Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

বোরখার আড়ালে গানে গানে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই

শাকায়েক ও মাশাল।
শাকায়েক ও মাশাল।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবান আবার ফিরে আসে ২০২১ সালের আগস্টে। ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে গোষ্ঠীটিকে নজরে রাখে বৈশ্বিক ক্ষমতাধররা।

কিন্তু দেশটির নারীরা জানত, তারা কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। নারীদের ওই শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়নি। ক্ষমতায় বসেই তালেবান সরকার নারীদের সেই অন্ধকারে ঠেলে দেয়।

আফগান অন্য নারীদের মতো সেদিন ভয় পেয়েছিলেন কাবুলের দুই বোন। কিন্তু ভয়কে শক্তিতে পরিণত করতে খুব একটা সময় নেননি তারা।

তালেবান যে আগের মতোই নারীদের ওপর জুলুম চালাবে, তা বুঝতে পেরেছিলেন ওই দুই বোন। তাইতো গোপনে তারা নিজেদের কণ্ঠস্বরের শক্তি ব্যবহার করে শুরু করলেন প্রতিরোধ।

সঙ্গীতচর্চা করলে গ্রেপ্তার করা হতে পারেন, এমন ঝুঁকির মধ্যেও তারা ‘দ্য লাস্ট টর্চ’ বা ‘শেষ মশাল’ নামে একটি গানের আন্দোলন শুরু করেন।

দুই বোনের একটি রেকর্ড করে রাখা ভিডিওতে দেখা যায়, গান শুরুর আগে এক বোন বলছেন, “আমরা গাইব, কিন্তু এজন্য আমাদের জীবন দিতে হতে পারে।”

তালেবানের ক্ষমতা দখলের মাত্র কয়েকদিন পরেই গানটি প্রকাশ হয়। সোশাল মিডিয়া ফেইসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে দ্রুতই ভাইরাল হয় গানটি।

সঙ্গীতের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও, বোরখা পরা এই দুই বোন সঙ্গীত জগতের বিস্ময় হয়ে ওঠেন।

ছোট বোন শাকায়েক (ছদ্মনাম) বলেন, “আমাদের লড়াই শুরু হয়েছে তালেবানের পতাকার নিচে থেকেই, তালেবানের বিরুদ্ধে।

“তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগে আমরা কখনও কবিতা লিখিনি। অথচ দেখুন তালেবান আমাদের উপর কেমন প্রভাব ফেলেছে।”

শাকায়েক ও মাশাল।

ক্ষমতায় ফেরার পর আফগানদের দৈনন্দিন জীবনে শরিয়াহ আইন চাপিয়ে দেওয়া ও নারীদের শিক্ষা গ্রহণে বাধা দেওয়া ছিল তালেবানের অগ্রাধিকারের মধ্যে অন্যতম। তখন কাবুল ও অন্য প্রধান শহরের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে নারীরা। কিন্তু তাদের কঠোরভাবে দমন করে তালেবান।

শাকায়েকের ভাষায়, “নারীরা ছিল আমাদের শেষ আশার আলো। এই কারণেই আমরা নিজেদের ‘দ্য লাস্ট টর্চ’ বলে ডাকার সিদ্ধান্ত নিই। বাইরে যেতে না পেরে আমরা ঘরে বসেই গোপনে প্রতিবাদ শুরু করি।”

প্রথম গানের মতো, নীল বোরখার নিচ থেকেই তারা একের পর এক গান প্রকাশ করতে থাকেন।

এসব গানের মধ্যে একটি ছিল প্রয়াত নাদিয়া আঞ্জুমানের বিখ্যাত কবিতা, যা তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম তালেবানের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে লিখেছিলেন।

কবিতাটি ছিল –

বিষে ভরা মুখে, মধুর কথা কেমনে বলি?
নিষ্ঠুর মুষ্টি, চূর্ণ করেছে আমার মুখের বাণী।
কখন আসবে সেই দিন, ভেঙে ফেলব এই খাঁচা,
একাকীত্বের বেড়াজাল ছিঁড়ে, গাইব আনন্দের গান।

তালেবানের নারী শিক্ষা নিষেধাজ্ঞার সময়, নাদিয়া আঞ্জুমান ও তার বন্ধুরা ‘দ্য গোল্ডেন নিডল’ নামে একটি গোপন স্কুলে মিলিত হতেন। সেখানে তারা সেলাইয়ের ভান করে বই পড়তেন। আফগানিস্তানে ‘চাদরি’ নামে পরিচিত নীল বোরখাও পরতেন তারা।

দুই বোনের মধ্যে বড় মাশাল (ছদ্মনাম)। তিনি বোরখাকে ‘একটি চলমান খাঁচার’ সঙ্গে তুলনা করেন।

তিনি বলেন, “এটি একটি সমাধির মতো, যেখানে হাজার হাজার নারী ও মেয়ের স্বপ্ন সমাহিত।”

কাবুলে তালেবানের সদাচার প্রচার ও অসদাচার প্রতিরোধ মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভরত নারীরা।

শাকায়েক বলেন, “এই বোরখা ২৫ বছর আগে তালেবান যে পাথর নারীদের উপর নিক্ষেপ করেছিল তার মতো। ক্ষমতায় ফিরে আসার পর তারা আবারও তাই করেছে।

“তারা যে অস্ত্র আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল, আমরা তাদের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সেই অস্ত্রই ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম।”

এখন পর্যন্ত দুই বোন মাত্র সাতটি গান প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রতিটি গানই আফগান নারীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে।

শুরুতে তারা অন্য লেখকদের গানের কথা ব্যবহার করতেন। কিন্তু ‘কোনও কবিতা আমাদের অনুভূতিগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে না’ এই অনুভূতি থেকে তারা নিজেরাই গান লিখতে শুরু করেন।

তাদের গানের মূল ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে নারীদের দৈনন্দিন জীবনে চাপিয়ে দেওয়া অসহ্য সীমাবদ্ধতা, অ্যাক্টিভিস্টদের কারাদণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়।

গানগুলো প্রকাশের পর ভক্তরা সোশাল মিডিয়ায় গানগুলোর নিজস্ব পরিবেশনা পোস্ট করে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে তারা ছদ্মবেশ ধারণ করে বোরখাও পরেছেন। অন্যদিকে দেশের বাইরে বসবাসকারী আফগান স্কুলছাত্রীদের একটি দল স্কুলের অডিটোরিয়ামে মঞ্চে একটি সংস্করণও রেকর্ড করেছে।

এটি তালেবানের অর্জনের ঠিক বিপরীত।

ক্ষমতা দখলের পর তালেবান প্রথমেই নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করে সেখানে সদাচার প্রচার ও অসদাচার প্রতিরোধ মন্ত্রণালয় স্থাপন করে। নতুন মন্ত্রণালয়টি কেবল বোরখা পরা বাধ্যতামূলক করেনি, ইসলামের মূলনীতি ধ্বংস করার অভিযোগে সঙ্গীতকেও নিষিদ্ধ করেছে।

সদাচার প্রচার ও অসদাচার প্রতিরোধ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রচারণামূলক ভিডিওতে দেখা দেওয়া এক কর্মকর্তা সোয়াবেগুল বলছেন, “গান গাওয়া ও শোনা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি মানুষকে আল্লাহর প্রার্থনা থেকে বিভ্রান্ত করে… সবার এটি থেকে দূরে থাকা উচিত।”

সোশাল মিডিয়ায় তালেবান সৈন্যদের প্রকাশিত এক ভিডিওতে বাদ্যযন্ত্র পোড়াতে ও গ্রেপ্তারকৃত সঙ্গীতশিল্পীদের হাটিয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

বাদ্যযন্ত্র পোড়াচ্ছে তালেবান যোদ্ধারা।

তালেবান তাদের শনাক্ত করতে পারে এই ভয়ে শাকায়েকের বহু রাত ঘুম হয়নি।

মাশাল বলেন, “আমরা সোশাল মিডিয়ায় তাদের হুমকি দেখেছি: “একবার আমরা তোমাদের খুঁজে পেলে, তোমাদের গলা থেকে জিহ্বা বের করে ফেলার উপায় আমরা জানি।”

“আমাদের বাবা-মায়েরা এই মন্তব্যগুলো পড়লে ভয় পান। তারা বলেন, যথেষ্ট হয়েছে, আমাদের এখন থামা উচিত। কিন্তু আমরা তাদের বলি, আমরা পারব না। স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যেতে পারি না আমরা।”

নিরাপত্তাজনিত কারণে গত বছর দুই বোন দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। তবে তারা শিগগিরই দেশে ফেরার আশা রাখেন।

কানাডায় বসবাসকারী আফগানিস্তানের পেশাদার র‍্যাপার সোনিটা আলিজাদা বিদেশ থেকে ‘লাস্ট টর্চের’ ভিডিওগুলোর প্রশংসা করেছেন।

তিনি বলেন, “যখন আমি দুই নারীকে বোরখা পরে গান গাইতে দেখলাম, সত্যি বলতে গেলে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।”

১৯৯৬ সালে তালেবান প্রথমবারের মত ক্ষমতা দখল করে। সেই বছরেই জন্ম নেয় সোনিটা আলিজাদা। ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে ইরানে পালিয়ে যান। সেখানে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তার মা।

কিন্তু সোনিটা সঙ্গীতের মাধ্যমে সেই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটান। ‘লাস্ট টর্চের’ দুই বোনের মত তিনিও তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা নারীদেরকে আশার আলো হিসেবে দেখেন।

কাবুলের রাস্তায় আফগান নারীদের বিক্ষোভ মিছিল।

লাস্ট টর্চের একটা গানের কয়েকটা লাইন –

তোমার লড়াই সুন্দর,
নারীর চিৎকার তোমার।
ভাঙা কাচে ফুটে ওঠা
ছবি আমার।

সোনিটা বলেন, “আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত হতাশাজনক। আমরা দীর্ঘদিনের অগ্রগতি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এই অন্ধকারেও আলো জ্বলছে। আমরা দেখছি ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব প্রতিভা দিয়ে লড়াই করছে।”

ফারিদা মাহওয়াশ আফগানিস্তানের অন্যতম খ্যাতিমান নারী সঙ্গীতশিল্পী। বিবিসি সম্প্রতি ‘লাস্ট টর্চের’ একটি গান তাকে শোনায়। 

গান শোনার পর তিনি বলেন, “এই দুই গায়িকা চার হবে, তারপর দশ হবে, তারপর হাজার হবে। একদিন যদি তারা মঞ্চে ওঠে, আমি হাঁটার লাঠি হাতে নিয়েও তাদের সঙ্গে হাঁটব।”

ফারিদা মাহওয়াশ ও তার গানের দল।

গত বছর কাবুলে অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর নির্যাতন আরও তীব্র হয়েছে। কর্তৃপক্ষ নারীদের সমাবেশ আয়োজন করতে নিষেধ করেছে। নিষেধ অমান্যকারীদের গ্রেপ্তারও করেছে।

লাস্ট টর্চের একটি গান তালেবানের হাতে বন্দি নারীদের ওপর হওয়া নির্যাতন নিয়ে। গানটি হলো –

নারীর কণ্ঠস্বরের ঢেউ,
ভাঙে কারাগারের শেকল, তালা,
রক্তে ভরা আমাদের কলম,
ভাঙে তোমার তলোয়ার, তীর।

শাকায়েকের মতে, “এই কবিতাগুলো আমাদের হৃদয়ে যে দুঃখ ও যন্ত্রণা আছে তার ক্ষুদ্রতম অংশ।

“আফগান জনগণের বেদনা, তাদের সংগ্রাম ও গত কয়েক বছর ধরে তালেবানের শাসনে তাদের যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, তা কোনও কবিতায় পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব নয়।”

জাতিসংঘ বলেছে, তালেবান তাদের বর্তমান নীতিতে চলতে থাকলে তারা লৈঙ্গিক বর্ণবাদের জন্য দায়ী হতে পারে। তবে তালেবানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন করছে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ মেনে নেবে না।

শাকায়েক ও মাশাল তাদের পরবর্তী গানগুলোতে কাজ করছেন। আফগানিস্তানের নারীদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে তাদের কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনিত করার আশা তাদের।

“আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করা যাবে না। আমরা ক্লান্ত নই। আমাদের সংগ্রামের শুরু মাত্র।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত