Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

কৃষিতে জিনগত পরিবর্তন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ, নানা প্রশ্ন

বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), নয়াকৃষি আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ ও জিএম বিরোধী মোর্চা যৌথভাবে এই আলোচনার আয়োজন করেছিল।
বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), নয়াকৃষি আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ ও জিএম বিরোধী মোর্চা যৌথভাবে এই আলোচনার আয়োজন করেছিল। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of প্রতিবেদক, সকাল সন্ধ্যা

প্রতিবেদক, সকাল সন্ধ্যা

বাংলাদেশের কৃষিতে জিনগত পরিবর্তন বা জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন আছে কিনা, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে। এরপরেও গোল্ডেন রাইস ও বিটি বেগুন প্রবর্তনের অব্যাহত চেষ্টার বিষয়ে উদ্বেগের কথা উঠে এল কয়েকটি সংগঠনের যৌথ আলোচনায়।

সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘জিএম শস্য গোল্ডেন রাইস ও বিটি বেগুন : বাংলাদেশে প্রবর্তনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশ্নের নিরসন জরুরি’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় উঠে আসে এ সংক্রান্ত উদ্বেগ, নানা প্রশ্ন। বিজ্ঞানের নামে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করছে, এমন অভিযোগও উঠে আসে।

বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), নয়াকৃষি আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ ও জিএম বিরোধী মোর্চা যৌথভাবে এই আলোচনার আয়োজন করেছিল।

সাংবাদিক, পরিবেশ ও কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ে প্রাথমিক বক্তব্য তুলে ধরেন উবিনীগের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার। তিনি পড়ে শোনার মূল প্রবন্ধও। আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য দেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের চেষ্টা চলছে অভিযোগ করে বক্তারা বলেন, গোল্ডেন রাইস একটি জেনেটিকালি মডিফাইড ফসল। ধানের স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক গঠন সংকেতে জোর করে ভিন্ন ‘জিন’ প্রবিষ্ট করানো হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) এই গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের (ইরি) অধীনে। তাই এটাকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলা যাবে না।

মূল প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ব্রি ধান-২৯ ধানের সঙ্গে ফিলিপাইনের আই আর-৬৪ ও আর সি-২৮ জাতের সঙ্গে ভুট্টার জিন যুক্ত করে বিটা কেরোটিন বা ভিটামিন এ-যুক্ত নতুন জাত সৃষ্টি করা হয়েছে। ধানটির চাল সোনালী রংয়ের বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে গোল্ডেন রাইস। যার স্বত্ব সিনজেনটা কোম্পানির কাছে।

সেখানে বলা হয়, জিএম ফসল হিসেবে গোল্ডেন রাইসের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত ঝুঁকি, কার্যকারিতা এবং এই ধানের আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা; সেসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর এখনও মেলেনি।

সময় নিয়ে এই ধানের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করায় এবং এখনও অনুমোদন না দেওয়ায় পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানায় মতবিনিময় আয়োজনকারী সংস্থাগুলো। তবে তারা এটাও অভিযোগ করে যে, কোম্পানি ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে তাড়া দেওয়া হচ্ছে। সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারেরও চেষ্টা হচ্ছে।

প্রবন্ধে উঠে আসে, বিশ্বে গোল্ডের রাইসের বিতর্কিত অবস্থানের কথা। জানা যায়, ফিলিপাইনে অনুমোদ দেওয়া হলেও পরে তা বাতিলের কথা। ফিলিপাইনের কৃষকরাও এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছেন।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ব্রি-২৯ চাষ করেন। সেখানে কারও কোনও পেটেন্ট নেই। কৃষক এই ধানের বীজ নিজেই রাখে কিংবা বাজার থেকে কিনে নেয়। স্বাধীনভাবেই তারা এই ধান চাষ করতে পারে।

তাহলে ধানের স্বত্ব কেন বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে, স্বত্ব চলে গেলে দেশের লাখো-কোটি কৃষকের ভাগ্যে কী ঘটবে, সে প্রশ্নও উঠে আসে আলোচনায়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে এর জবাবও চান উপস্থিত বক্তরা।

ফরিদা আখতার বলেন, “দাবি করা হচ্ছে এবং প্রচার চালানো হচ্ছে গোল্ডেন রাইস ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ। বলা হচ্ছে এর মধ্যে কেরটিনয়েড রয়েছে, যা মানুষের শরীরে হজম হতে গিয়ে ভেঙে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়। এটা অনুমান। যদি অনুমান সত্যি বলেও ধরে নেওয়া হয় তাহলে জানতে হবে এই ভাত খেলে কী পরিমাণ কেরোটিনয়েড ভাত থেকে আলাদা করে শরীর গ্রহণ করতে পারে এবং তা ভেঙে রূপান্তর ঘটিয়ে কী পরিমান ভিটামিন এ বানাতে সক্ষম হয়।”

এসব তথ্য উপাত্তের ঘাটতির কথাও তুলে ধরা হয় আলোচনার মূল প্রবন্ধে।

এই ধান ঘরে রাখলে, গুদামজাত করলে এবং রান্নার পরে শেষ পর্যন্ত কী পরিমাণ কেরোটিনয়েড টিকে থাকবে, সে বিষয়ে তথ্য উপাত্তও নেই বলে উল্লেখ করা হয়।

বক্তারা বলেন, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এই গোল্ডেন রাইসকে পুষ্টির একটি মাধ্যম দেখিয়ে দাতব্য কাজের উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাইছে। তাদের দাবি, ভিটামিন-এ ঘাটতি এবং রাতকানা রোগ থেকে বাঁচতে এই ধানের ভাত খেতে হবে।

কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন-এ বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যের সাধারণ উৎসের মধ্যেই আছে। তাহলে কেন অহেতুক দেশের একটি প্রচলিত ধান বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে সে প্রশ্নও উঠে আসে।

প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ ধানের আদি নিবাস। ১৯১৫ সালে এদেশে ১৫ হাজার জাতের ধান ছিল। এখনও কমপক্ষে সাড়ে সাত হাজার জাতের জাত ধান দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানেই আছে, কৃষকদের হাতেও আছে তিন হাজার জাতের ধান।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের জন্য নতুন জাতের ধানের প্রয়োজন আছে কিনা, সে প্রশ্নও ওঠে। ধানের দেশে ধানের ওপর জিন কারিগরি কোনও দায়িত্বশীল আচরণ হতে পারে না বলে মত দেন বক্তারা।

একই ধরনের বক্তব্য উঠে আসে বিটি বেগুনের প্রসঙ্গে। প্রাণের গঠন সংকেতে বিকৃতি ঘটিয়ে জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের অতি পরিচিত বেগুনে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে অভিযোগ করে প্রবন্ধে বলা হয়, বিটি বেগুন নিয়ে গবেষণা একই সঙ্গে ভারত ও ফিলিপাইনে করা হলেও, দেশদুটিতে ছাড়পত্র মেলেনি। ভারতের উচ্চ আদালত অনির্দিষ্ট কালের জন্য জিএম ফসলের সব রকম মাঠ পরীক্ষা বন্ধের সুপারিশ করেছে।

ভারত-ফিলিপাইনে অনুমতি না মিললেন বাংলাতেশে কৃষক পর্যায়ে বিটি বেগুনের উন্মুক্ত চাষের অনুমতি দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বিটি বেগুনের বীজ প্রথমে সীমিত আকারে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। যদিও ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল কমিটি অন বায়োসেফটি সাতটি শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দিয়েছিল। তবে সেসব শর্ত মেনে চলতে ব্যর্থ হয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ।

বলা হয়েছিল, বিটি বেগুন শুধু ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন করবে। অথচ স্থানীয় জাতের বেগুনে পোকা লাগার পরিমাণ খুব কম। পোকা লাগে হাইব্রিড বেগুনে। যেসব স্থানীয় জাতে এই জিএমও কারিগরি করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটিরই পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা আগে থেকেই ছিল।

জিনগত পরিবর্তন করে বিটি বেগুন গাছকেই বিষাক্ত করে ফেলা হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, গাছটি নিজেই এখন বিষাক্ত কীটনাশক, পোকা তার পাতা বা ডগা খেতে এলে মরণ অবশ্যম্ভাবী।

জিএম ফসল প্রবর্তনের ঝুঁকি যে বিশাল ও মারাত্মক হতে পারে, সেটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী ও নীতি নির্ধারক মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাংলাদেশে সেটিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ ওঠে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত