Beta
শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪
Beta
শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

বৃষ্টির হেরফেরে লিচুতেও গড়বড়

বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব পড়েছে দিনাজপুরে লিচু চাষে।
বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব পড়েছে দিনাজপুরে লিচু চাষে।
Picture of খালিদ আরাফাত

খালিদ আরাফাত

দিনাজপুর সদরের উলিপুরের মোজাফফর আলী গত বছর আড়াই লাখ বেদানা লিচু বিক্রি করেছেন। কিন্তু এবার ১০ হাজার লিচু বিক্রি করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও সংশয়ী।

কেন এই সংশয়? কারণ জানতে চাইলে এই লিচুচাষি বলেন, মুকুল অবস্থায় শুরুতে বৃষ্টি হওয়াতে অনেক ফুল গেছে ঝরে। এরপর দানা আসার সময়টাতে দরকার বৃষ্টি, কিন্তু তখন শুরু হলো তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড রোদে জ্বলে দানা খুব কম এসেছে।

এবার এপ্রিলের শুরু থেকে দাবদাহ চলছে গোটা দেশে। এভাবে চলতে থাকলে যেটুকু লিচু গাছে আছে, তা টেকানোও মুশকিল হবে বলে জানান মোজাফফর।

এক মোজাফফরই নন, এবার বৃষ্টির হেরফেরে দিনাজপুরের সব লিচুচাষিরই মাথায় হাত পড়েছে। আর বাংলাদেশে লিচু উৎপাদনে যেহেতু এই জেলাই শীর্ষে, তাই সার্বিক উৎপাদনেও পড়বে তার প্রভাব।

বাংলাদেশে লিচু বলতেই সবার আগে আসে দিনাজপুর জেলার নাম। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পুরো দিনাজপুরে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে। প্রতিবছর গড়ে হেক্টর প্রতি ৫ দশমিক ৮৫ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদিত হয়। পুরো জেলাতেই প্রচুর লিচুর বাগান থাকলেও সদরের মাশিমপুর, শিকদার, মহব্বতপুর ও উলিপুরে চাষ হয় বেশি।

সারাদেশে যেসব লিচুর জাত রয়েছে তা হলো- বোম্বাই, মাদ্রাজী, বেদানা, মোজাফফরপুরি, কাঁঠালী, চায়না-টু, চায়না-থ্রি, হাড়িয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে দিনাজপুরের বেদানা লিচুর কদর আলাদা।

অন্য যে কোনও জাতের চেয়ে বেদানা লিচুর মিষ্টতা ও শাঁসের পরিমাণ বেশি। অন্যান্য জাতের লিচুর শাঁসের পরিমাণ যেখানে ১৯ শতাংশ, সেখানে বেদানা লিচুতে প্রায় ২৮ শতাংশ। আকারে গোলাকার এ লিচুর রঙ গোলাপি। এর বীজ ছোট হওয়ায় রসালো অংশ বেশি।

মৌসুমে সবার আগে ওঠে বেদানা ও মাদ্রাজী লিচু। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় বেদানা লিচুর অবস্থা এবার শোচনীয়।

দিনাজপুরের বাগানগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, গাছে লিচুর দানার সংখ্যা খুবই কম। অনেক বেশি লোকসানের আশঙ্কা করছেন চাষিরা।

উলিপুরের বাগানি আবদুর রহিম তিন বছরের জন্য চারশরও বেশি গাছ ইজারা নিয়েছেন। তিনি হিসাব দেন, ইজারা, সার্বিক পরিচর্যা ও অন্যান্য সব মিলিয়ে এই তিন বছরে তার খরচ হবে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। এ বছর লাভ তো দূরের কথা, খরচের অর্ধেকও উঠবে না বলে দুর্ভাবনায় রয়েছেন রহিম।

মাশিমপুরের লিচুচাষি নজরুল ইসলাম বললেন, “প্রচুর সেচ দিতে হচ্ছে, কিন্তু এত চড়া রোদ, তাতে বেশ ক্ষতি হচ্ছে।

“একে ফল তো অনেক কম টিকেছে, এরপর এমন চড়া তাপপ্রবাহ থাকলে লিচুর শাঁস কম হবে, দাগ হবে, রসও কম হবে। সব মিলিয়ে মান খুব খারাপ হবে।”

বোম্বাই ও চায়না-থ্রি দেরিতে ফল আসে। তাই এখনও সেই বাগানে বড় প্রভাব না পড়লেও এ অবস্থা চলতে থাকলে সেগুলো টেকানো মুশকিল হয়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।

প্রায় বৃষ্টিহীন এপ্রিল কাটিয়ে মে মাসের শুরুতে বৃষ্টির আভাস থাকলেও তাপপ্রবাহ একেবারে কেটে যাবে, লিচুচাষিদের জন্য আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে তেমন সুখবর এখন পর্যন্ত নেই।

বিভিন্ন বাগান ঘুরে দেখা যায়, চাষিরা এখন সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন প্রকৃতির ওপর। সরকারি কৃষি কর্মকর্তাদের সহায়তা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ তাদের।

তারা বলেন, শীত বা কুয়াশার হাত থেকে বাঁচাতে যেমন কিছু ওষুধ বা রাসায়নিকের পরামর্শ তারা পান। কিন্তু খরতাপের হাত থেকে বাঁচাতে পানি দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় তাদের জানা নেই।

তাপপ্রবাহ যে এ বছর লিচুর ফলনে প্রভাব ফেলবে, তা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুরও স্বীকার করেন।  

তবে অধিদপ্তর থেকে কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

মোস্তাফিজুর বলেন, বিরূপ এই অবস্থায় কৃষকদের ৮/১০ দিন পর সেচের পানি দিতে বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট মাত্রায় নির্দিষ্ট কীটনাশক ও ওষুধ প্রয়োগেরও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

সাধারণত মে মাসের শেষ দিকে লিচু পাকতে শুরু করে। এরপর তা বাজারে আসে। লিচুর জন্য আলাদা বাজার স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছেন বাগানিরা।

এদিকে লিচু চাষের সঙ্গে সম্পর্কিত মধু চাষ। লিচু ফুলের মধু থেকে উৎপাদিত মধু উৎকৃষ্ট মানের বলছেন মৌ খামারিরা।

তাদেরই একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র মো. মোসাদ্দেক হোসেন। তিনি মৌমাছির চাষ, মধু উৎপাদন এবং এ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন।

মোসাদ্দেক জানান, এবার লিচুর মুকুলের সময় সারাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ১১শরও বেশি মৌ খামারিরা দিনাজপুরের লিচু বাগানে মৌ বাক্স স্থাপন করেছে।

লিচু বাগানে মৌমাছি পালনে মধু যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পরাগায়নে লিচুর ফলনও অনেক বাড়ে।

দিনাজপুরে লিচু ফুলের মৌসুমে সাড়ে ৩ হাজার মেট্রিক টন মধু আহরণের রেকর্ডও আছে জানিয়ে মোসাদ্দেক বলেন, বছরে ১০০ কোটি টাকারও বেশি বাণিজ্য হয় মধু থেকে। চাল ও লিচু ছাড়া মধুও হতে পারে দিনাজপুরের ‘ব্র্যান্ড’।

তিনি আরও বলেন, এরপরও মাত্র ২০ শতাংশ লিচুর মধু আহরণ সম্ভব হয়। ৮০ শতাংশ মধুই নষ্ট হয় পর্যাপ্ত মৌ খামারের অভাবে। ঘানি স্থাপন, বাজারজাতসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে যেমন ব্যাপক বাণিজ্য সম্ভব, তেমনি খুলবে কর্মসংস্থানের নতুন দুয়ার।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত