্ডেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দুই বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। বিশ্বের ১২ হাজারের বেশি পারমাণবিক বোমার মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি রয়েছে দেশ দুটির কাছে। আর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের মালিক চীন। এর পরেই রয়েছে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য।

ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র কী

স্ট্র্যাটেজিক ও নন-স্ট্র্যাটেজিক বা ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের সর্বজনীন কোনও সংজ্ঞা নেই। সাধারণত আকার ও ধ্বংসক্ষমতার ভিত্তিতে পারমাণবিক বোমাগুলোকে এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক অস্ত্রের ‍তুলনায় ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রগুলোর আকার ছোট এবং ধ্বংসক্ষমতাও অনেক কম হয়ে থাকে।

তবে সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রচলিত বোমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোসহ বিস্ফোরণের বাইরেও শত্রুদের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

একটি স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক বোমার পুরো একটি শহর ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। এই ধরনের বোমা হামলার জন্য বিশাল আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হয়, যা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে গিয়ে এবং সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।

রাশিয়ার ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সংজ্ঞা অনুযায়ী, স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক অস্ত্র ‘শত্রুদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা এবং যুদ্ধ করার ইচ্ছা’ ধ্বংস করার জন্য নকশা করা হয়। উৎপাদন, অবকাঠামো, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বড় আকারের কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য এই বোমা বানানো হয়।

বিপরীতে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রগুলো আরও সীমিত এবং তাৎক্ষণিক সামরিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ডিজাইন করা হয়ে, যেমন, যুদ্ধের ময়দানে জয়লাভ। ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী করে বানানো হয়।

এগুলোকে স্বল্পপাল্লার মিসাইল, যুদ্ধবিমান বা এমনকি কামানের মাধ্যমেও ব্যবহার করা যেতে পারে। আকারে ছোট হওয়ায় ট্রাক বা যুদ্ধবিমানে করেই সেগুলোকে বহন করা যায়।

যুদ্ধক্ষেত্রে একসঙ্গে অনেক সেনাকে হত্যা এবং ট্যাঙ্ক, বিমানঘাঁটি, ডুবোজাহাজ বা বিমানবাহী রণতরী ধ্বংস করতে এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।

ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমার ওজন সর্বনিম্ন ১ কিলোটনেরও কম এবং সর্বোচ্চ ৫০ কিলোটন পর্যন্ত হতে পারে। আর স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক বোমাগুলোর ওজন ১০০ কিলোটন থেকে শুরু করে ১ মেগাটনেরও বেশি।

স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন ও ব্যবহার যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে তেমন চুক্তি ও সীমাবদ্ধতা নেই। রাশিয়া তাদের ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য কোনও তথ্য-উপাত্তও প্রকাশ করেনি।

ধারণা করা হয়, যেহেতু তারা কম শক্তিশালী এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের হত্যায় বা যুদ্ধ সরঞ্জাম ধ্বংসে ব্যবহার করা হবে, তাই তাদের ব্যবহার ‘গ্রহণযোগ্য’ হবে। এই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহারে প্রতিপক্ষ এমন কোনও পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া জানাবে না, যা একটি পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে।

তবে সমস্যা হল, এই ধারণা শুধু একটি অনুমান। এমনকি ২০১৮ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, “যে কোনও ধরনের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারও স্ট্র্যাটেজিক বা বড় ধরনের কৌশলগত পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।”

রাশিয়ায় বিজয় দিবস সামনে রেখে গত ৫ মে সামরিক বাহিনীর মহড়ায় সাজোয়া যানের সঙ্গে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ছবি : এপি

যদি দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কিন্তু কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে তাদের ভিন্ন ভিন্ন দর্শন থাকে, তাহলে এক পক্ষ যাকে ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশল হিসেবে দেখে (ছোট পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার) অন্য পক্ষ তাকে সেভাবে নাও দেখতে পারে। এতে পরিস্থিতি বড় ধরনের পারমাণবিক প্রতিক্রিয়ার দিকে গড়াতে পারে।

তবে পুতিনের মাত্র ১০ কিলোটন ওজনের একটি পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের প্রতিশোধ নিতে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনও দেশ রাশিয়ার ওপর শত শত কিলোটন বা মেগাটন ওজনের পারমাণবিক বোমা ছুড়বে কি, যখন রাশিয়ার দিক থেকেও একই ধরনের পাল্টা প্রতিশোধমূলক হামলার ঝুঁকি থাকে? সেই সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়।

পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে রাশিয়ার সামরিক নীতি কী

রাশিয়ার সামরিক নীতিতে পারমাণবিক হামলা বা প্রচলিত অস্ত্র দিয়ে রুশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলার মতো হামলার বিরুদ্ধেও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। তাদের এই সামরিক নীতির ভাষা কিছুটা অস্পষ্ট। এ কারণে রাশিয়ার কিছু সামরিক বিশেষজ্ঞ দেশটির সামরিক নীতির ভাষা আরও স্পষ্ট করার আহ্বান জানান, যাতে পশ্চিমারা তাদের সক্ষমতাকে আরও গুরুত্ব সহকারে নেয়।

তবে পুতিন বলেন, “রুশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলার মতো কোনও পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি।”

পুতিন আরও বলেন, “আমি মনে করি না, কোনও বুদ্ধিমান ও শান্ত মনের এবং পরিষ্কার স্মৃতির অধিকারী ব্যক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের চিন্তাও করবেন।”

রাশিয়া কেন বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র পাঠিয়েছে

গত বছর রাশিয়া তার কিছু ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র বেলারুশের ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করেছে। বেলারুশ রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র যা ইউক্রেন এবং ন্যাটো সদস্য পোল্যান্ড, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার প্রতিবেশী।

বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়াকে তার দেশে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধেও দেশটির ভূখণ্ড ব্যবহার করছে রুশ সেনারা।

পুতিন ও লুকাশেঙ্কো উভয়েই বলেছেন, বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের উদ্দেশ্য পশ্চিমা হুমকি মোকাবেলা করা।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির তার পুতিন এই পদক্ষেপের পেছনে ইউক্রেনকে যুক্তরাজ্যের ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়ামযুক্ত বর্মভেদী গোলা সরবরাহ করাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বেলারুশের সঙ্গে ইউক্রেনের ৬৭৩ মাইলের সীমান্ত রয়েছে। এজন্যই দেশটিতে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপন করেছে রাশিয়া। যাতে মস্কো সেগুলো ইউক্রেনে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলে রুশ যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সেখানে আরও সহজে এবং দ্রুত পৌঁছাতে পারে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর ওপরও প্রয়োজনের সময় দ্রুত হামলা চালানো যাবে।

তথ্যসূত্র : ফক্স নিউজ, আল জাজিরা, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনটিএ নেট ডটনেট

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত